ইউরোপের ১৫০ দিন : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

19 Jul 2021, 12:58 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

পর্ব ৮

ফ্লম শহরটা দেখতে যেমন অনেকটা সুইজারল্যান্ডের মতো মেজাজ-মরজি, দামে ও মানেও তাই। স্যুভেনির-এর দোকানে ঢুকেছি যদি কোনো স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে যেতে পারি কিন্তু দাম শুনে শুধু যে চক্ষু চড়কগাছ তাই নয়, মাথাও ভনভন করে ঘোরার জোগাড় তাই চোখের দেখাই সার। যাই হোক, আধুনিক ও প্রাচীনের এই সমাহার দেখার সুযোগ পাওয়াও কম কথা নয়। এদিকে বেলা দ্বি-প্রহর, হাঁটাহাঁটিতে ক্ষুধাও লেগেছে, তার ওপর আমাদের ফেরার সময়ও হয়ে এলো, তাই চট-জলদি কিছু খেয়ে বাক্শো - পেটরা নিয়ে আমরা বাস-স্ট্যান্ডের দিকে রওনা হলাম। বাস স্ট্যান্ডে প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পরও আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাসের হদিস মিলল না ; এমন তো হওয়ার কথা নয়, তিনটার বাস সাড়ে তিনটায়ও আসেনি। একসময় আমরা বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম, আমাদের কোনো ভুল হলো না তো ! কেননা, নরওয়ের স্বাভাবিক মেজাজের সাথে এটা ঠিক মিলছে না। অবশেষে বাসের দেখা মিলল, জানা গেল টেকনিক্যাল প্রবলেম। অবশ্য এখানে টেকনিক্যাল শব্দের ব্যবহার আরও বেশি টেকনিক্যাল, তাই আর বিস্তারিত জানার সুযোগ রইল না, চেষ্টাও করলাম না।

শখের দাম লাখ টাকা এটা আমাদের দেশের অতি প্রচলিত একটি প্রবাদ। নরওয়ে এসে জানলাম পছন্দের দামও কম না। বাস বা ট্রেনের টিকেট কাটার সময় যদি পছন্দমতো সিট চান তাহলেই ভাড়া প্রায় দ্বিগুন হয়ে যাবে। কে যায় আর শুধু শুধু এতগুলো অতিরিক্ত পয়সা খরচ করতে ? তাই আমরা শুধু টিকেট কেটেছিলাম, সিট বাস কর্তৃপক্ষ র‌্যানডমলি সিলেক্ট করে দিয়েছে। যদিও মনে ক্ষীণ আশা ছিলো বাসে যাত্রী বরাবরের মতো অর্ধেকেরও কম থাকবে এবং আমরা মোটামুটি পাশাপাশি বা কাছাকাছি বসতে পারব। কিন্তু না, সে আশায় গুড়েবালি আমরা চার জন প্রায় চার প্রান্তে, অবশ্য খুব বেশিক্ষণ এ অবস্থা থাকেনি অথবা থাকলেও খুব একটা ক্ষতি বোধহয় হতো না। কেননা, বাস চলতে শুরু করতেই আমরা পথের সীমাহীন সৌন্দর্যে হারিয়ে গেলাম।

এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে আমি আর ফারজানা হাঁটতে  হাঁটতে গির্জা অবিধি পৌঁছে গেলাম

প্রচলিত আছে, এটি  জলদস্যুদের নির্মিত গির্জা

ফ্লম থেকে বোধকরি বিকাল পৌনে চারটার দিকে রওনা করেছিলাম, বারগেনে পৌঁছুতে পৌঁছুতে প্রায রাত আটটা বেজে গেল, যদিও সূর্যের আচরণে তখনো সন্ধে বলেই ভ্রম হয়। বাস আমাদের বারগেনের সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড অবধি পৌঁছে দিল, তারপর যথারীতি প্রিয় বিবান (লাইট ট্রেন)। হোস্টেলে ফিরে হঠাৎ মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল, মনে হলো যেন বাড়ি ফিরেছি। মানুষ বোধহয় স্বভাবগতভাবেই নীড় পছন্দ করে। মুখে যাই বলি না কেন, একটা সময় নিজের ঘরে ফিরতে মন অস্থির হবেই। আমার অস্থায়ী বনবাস জীবনে ফ্যানটপের এই এক কামরার ঘরটিই আমার একান্ত নিজস্ব ঠিকানা, হোক না সে মাস কয়েকের জন্য। ফ্যানটপ নামটি আগে কখনো বলেছি কি না মনে করতে পারছি না, এখন যখন মনে পড়ল একটু পরিচয় দিই। বারগেন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের অফিসিয়াল রেসিডেন্ট যে জায়গায় অবস্থিত সে জায়গাটির নাম ফ্যানটপ। এছাড়া আরো একটি জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে থাকবার ব্যবস্থা আছে। আমি জায়গাটির নাম মনে করতে পারছি না। ফ্যানটপে স্টুডেন্ট হাউজিং ছাড়াও আরো একটি হাউজিং আছে, সেটি হচ্ছে ওল্ড হোম। একদম প্রায় মুখোমুখি দুই বৈপরীত্যের অবস্থান। একদল সারাক্ষণ কোলাহল আর কর্মচাঞ্চল্যে মেতে থাকে আরেক দল সকল চঞ্চলতাকে ছুটি দিয়ে যেন নিজেরাই ছুটির প্রহর গুনছে। আগেই বলেছি, বারগেনের বাড়িগুলো বেশ সুন্দর আর গোছানো ; সেই তুলনায় আমাদের স্টুডেন্ট হাউজিংয়ের পুরোনো বিল্ডিংটি আক্ষরিক অর্থেই বেশ পুরোনো যা বারগেনের অন্যান্য স্থাপনার সাথে ঠিক খাপ খায় না। তখনো পর্যন্ত আমি আমার প্রতিবেশী ওল্ড হোম সম্পর্কে জানতাম না, শুধু চলতি পথে ছিমছাম লাল রঙের লম্বাটে ধাচের দোতলা বিশাল বাড়িটি দেখে ভালো লাগত। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, এটি হয়ত কোনো রেসিডেন্টশিয়াল কোয়াটার হবে। বেশ খানিকটা জমি নিয়ে তৈরি বাড়িটিতে প্রতিটি কামরার সামনে ঝুলবারান্দা আর নিচে দেয়াল ঘেঁষে নানান রঙের ফুলের বাগানের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে তুলেছে। ভাবছেন হঠাৎ এই ওল্ড হোম নিয়ে কেন পড়েছি। বলছি, একদিন আমি আর ফারজানা (বারগেনপ্রবাসী বাঙালি, যার কথা আগেও বলেছি) হাঁটতে হাঁটতে ওই বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমি বাড়িটিতে কারা থাকেন জানতে চাইলে ফারজানা জানায় এটিও আমাদের মতোই হোস্টেল, যেখানে সিনিয়র সিটিজেনরা থাকেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একা থাকেন, নিজেদের কাজ নিজেরাই করেন, তবে কেউ অসুস্থ হলে সরকারের তরফ থেকে নার্স বা সহায়িকা দেওয়া হয়। অনেক সময় এমনও হয়, কেউ হয়ত হঠাৎ এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে, নিজের অসুস্থতার কথা জানানোরই সুযোগ পেলেন না। তবে, নিয়ম করে হোম কর্তৃপক্ষ ফোন করে খোঁজখবর রাখেন। যদি কেউ ফোনে রেসপন্স না করেন তবে কর্তৃপক্ষ প্রতিনিধি বা পুলিশ পাঠান। এমন ঘটনা এখানে হামেশাই ঘটে যে, হোম কর্তৃপক্ষ ফোন করে পাচ্ছেন না, খোঁজ নিতে এসে দরজা খুলে শবদেহ বের করেন। 

কাঠ আর রড দিয়ে গির্জা বানানো হয়েছে

আঁধার  ঘন হয়ে আসায় কেন যেন একটু গা ছমছম  করছিল

আমি নরওয়েতে আসার পর আমার ইংল্যান্ডপ্রবাসী বন্ধু মাধুরীর সঙ্গে যোগাযোগটা অনেক বেড়ে গেল। মাধুরী আমার হোম সিকনেসের কথা ভালো করেই জানে ; আর এও জানে যে, আমি সচারাচর বাজারঘাট বা রান্নাবান্নার ধার দিয়ে যাই না। তাও তো আমাদের দেশে কোন জিনিসটা কোথায় কিনতে পাওয়া যায়, কোন জিনিসের বিকল্প কী হতে পারে তা আমাদের জানা, কিন্তু এই বিদেশ-বিভূঁয়ে যেখানে ভাষাগত একটা বাধা তো রয়েছেই তার ওপর নরওয়েজিয়ানরা তাদের নিজেদের ভাষাটাকে সর্বজনীন ব্যবহার করায় অর্থাৎ পণ্যের মোড়কের গা থেকে শুরু করে সকল পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এবং পাবলিক স্থাপনার নামও তারা একমাত্র নরওয়েজিয়ান ভাষাতেই নির্দেশ করে থাকে। সুতরাং ঘর-গৃহস্থালির অতি প্রয়োজনীয় কোনো জিনিস কোথায় পাবো এই ভেবে মাঝে মাঝে দিশেহারা হতে হতো। একটু বলি, হয়ত আমার ব্লিচিং-জাতীয় কোনো কিছু প্রয়োজন অথবা নিত্যদিনকার ঘর পরিষ্কারের ঝাড়– তা কোথায় পাবো বা তার বিকল্প কী তা খুঁজে পাওয়া সত্যিই জটিল বিষয় হয়ে দাঁড়াল। 

বারগেনে তানিয়া শুরু থেকেই আমাদের ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিল। এর সঙ্গে মাঝে মাঝেই মাধুরী আমাকে ফোনে ফোনে বিভিন্ন টিপস্ দিত যেন আমার প্রবাসে দিন যাপন সহজ হয়ে ওঠে। এখানে হঠাৎ মাধুরীর কথা বলার অবশ্য অন্য একটি কারণ রয়েছে আর তা হলো, আমি বারগেনে আসার পর থেকে মাধুরী প্রায়ই বলত, ‘তুমি ইউরোপে সেটেল হওয়ার চেষ্টা করো না’। আমি তাকে বলেছিলাম, বারগেনে আসার পর আমার নিজের জন্য যেমন মায়া হয় তেমনি বারগেনবাসীর জন্যও মায়া হয়। নিজের জন্য মায়া শুনতে কেমন লাগছে না। ওই যে বলছিলাম, মুখোমুখি বিপরীত মেরুর অবস্থান - একদল খুব প্রাণচঞ্চল আরেক দল অনেকটাই নিষ্প্রভ, ছায়া ছায়া যাদের জীবন। আসলে দিন শেষে তারা দু’দলই ভীষণ একা। যতক্ষণ কাজ আর বন্ধুবেষ্টিত ততক্ষণই তাদের জীবনে আনন্দ, যখন নীড়ে ফেরার সময় হয়, অধিকাংশই খুব বিষাদ নিয়ে ফেরে। কেননা, ঘরে তাদের জন্য কেউ বা কোনো আনন্দ অপেক্ষা করে না। তারা প্রত্যেকেই যেন একেকটা বিছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা, আর সেখানে আমার নিজেকেও কেমন যেন নির্বাসিত মনে হতো। 

ফ্যানটপের একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনার কথা না বললেই নয়। আমরা বার্গেনে যাওয়ার আগেই এ সম্পর্কে জেনে ছিলাম, একটি প্রাচীন গির্জা। গির্জাটির নাম স্টিভস চার্চ। প্রচলিত আছে, এটি জলদস্যুদের নির্মিত গির্জা। এক বৃষ্টিভেজা স্যাঁতসেঁতে বিকালে আমি আর ফারজানা (আমার কলিগ) দোকান থেকে দুটো কফি কিনে হাঁটতে হাঁটতে গির্জা অবধি পৌঁছে গেলাম। বেশ ঘন বনের মাঝ দিয়ে পথ, নরওয়ের হিসেব অনুযায়ী সূর্য অস্ত যেতে এখনো ঘণ্টা দুই বাকি কিন্তু পথ খানিকটা অন্ধকারই মনে হচ্ছে, যেন হঠাৎ করেই আমরা টাইম মেশিনে কয়েকশ’ বছর পেছনে চলে গেছি। ছোট্ট একটি গির্জা স্থাপত্যশৈলী বেশ নান্দনিক। তারপরও কোথায় যেন একটু ভীতিকর রহস্য ঘাপটি মেরে আছে, হয়ত-বা জানা ছিল যে এটি জলদস্যূদের সময়কার এবং তাদেরই উদ্যোগে নির্মিত। কাঠ আর রড দিয়ে গির্জাটা বানানো হয়েছে। সম্ভবত জাহাজের নির্মাণ সামগ্রীই এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। গির্জার পেছনেও কিছু ছোটোখাটো স্থাপনা ছিল কিন্তু আঁধার ঘন হয়ে আসায় কেন যেন একটু গা ছমছম করছিল, তাই আর সেদিকে গেলাম না। ফরজানাও ফিরে আসার জন্য তাড়া দিচ্ছিল। আমরা ছাড়া আরও দু-একজন দর্শনার্থী সেখানে ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে দর্শনার্থীরা নির্দিষ্ট ফি-এর বিনিময়ে        গির্জার ভেতরে ঢুকতে পারেন, আমাদের অবশ্য তা জানা ছিল না, জানা থাকলে হয়ত আমরাও যেতাম। আক্ষেপ রয়েই গেল, যদিও   আরেক দিন হাতে সময় নিয়ে বেলা থাকতে থাকতে যাব, এমন প্রত্যাশা নিয়ে ফিরে এলাম।