ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

08 Jun 2021, 02:33 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

পর্ব- ৭


ঘড়ির কাঁটা তখন ৯টা ছুঁই ছুঁই কিন্তু সূর্য তখনও তার আয়োজন পুরোপুরি গুটায়নি, আকাশের মন খারাপ তাই চারপাশ কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। আমরা অনেকটা নাছোড়বান্দার মতো হেঁটে চলেছি- যে-দিকটায় এসে পথ থেমে গেছে। আমরা তখনও দিক পরিবর্তন করছি কিন্তু ঘরে ফেরার তাগাদা অনুভব করছি না। যে-পথে এগুচ্ছি প্রথমটায় মনে হলো আমরা স্থানীয় বসতি এলাকায় ঢুকে পড়েছি, কিন্তু কিছুটা এগুতেই বুঝলাম এ আসলে হোটেল পাড়া অর্থাৎ বেশ কিছু বিলাসবহুল হোটেল এখানে যেন ঘাপটি মেরে আছে। পথে যেতে যেতে বোর্ডারদের কোলাহল, হাসি কানে এলো নিস্তব্ধ রাতে এ যেন একটু জোরেসোরেই কানে বাজল। আকাশ তখনও নাকি কান্না কেঁদে চলেছে, সঙ্গে বাড়ছে শীতের তীব্রতা তাই আমরা আর এগুলাম না, ফিরে এলাম গন্তব্যে। অবশ্য ফেরার পথে একটু সুপারশপ ঘুরে এলাম সকালের নাস্তার কিছু জোগান নিয়ে। 

দুপুরে শুধু নুডুলস দিয়ে ভুড়িভোজ সারতে হয়েছিল বলে ফারজানার ছেলে সাবিত খুবই নাখোশ ছিল ; তাই ফারজানা এখন ডালচাল নিয়ে পড়ল অথাৎ খিচুড়ি রান্না হবে। রান্নার যাবতীয় উপকরণ ফারজানা সঙ্গে করে এনেছে, অবশ্য হলিডে হোমসে রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে, যা ফরাজানা তার বন্ধুর কাছ থেকে জেনেছে আর রান্না করে খাওয়ার সুবিধাও আছে বৈকি। প্রথমত গোটা ইউরোপ ঘুরে হালাল খাবার পাওয়া সত্যি দুস্কর, দ্বিতীয়ত এ-রকম পর্যটন এলাকাতে খাবার কিনে খাওয়া বেশ ব্যয়বহুল, তাই সঙ্গে করে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, মরিচ নিয়ে যেতে পারলে একে তো জিহ্বার স্বাদ বাঁচে অন্যদিকে অর্থেরও সাশ্রয় হয়। যোগাড়যন্ত্র ভালোই ছিল কিন্তু রান্না করতে গিয়ে দেখা গেল, হলুদ আনা হয়নি, অগত্যা জীবনে প্রথমবারের মতো সাদা খিচুড়ি খেলাম, তবে দিনশেষে এটাই অমৃত মনে হয়েছে।

পরদিন ভোরেই ঘুম ভেঙে গেল, আমরাও অলস শুয়ে না-থেকে সকাল সকালই নাস্তা সেরে নিলাম। মেন্যু ডিম ভাজা আর পাউরুটি, সাথে চিনি ছাড়া রং-চা। এরপর হাড়িকুড়ি মেজেঘষে ঘরদোর গোছগাছ করে একেবারেই বেরুলাম। এখানে এই এক বিপত্তি, বিশেষ করে হলিডে হোমসে থাকতে এলে চেক আউটের আগে একদম ঘরদোর গুছিয়ে বেরুতে হবে, এটাই এখানকার নিয়ম। যাহোক, ‘যস্মিন দেশে যদাচার’। আজ আর খাঁড়ির পথে গেলাম না, গতকাল বিকেলের সেই অধরা ঝরনার গন্তব্য সন্ধানে আমরা বদ্ধ পরিকর। যদিও সকাল এখন আর নরম নেই, সূর্যের তেজও বেশ ; চারদিক আলো ঝলমলে তাই প্রকৃতির রূপও নজর কাড়ছে। কাল বৃষ্টি আর মেঘলা আবহাওয়ায় প্রকৃতির এই রূপটি তেমন একটা চোখে পড়েনি। আমরা যেখানটায় ছিলাম তা আদতে একটি ফার্ম হাউজ। আমাদের পথে যেতে যেতে এই ফার্ম হাউজের চৌহদ্দিও দেখা হলো, বিস্তৃর্ণ তৃণভ‚মি- এখানে-সেখানে চড়ে বেড়াচ্ছে গোরু আর ভেড়া, দূরে পাহাড়ের কোলঘেষে দু-একটি ঘোড়াও রয়েছে লাগাম ছাড়া, থেকে থেকে তাদের চিহি রব জানান দিচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। সকালের রুপালি আলোয় এ-দৃশ্য যেন কিশোরী বয়সে পড়া ওয়ের্স্টান সিরিজগুলোর দৃশ্যায়ন। মুগ্ধতাকে ধরে রাখার জন্য ফটোসেশন যেন বাধ্যতামূলক হয়ে গেল।

যেহেতেু গন্তব্য নাম না-জানা ঝরনার ঠিকানায় পৌছানো, তাই আবার পথ চলতে থাকা- একসময় সবুজ ঘাসের রাজত্ব ছেড়ে ছিমছাম কংক্রিটের পথে এসে পড়লাম, বেলা তখন বোধকরি দশটা হবে। সময়টা কর্মচঞ্চল কিন্তু ফ্লম যেন এখনও আড়মোড়া ভাঙ্ছে। প্রায় জনমানব শূন্য পথে আমরা ক’জন পর্যটক ঝরনার সন্ধানে চলেছি- এখানে পথে কোনো নির্দেশনা চোখে পড়ল না, আমারা ঝরনার একটানা বয়ে চলা গুঞ্জন লক্ষ্য করে এগুচ্ছি। একমুখী পথ, খুব বেশি সমস্যা হচ্ছে না। তবে, একসময় মনে হলো, আমার অনেকটা এগিয়ে এসেছি আবার পিছু হটলাম কিন্তু ঝরনারানির পথের হদিস আর মিলছে না। বার্গেনে আসার পর থেকে একটি সমস্যা অনুভব করছি, আমাদের মতো পথচারীদের পথ চিনতে কোথাও ভুল হলে কাউকে খুঁজে পাওয়া ভার, যাকে জিজ্ঞেস করে ঠিক পথের সন্ধান মিলবে, এখনও এই একই সমস্যায় ভুগছি। বেশ খানিকটা সময় অপেক্ষা করে একজন পথচারীর দেখা মিলল। যাক, আবার এগুলাম। এবার কিন্তু পথ আর মসৃণ রইল না। বেশ খানাখন্দ আর উঁচু-নিচু পথ পাড়ি দিয়ে ঝরনার প্রায় কাছাকাছি চলে এলাম। এবার সিঁড়ি ভাঙার পালা, কতখানি সিঁড়ি ভাঙতে হবে তা অবশ্য নিচ থেকে বোঝার উপায় নেই। কেননা, বেশ ঘোরালো-প্যাচালো রাস্তা, সুতরাং জানতে হলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই হবে।

শুরুটায় যতটা সহজ মনে হয়েছিল, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকার পর আর তত সহজ মনে হচ্ছে না, ফারজানা তো মাঝপথেই রণেভঙ্গ দিল। আমি অবশ্য তখনো আশা ছাড়িনি। আমি আর সাবিত এগুতে থাকলাম... সিঁড়ি যেন অনন্তলোকের পথ ধরেছে। আমরাও যাচ্ছি মাঝে মাঝে একটু বিশ্রাম নিচ্ছি, আবার উঠছি। একটা সময় সিঁড়ি শেষ হলো, ঝরনার কলকলানিও বেড়ে গেল, ভাবলাম বুঝি গন্তব্যে পৌঁছেই গেছি, কিন্তু না, এ যেন মরীচিকা, এরপর বন্যপাহাড়ি পথ খাড়া, এবড়ো-থেবড়ো আর পিচ্ছিল ; কিছুটা এগিয়ে আর সাহস হলো না। এর মধ্যে দু-একজন ফিরতি পথিক পেলাম, তাদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, দিল্লি তখনও বহুদূর। এরপর আর না এগুনোটাই যুক্তিযুক্ত মনে হলো।

নিচে নেমে ফারজানার দিগি¦জয়ী হাসি দেখে পথের কষ্ট দ্বিগুণ বেড়ে গেল। এরপর কী করবো, তেমন কোনো পরিকল্পনা না থাকায় এমনি ঘুরে বেড়ালাম। অবশ্য এতেও কোনো লোকশান নেই। কারণ, ছোট্ট শহর বা গ্রাম, যাই বলি না কেন, এটি এতটাই সাজনো-গেছানো যে, হেঁটে বেড়াতে কোনো ক্লন্তি আসে না। শহরের ঠিক মাঝ বরাবার একটি খাল বয়ে গেছে, যার দু-ধার পাথর দিয়ে বাঁধানো, খালের পানি এতটাই স্বচ্ছ যে, তলা পর্যন্ত দেখা যায়। ইচ্ছে হলো এর একধারে বসে খালের পানিটা ছুঁয়ে দেখি, এগুতেই নজরে এলো নির্দেশনা- খালের বাঁধে বসা যাবে না আর কাছে গিয়ে পানি ছোঁয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাই একটু তফাতে থেকেই পানি আর মাছেদের হুটুপুটি দেখেই কিছু সময় কাটিয়ে দিলাম। হঠাৎই তখন মনে পড়ে গেল, আমাদের ‘বগা লেকে’র কথা, যেখানে বড়ো-বোড় অক্ষরে লেখা “এখানে নামা বা গোসল করা নিষেধ” কিন্তু কে শোনে কার কথা ! একদিন হয়ত ‘বগা লেকে’ আর পানি থাকবে না, থাকবে শুধু সাবান আর শ্যাম্পুর খোসা। বিদেশ-বিভুঁয়ে এ-রকম আতি সুন্দর কোনো জায়গা দেখলে মনটা মাঝে মাঝে বেশ খারাপ হয়ে যায়, না আমাদের এত সুন্দর কোনো পর্যটন স্পট নেই বলে আমরা আমাদের প্রকৃতির নির্মলতা উপলব্ধি করি না, উপরন্তু তাকে রুক্ষ বা নষ্ট না করা পর্যন্ত আমরা থামিও না।

এভাবেই কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে লোকালয়ে ঘোরাঘুরি শেষে আবার খাঁড়ির পধ ধরলাম, চলতি পথে একটি কিন্ডারগার্টেন চোখে পড়ল, ছোট্ট একটি স্থাপনা, আনেকটা বাংলো টাইপ আর অনেকখানি খোলা জায়গা, চারধারে কাঠের বেড়া, যে-কারণে সহজেই শিশুদের আনন্দমুখর পদচারণা আর হুল্লোড় দেখা এবং শোনা যাচ্ছিল। একটু সময় তাই এখানে থামতেই হলো, তাদের আনন্দের ছটা সাথে করে নিয়ে এলাম যার রেশ অনেকটা সময় ধরে সঙ্গী হয়ে রইল। যখন খাঁড়ির কাছে ফিরে এলাম, তখনও দুপুর হতে বেশ বাকি, তাই এখানে যে ওপেন এয়ার রেস্টুরেন্টগুলো রয়েছে তার একটিতে বসে পড়লাম টুকটাক কিছু খাবো বলে, তবে খাবার বলতে তো হয় মিষ্টি কিছু অথবা চিপস্জাতীয় কিছু। এছাড়া আর হালাল খাবার কোথায় ? সঙ্গে চা অথবা কফি। রোদ এখন বেশ চড়া, তাই আর বেশিক্ষণ এখানে থাকা গেল না, পাশে কিছু তাঁবু রয়েছে, যেগুলো আসলে অস্থায়ী স্যুভনির দোকান, গতদিন এ-দোকানগুলো দেখা হয়নি। তাই এ বেলা একটু ঢু-মেরে নিলাম। [চলবে]