তখন গান ছিল অনুভবের -মণি কিশোর

07 Jun 2021, 01:36 PM সারেগারে শেয়ার:
তখন গান ছিল অনুভবের -মণি কিশোর

‘কী ছিলে আমার বল না তুমি, আছি তো আগেরই মতো এখনো আমি...’ গত শতকের নয়ের দশকে যারা কৈশোর ও যৌবন পার করে এসছেন তাদের নিশ্চয়ই মনে আছে মণি কিশোরের এই আলোড়ন সৃষ্টিকারী গানের কথা। পাঁচ শতাধিক গানে কণ্ঠ দেওয়া এই শিল্পীকে এখন আর সংগীতভুবনে দেখাই যায় না। হঠাৎ-ই এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়ে গেল এ-শিল্পীর সঙ্গে। জমে উঠল আড্ডা। সারেগারের আজকের আয়োজন তুলে ধরা হলো সেই আড্ডার কছু অংশ। লিখেছেন নিথর মাহবুব...


একসময় অডিও বাজারের ব্যস্ত শিল্পী ছিলেন মণি কিশোর। এখন তিনি গান থেকে দূরে। কথায় কথায় বোঝা গেল সংগীত নিয়ে তার ভেতরে জমে আছে অনেক অভিমান। সে অভিমানের কথায় পরে আসছি। জনপ্রিয় এই শিল্পীর কাছে জানতে চাই তার বিখ্যাত গান ‘কী ছিলে আমার বল না তুমি-’র পেছনের গল্প। বলতে শুরু করন, ‘রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, রিকশায় দুটি ছেলে-মেয়ে ঝগড়া করছিল। একজন বলছে, তুমি কি আগের মতো আছ ? আরেকজন বলছে, আমি আগের মতোই আছি। তাদের ঝগড়ার কথাগুলো আমার মাথায় ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো পিঠে কথাগুলো লিখে নিলাম। তখন আমার ‘চার্মিং বউ’ অ্যালবামের পরিকল্পনা চলছিল। গান যোগাড় করছিলাম। বাসায় এসে কথাগুলো দিয়ে ছয় লাইন সাজাতে পারলাম। মাত্র ছয় লাইনে তো গান হয় না। তাই গানটিকে অ্যালবামে রাখতেই চাইনি। পরে কী মনে করে সুর করে ক্যাসেটের বি পিঠের প্রথমে গানটি রাখলাম। ভাবতেই পারিনি বি পিঠের এই গানটিকেই শ্রোতারা এভাবে লুফে নেবে, এত জনপ্রিয় একটি গান হবে। এখন তো মনে হচ্ছে মরার পরে এই গানই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। এখনো কোথাও গেলে সবাই এই গানের কথাই আগে বলে।

এই গানটির জনপ্রিয়তার কথা বলতে গিয়ে মণি কিশোর তখনকার এক মধুর স্মৃতি তুলে ধরেন। বলেন, একবার রিক্সা দিয়ে যাচ্ছিলাম। চালক মনের আনন্দে গেয়ে যাচ্ছিল ‘কী ছিলে আমার বল না তুমি, আছি তো আগেরই মতো এখনো আমি.....’ আমি জিজ্ঞেস করলাম- ভাই এটা কার গান ? চালক বলল, ইন্ডিয়ান শিল্পী, মণি কিশোর, বাংলাদেশের শিল্পীরা এমন গান গাইতে পারব না। এবার বললাম, যদি মণি কিশোরের সঙ্গে দেখা হয় কী করবেন ? বলল, ভাই, মনি কিশোর থাকে ইন্ডিয়া, আর আমি হইলাম রিকশা চালাই; হের লগে আমার দেখা হওন সম্ভব না। তবে, মণি কিশোরের গান আমার অনেক পছন্দ। আমার চোখ তখন ভিজে যাচ্ছিল। নিজের পরিচয় আর দিলাম না। গন্তব্যে এসে রিকশাওয়ালাকে ৫০ টাকার নোট দিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। রিকশাাচালক ডেকে বলল, ভাই, টেকা ফেরত নিবেন না। আমি বললাম, তুমি পুরোটাই রেখে দেও।

নয়ের দশকে ‘চার্মিং বউ’ অ্যালবামের এই এক গানে মণি কিশোরের নাম জেনে গেল গোটা দেশ। তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিল বাজারকাটতি অ্যালবামের শিল্পী হিসেবে। তারপর একে একে ৩০টির বেশি একক অ্যালবাম করে ফেললেন। একসময় অডিও জগতে ঘটল পালা বদল। কোথাও আর মণি কিশোরের দেখা মেলে না। তবে ‘উৎসব’, ‘এই তুমি সেই তুমি নেই তুমি’, ‘কী করে ভাবলে’, ‘আমাকে ভালোবাসা সে তোমার প্রথম ভুল’-এর মতো সফল অ্যালবামের এই শিল্পী আছেন এই ঢাকা শহরেই। থাকেন বাসাবো এলাকায়। জড়িত আছেন ব্যবসার সঙ্গে। অবশ্য গানের জগতে আসার আগেও তিনি ব্যবসাই করতেন। যখন সংগীতের জগতে ব্যস্ত শিল্পী ছিলেন তখনো ব্যবসাটাকে ছাড়েননি। 

মণি কিশোর তাঁর পোশাকি নাম। তাঁর প্রকৃত নাম মণি মণ্ডল। কিশোর কুমারের ভক্ত ছিলেন বলে নামের সঙ্গে ‘কিশোর’ জুড়ে নিয়েছিলেন। মণি কিশোর জানালেন, এক যুগেরও বেশি সময় আগে শেষবারের মতো অ্যালবামে গেয়েছেন তিনি। তারপর টিভির জন্য টেলিফিল্ম, লাইভ শো এসবেও মাঝে মধ্যে গান গেয়েছেন। আবার পেশাজীবীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মাঝে মধ্যে গাওয়ার ডাক পান। পুলিশ, কাস্টমস, পর্যটন এরকম পেশার মানুষের ঘরোয়া আসরে গাইতে যান। কনসার্ট তথা স্টেজ শোতে তাঁর যাওয়া হয় না। গান এখনো তাঁকে তাড়া করে ফেরে। তবে আশার কথা হচ্ছে মণি কিশোর আবার গাইতে শুরু করেছেন। তরুণ প্রজন্মের গীতিকার সুরকারদের কিছু গান নিয়ে কাজ করছেন বলে জানালেন তিনি। চলতি বছরই এমন দু-একটি গান ইউটিউবে আসবে বলে জানান এই নন্দিত শিল্পী। দুই একটি গানের রেকর্ডিংও হয়ে গেছে বলে জানান।

মণি কিশোর বলেন, ‘আসলে এখনকার গানের সঙ্গে তাল মেলাতে পারি না আমি। এখন গান হয়ে গেছে দেখার বিষয়। আমাদের সময়ে ছিল উল্টো। আমাদের সময়ে গানটা ছিল অদেখার প্রতি আকর্ষণ। গানের মাধ্যমে শ্রোতা তো আমাদের চিনত। তখন গান ছিল অনুভবের বিষয়। ঈদের আগে ভক্তরা ক্যাসেটের দোকানে গিয়ে খোঁজ নিত তাদের প্রিয় শিল্পীর কোনো গানের ক্যাসেট ঈদে এসেছে কি না। আর অ্যালবাম প্রকাশের আগে আমরা আরাম বাগে প্রেসে গিয়ে দেখতাম, অ্যালবামের পোস্টারটা কেমন হলো। গানের পরিবেশটা ছিল অন্য রকম। সন্ধ্যায় সুরকার, গীতিকার ও শিল্পী মিলে আড্ডা দিতাম। সবাই বসে কেমন গান করব, কীভাবে করব এসব নিয়ে কথা বলে সমন্বয় করতাম। আর এখন কেউ গান লিখে পাঠিয়ে দিচ্ছে মেইলে, আরেকজন সুর করে পাঠিয়ে দিচ্ছে, শিল্পী নিজের মতো করে সেই সুরে গেয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ কারো সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন মনে করছে না। শিল্পী কার গান গাচ্ছে, কী গান গাচ্ছে এসব দিকে মনোযোগী না কেউ। কারণ, সবার ভাবনা এখন গানের ভিডিও নিয়ে। এখন গানের চেয়ে বেশি বাজেট থাকে গানের ভিডিওতে। ভিউ বেশি হওয়ার জন্য ভিডিওর প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখন আর অডিও বলে কিছু নেই। একটা গান তৈরি করতে ২০ হাজার টাকা খরচ হলে মিউজিক ভিডিওতে খরচ হয় এক লাখ টাকা। গান কি গাজী মাজহারুল আনোয়ার লিখবে, নাকি মনিরুজ্জামান লিখবে, সেই আলোচনা নেই। কোন ক্যামেরা দিয়ে শুটিং করবেন, কোথায় শুটিং করবেন, এসব আলোচনাই মুখ্য। যে কারণে, এখনকার গানগুলো স্থায়িত্ব পাচ্ছে না। ’

মিউজিক ভিডিওতে মুখ দেখাতে চান না মণি কিশোর। তবে, গতানুগতিকের বাইরে একেবারে উল্টো স্রোতেও চলতে পারেন না। তাই সময়ের সঙ্গে একটু মানিয়ে নিয়ে স্টুডিওতে গাওয়ার দৃশ্যকে মিউজিক ভিডিওতে জুড়ে দিচ্ছেন।

সংগীতের অনেক রদবদল হলেও মণি কিশোর শ্রোতাদের ভালোবাসায় এখনো আপ্লুত হন। তেমনই এক অভিজ্ঞতার কথা বললেন তিনি, ‘করোনার মধ্যেই এক ত্রাণ বিতরণে গিয়েছি। সম্পর্কে বড়ো ভাই এক নেতার বাসায় বসেছি। ভাবি এসে বললেন, তোমার সঙ্গে এক ভদ্রমহিলা দেখা করবেন। ভদ্রমহিলা এলেন। পঁয়ত্রিশের বেশি বয়স হবে না। তিনি এসেই ভরা মজলিশে আমার হাত ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। আরে, কী ব্যাপার ! ভদ্রমহিলা বললেন, তিনি যখন ক্লাস ফাইভ-সিক্সে পড়েন, তখন তাঁর বড়ো বোন আমার ক্যাসেট জোগাড় করে শুনতেন। তখন থেকে তাঁর ইচ্ছা জীবনে একবার হলেও আমাকে দেখবেন। তিনি শুনেছেন যে, এলাকায় মণি কিশোর এসেছেন। তাই দেখতে এসেছেন।’ এধরনের ভালোবাসার জন্য শ্রোতাদের কাছে মণি কিশোরে কৃতজ্ঞতা অনেক।

মণি কিশোর পাঁচ শতাধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। রেডিও, টিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী হলেও গান গেয়েছেন অল্প। সিনেমায় তিনি একটি মাত্র গানই গেয়েছেন। সিনেমার গানে আগ্রহ কম থাকার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘আমি যে-বছর সিনেমায় ‘কী ছিলে আমার বল না তুমি’ গানটি গেয়ে ছিলাম সে বছর এই গানের জনপ্রিয়তার ধারেকাছে কোনো সিনেমার গান ছিল না। অথচ আমি সে বছর জাতীয় পুরস্কার পাইনি। তবে এমন না যে এই অভিমানে আমি চলচ্চিত্রে গান করিনি। প্লেব্যাক করতে আমি কমফোর্ট ফিল করতাম না। প্রচুর সময় দরকার হতো একটা গানের পেছনে। এত সময় আমি দিতে পারব না বলেই চলচ্চিত্রে গান করিনি।’

চলচ্চিত্রে তখন না গাইলেও অডিওতে চুটিয়ে কাজ করেছেন মণি কিশোর। তাঁর জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘কী ছিলে আমার’, ‘সেই দুটি চোখ কোথায় তোমার’, ‘তুমি শুধু আমারই জন্য’, ‘মুখে বলো ভালোবাসি’, ‘আমি মরে গেলে জানি তুমি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাঁর সবচেয়ে শ্রোতাপ্রিয় গান ‘কী ছিলে আমার’ তাঁরই সুর করা, তাঁরই লেখা। ২০টির মতো গান লিখেছেন ও সুর করেছেন মণি কিশোর।