গাদ্দাফির দেশে তার সুবর্ণ দিনে -শেখ নেছারুদ্দীন আহমদ

08 Jun 2021, 04:01 PM ভ্রমন শেয়ার:
গাদ্দাফির দেশে তার সুবর্ণ দিনে -শেখ নেছারুদ্দীন আহমদ

পর্ব-৩


আবার গাদ্দাফি

গাদ্দাফি ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশ রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে (জমহুরিয়া) রূপান্তরিত হয়। গাদ্দাফি তার নিজস্ব পদ্ধতির সমাজতন্ত্র প্রচলন করেন। নতুন নীতির নাম হয় ইসলামি সমাজতন্ত্র। মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। বিনা বেতনে শিক্ষালাভ এবং বিনা খরচে স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ তৈরি হয়। গৃহহীনদের গৃহদান শুরু হয়। খাদ্যে, বিদ্যুতে ভর্তুকি (Subsidy) দিয়ে স্বল্পমূল্যে পাওয়ার ব্যবস্থা হয়। গাদ্দাফির এইসব কর্মযজ্ঞে ক্ষেত্রবিশেষে নির্দয়তা নিষ্ঠুরতার ঘটনা কিছু ঘটেছে। একটা উদাহরণ হলো, বিত্তবানদের অনেক বাড়ির একটি বাড়ি তাদের জন্য রেখে সরকার অন্যগুলো নিয়ে গৃহহীনদের মাঝে বিতরণ করেছে। স¤্রাট ইদরিসের আত্মীয় ডা. খলিফা আমাকে বলেছিল তাদের তেইশটি ফ্লাটের বাইশটিই সরকার নিয়ে নিয়েছে। দাম পরিশোধ করেছিল কিনা জানা হয়নি। গাদ্দাফিকে উৎখাতের প্রচেষ্টায় একাধিকবার সামরিক অভ্যুত্থান হয়। এগুলো তিনি কঠোর হস্তে দমন করেন। বিদ্রোহীদের কাউকে উন্মুক্ত স্থানে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। অন্যান্য স্বৈরশাসকের মতো তিনি ভিন্নমতাদর্শী এবং বিরুদ্ধবাদীদের সহ্য করতেন না। তবে তিনি সাধারণ স্বৈরশাসক ছিলেন না। ছিলেন জনকল্যাণকামী স্বৈরশাসক। তার সম্পর্কে আমার পরিচিতদের কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে যা শুনেছিলাম তা ঠিক ছিল না। তৎকালে ত্রিপোলিতে কোনো ইংরেজি সংবাদপত্র ছিল না। টেলিভিশনেও বেশিরভাগ সম্প্রচার হতো আরবিতে। ঘন ঘনই গাদ্দাফির সুদীর্ঘ বক্তৃতা থাকত। তাছাড়া সংবাদমাধ্যম ছিল নিয়ন্ত্রিত। যারা বিদেশ থেকে এসেছেন তারা সাধারণত স্বীয় কার্য সম্পাদন, অর্থ উপার্জন এবং পারিবারিক কাজে ব্যস্ত থাকতেন। লিবিয়ার ইতিহাস এবং গাদ্দাফির অবদান নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। গাদ্দাফির সম্পর্কে তাদের ধারণা তৈরি হয়েছে শোনা কথা এবং গালগল্প থেকে। তাদের মতে গাদ্দাফি একজন রূঢ়, নিষ্ঠুর স্বৈরশাসক। তিনি স্বীয় নিরাপত্তার ব্যাপারে সবসময় অতি সচেতন। রাতে কবে কোথায় ঘুমান, কেউ জানে না। প্রতিরাতেই স্থান পরিবর্তন করেন।

সাতাত্তরের আগ পর্যন্ত গাদ্দাফির লিবিয়া ছিল প্রজাতন্ত্র (Republic) আরবিতে জমহুরিয়া। ইতোমধ্যে তিনি গ্রিন বুক (কেতাবুল আখদার) নামে তিনটি বই লিখেছেন। শাসনতন্ত্র সম্পর্কে তার নিজস্ব পদ্ধতির কথা এতে বলা হয়েছে। সাতাত্তর সালে তিনি দেশের নাম বদলালেন, নতুন শাসনতন্ত্র জারি করলেন। তিনি প্রচার করলেন এটা পৃথিবীতে শাসনতন্ত্রের তৃতীয় এবং সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতি। তার মতে পশ্চিমা গণতন্ত্র হলো বৃহত্তর পার্টির স্বৈরতন্ত্র। এরা সব সা¤্রাজ্যবাদী। এরা নিজ দেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্যান্য, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের সম্পদ লুটপাটে তৎপর। দ্বিতীয় পদ্ধতি কম্যুনিজম, এরা নিরিশ্বরবাদী। তাদের কিছু কার্যকলাপ যদিও তার পছন্দ। গাদ্দাফির পদ্ধতির নাম জামাহিরিয়া বা জনগণতন্ত্র (State of Mass)। জনসাধারণই হবে দেশের মালিক এবং দেশের শাসক। (যার কিছু অভিজ্ঞতা আমি অ্যামব্যাসিগুলোতে এবং ইউনিভার্সিটিতে পেয়েছি)। দেশের নতুন নাম হলো। সমাজতান্ত্রিক লিবিয়ান আরব জামাহিরিয়া (Socialist people’s libian ARAB Jamahiria)। তিনি গঠন করলেন ‘মৌলিক গণ সমিতি’ (Basic people’s congress)। যার শাখা হলো গ্রামে গঞ্জে, মিলফ্যাক্টরিতে, স্কুল, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বত্র। এরা শাসনে অংশগ্রহণ করবে, নানা নিয়ম নীতি এবং উন্নয়ন প্রস্তাবনা করবে। তাদের প্রস্তাবনা পাশ হবে বা বাস্তবায়ন হবে ‘সাধারণ গণ সমিতিতে’ (General people’s congress)। গাদ্দাফির কোনো পদবি থাকবে না। তিনি হবেন সবার ‘ভাই গাদ্দাফি’ ও পথপ্রদর্শক এবং পরামর্শক। বাস্তবে তিনি ছিলেন সব ক্ষমতার অধিকারী। বিরুদ্ধবাদীরা এবং সমালোচকেরা অপবাদ দিল জনসাধারণকে ক্ষমতার স্বাদ দেওয়ার অর্থ হলো স্বীয় ক্ষমতা আরো পাকাপোক্ত করা। কথাটা একদম মিথ্যা নয়। আমার মনে হয়েছে এই দেশে তার বৈপ্লবিক ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উন্নয়ন সাধনের জন্য গাদ্দাফির মতো নেতৃত্বের দরকার ছিল এবং এখনো আছে।

ইন্টার্নি নীতিমালা 

ডিপার্টমেন্টে অন্য এক ইউনিটের প্রধান ডা. আর.ডি. সিং। এই ভারতীয় ডাক্তার বিলাতে আমার সহপাঠী ছিলেন। ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান প্রফেসর একরাম প্রায়ই আমাকে এবং আর. ডি. সিংকে নিয়ে মিটিং-এ বসতেন অনুপযোগী সময়ে-দুপুর দেড়টার দিকে। তাতে আমাদের দুপুরের লাঞ্চে আসতে অনেক দেরি হতো, যখন সবাই খাওয়া শেষ করে চলে গেছে এমন সময়ে। মাঝে মধ্যে লাঞ্চ পেতামও না। আমাদের কোনো ইন্টার্নি ডাক্তার ছিল না। নতুন পাশ করা ডাক্তার, যাদের একবছর শিক্ষানবিশ রাখা হয় তাদের বলা হয় ইন্টার্নি। একদিন প্রফেসর একরাম বললেন, খুব শিগগিরই মিশর থেকে পাশ করা একজন ডাক্তার আসছে। এখানে ইন্টার্নশিপ করবে। তোমরা দুজন ইন্টার্নশিপের স্থায়ী বিধিবিধান (Rules and Regulation) লিখে ফেলবে। আমাদের ছাত্ররা (প্রথম ব্যাচ) শিগ্গিরই পাশ করে বের হবে, তখন যাতে নতুন করে আবার লিখতে না হয়। আমরা দুজন কয়েকদিনের পরিশ্রমে ও প্রচেষ্টায় একটা খসড়া তৈরি করলাম। যা প্রফেসর একরাম পছন্দ করলেন। ফ্যাকাল্টির ডিন খসড়াটির অনুমোদন দিয়ে মুদ্রিত অবস্থায় প্রকাশ করলেন কয়েকদিন পর সম্রাট ইদরিসের আত্মীয় ডা. খলিফা আমার ইউনিটে ইন্টার্নি হিসাবে যোগদান করল। খলিফা অতি ভদ্র এবং আজ্ঞানুবর্তী। তখনো আমার অর্ডারকৃত ব্যক্তিগত গাড়ি হাতে পাইনি। সান্ধ্য রাউন্ডের (Evening round) এর পর খলিফা তার গাড়িতে আমাকে হাসপাতাল থেকে ইউনিভার্সিটেতে এনে গেটে নামিয়ে দিত। তার ভিতরে প্রবেশের অনুমতি ছিল না।


রক্ষা পেল চৌহান

যোগদানের তিন মাসের মধ্যেই আমার ইউনিটে এক অঘটন ঘটল। হার্ট অ্যাটাকের (Myocardial Infarction) রোগীর অবস্থা খারাপের দিকে যাওয়ায় সিনিয়রকে কল (Call) করা হলো। সেদিন অন-ডিউটিতে ছিলেন ডা. চৌহান। তিনি এসে রোগীকে এমন একটা ওষুধ দিতে বললেন যা এই ক্ষেত্রে মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আধঘণ্টার মধ্যে রোগী মৃত্যুবরণ করল। এখবর ছড়িয়ে পড়ল সবখানে; কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছাতে দেরি হলো না। চারদিকে কানাঘুষা। চৌহান আমাকে বলল, অনেকেই কটাক্ষ করছে। বন্ধু, কবে তোমাকে লাল ঘরে (জেলখানায়!) দেখতে যাব! ভুল চিকিৎসার জন্য ডাক্তারকে জেলে পাঠানোর ইতিহাস এদেশে আছে। আমার একজন লিবিয়ান এবং আরেকজন প্যালেস্টিনিয়ান সহকর্মী বললেন, চৌহানের দেওয়া ডিগোক্সিনে (Digoxin) ভেনট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া (Ventricular Tachycardia) হয়ে রোগীর মৃত্যু ঘটেছে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। দুদিন পর আমার কাছে চিঠি এল, এই রোগীর মৃত্যুর কারণ জানিয়ে রিপোর্ট কর। রিপোর্ট হতে হবে বিস্তারিত এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানভিত্তিক। আমি পড়লাম উভয় সঙ্কটে। চৌহানকে সহজেই ফাঁসাতে পারতাম। কিন্তু তা কি উচিত হবে ! আবার তাকে রক্ষা করাও কঠিন। অনেক চিন্তা করে একটা পথ বের করলাম। আমি লিখলাম, ‘চৌহান যে ওষুধটা প্রয়োগ করেছিল সেটা ছিল স্বল্প মাত্রার। ওষুধ প্রয়োগের ২০-২৫ মিনিট পরে রোগীর মৃত্যু হয়। এই সময়ের মধ্যে ওষুধটা ‘অ্যাবজরপসসই’ (Absorption, আশোষণ = কোনো কিছু পাকস্থলিতে হজম হয়ে ক্ষুদ্রান্তের ঝিল্লির মাধ্যমে রক্তে প্রবেশ করা) হয়নি। অতএব, আমার মনে হয় ওষুধ প্রয়োগের সাথে রোগীর মৃত্যুর কোনো সংযোগ নেই। মৃত্যু হয়েছে দ্বিতীয় হার্ট অ্যাটাকে।’ আমার রিপোর্টে চৌহান রক্ষা পেল। এরপর যতদিন ত্রিপোলিতে ছিলাম, ভারতীয় ডাক্তারেরা আমাকে অত্যন্ত সম্মান ও সমীহ করত।

হাসপাতালের মেডিকেল ডিপার্টমেন্টের একজন সিনিয়র স্পেশালিস্ট প্রতিদিন নাইট কলে (Night Call) থাকতেন। আশ্চর্য ঘটনা, আমার কলের দিন আমি যখন শোবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি তখনই দেখা যেত অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার দরজায় হাজির। এ রুটিনের ব্যত্যয় ঘটেনি কোনোদিন।


বিজয় দিবস

এল ষোলই ডিসেম্বর। বাংলাদেশ অ্যামবাসি ঘটা করে উদ্যাপন করবে ষোলোই ডিসেম্বরের অনুষ্ঠান। নাচ, গান, বক্তৃতা, কমিক সব থাকবে। আমন্ত্রণ জানানো হলো ত্রিপোলিবাসী সব বাংলাদেশিকে। কে কীসে অংশগ্রহণ করতে চান তাও জানাতে বলা হলো। বক্তৃতায় আমার নাম রাখার জন্য সেকেন্ডে সেক্রেটারি ফয়েজুর রহমান চৌধুরীকে বলে দিলাম।

অনুষ্ঠানের জন্য বড়ো হলঘর ভাড়া করা হয়েছে। দর্শকশ্রোতায় হলঘর কানায় কানায় পূর্ণ। কোরআন তেলওয়াতের পর রাষ্ট্রদূতের অভ্যর্থনা ভাষণ। তার পরেই বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমাকে ডায়াসে আসার অনুরোধ জানানো হলো। বিদেশে নানা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন পরিবেশে অনেকবার বক্তৃতা দিতে হয়েছে। এতবড়ো সমাবেশে এই প্রথম। আমি বাংলাদেশের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের বহু বিষয় নিয়ে এবং এই ভাগ্যান্বেষী প্রবাসীদের দেশের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিবরণ দিয়ে ৩০-৩৫ মিনিট ধরে কথা বললাম এবং অ্যামবাসির এই অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে বক্তৃতা শেষ করলাম। তারপর তুমুল করতালি, চললো অনেকক্ষণ ধরে। নেমে এসে সিটে বসতেই আমার বন্ধু আর.ডি. সিং (ভারতীয়, এই অনুষ্ঠানে এসেছিল) বললো, তুমি এমন বক্তৃতা দিতে পার ! আমি চোখ বন্ধ করে তোমার বক্তৃতা শুনছিলাম, মনে হচ্ছিল, শেখ মুজিবের বক্তৃতা শুনছি ! অনুষ্ঠানে শেষে বাংলাদেশি অনেকেই বললেন আপনার বক্তৃতা অত্যন্ত সুন্দর হয়েছে। পরে মোমিনুল হক আমাকে বলেছিলেন, অনেকেই তাকে জিজ্ঞাসা করেছে, উনি কি রাজনীতি করতেন, না রাজনীতি করবেন ! এরপর থেকে আমি অ্যামব্যাসির প্রতিষ্ঠিত বক্তা হয়ে গেলাম। যেকানো অনুষ্ঠান হলে আমাকে প্রধান বক্তা হিসেবে রাখা হতো।

অনুষ্ঠানে বেশকিছু দেশাত্মবোধক গান হলো। তন্ময় হয়ে শুনলাম। যেন সেই স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধদিনে ফিরে গেলাম। একজন নারী নৃত্য পরিবেশন করলেন। নৃত্যে তার পারঙ্গমতায় কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু বিপুলদেহী হওয়ায় আশপাশ থেকে টিপ্পনি কানে আসতে লাগলো, মঞ্চ যে ভেঙে পড়বে ! তিনি হয়ত এককালে ভালো নৃত্যশিল্পী ছিলেন ! কমিক পরিবেশন করলেন আমার প্লেনের সহযাত্রী ডা. বারি। তার কমিকের প্রধান চরিত্র ‘ফটিক’। পরে অনেক অনুষ্ঠানে তার কমিক পরিবেশন করতে দেখেছি, সবখানেই প্রধান চরিত্র ‘ফটিক’। অনেকেই রহস্য করে তাকে ‘ফটিক ডাক্তার’ বলতো ! [চলবে]

লেখক : প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ