বাংলাদেশের নিউজ ইন্ডাস্ট্রিকে বিবিসি সিএনএন-এর পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই -তামান্না মৌ

24 Aug 2021, 12:25 PM সংবাদ উপস্থাপক শেয়ার:
বাংলাদেশের নিউজ ইন্ডাস্ট্রিকে বিবিসি  সিএনএন-এর পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই  -তামান্না মৌ

সুন্দর উপস্থাপনা, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এবং স্পষ্ট উচ্চারণের কারণে সব শ্রেণির দর্শকের কাছে পরিচিত মুখ তামান্না মৌ। পেশায় সরকারি চাকরিজীবী হলেও সংবাদ উপস্থাপনাকে গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন তিনি। তামান্না মৌ-এর বিস্তারিত আনন্দভবনের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো...

আনন্দভুবন : কেমন আছেন ?

তামান্না মৌ : আলহামদুল্লিলাহ, ভালো আছি।

আনন্দভুবন : উপস্থাপনা পেশায় আসার গল্পটা জনাতে চাই-

তামান্না মৌ : আসলে ছেলেবেলা থেকেই উপস্থাপনা পেশায় আসার আমার একটা স্বপ্ন ছিল। শখও বলতে পারেন। আমি ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী ছিলাম। স্কুলের সমস্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক অথবা অন্য যেকোনো অনুষ্ঠান সবকিছুতেই কাজ করার একটা আগ্রহ ছিল। স্কুলের অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করে কিছুটা অভিজ্ঞতা অর্জন করি। শৈশব থেকেই রবীন্দ্রসংগীত গাইতাম। ছেলেবেলার সেই ইচ্ছে বা আগ্রহ থেকেই আমি বাংলাদেশ ইনস্টিট্যুট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় কোর্স করি। সেই কোর্স করার পর আমি বিভিন্ন চ্যানেলে অডিশন দিই সংবাদ উপস্থাপনের জন্য। বেশ কয়েকটি চ্যানেলে সুযোগও পেয়ে যাই। তার মধ্যে আমি ২০০৬ সালে এটিএন বাংলায় যোগ দিই। এবং একই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ ১৫ বছর নিউজ পড়ে আসছি। এই হলো উপস্থাপনা পেশায় আসার গল্প।

আনন্দভুবন : পরিবার থেকে কি কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন ?

তামান্না মৌ : হ্যাঁ, পরিবার থেকে সম্পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছি। বিশেষ করে আমার মা সবসময় চাইতেন যে, আমি কণ্ঠ অনুশীলনের কোনো কাজ করি। আসলে আমি আমার আম্মার অনুপ্রেরণায়ই সংবাদ উপস্থাপক হয়ে উঠেছি। আমার মা নিজেও দীর্ঘ ৩৫ বছর একটি বেসরকারি কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। শেষে উনি ভাইস প্রিন্সিপাল হয়ে অবসর নেন।

আনন্দভুবন : একজন ভালো সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য কী কী গুণ থাকা দরকার বলে আপনি মনে করেন। কোন বিষয়গুলো জানা প্রয়োজন ?

তামান্না মৌ : একজন ভালো সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য অনেকগুলো গুণ এবং কলাকৌশল জানা দরকার। আমি যেহেতু সংবাদ উপস্থাপনার বিভিন্ন ক্লাশও নিয়ে থাকি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। আমার অনেক ছাত্রছাত্রী আছে, যারা আমার কাছে শিখে চ্যানেলে খবর পড়ছে। যখন দেখি তারা আমার কাছে শিখে কোনো চ্যানেলে খুব সুন্দরভাবে খবর পড়ছে তখন আমি আরো বেশি উৎসাহ পাই। একজন ভালো উপস্থাপক হতে হলে প্রথমেই তাকে উচ্চারণ, সংবাদ সম্পর্কে জ্ঞান, কারেন্ট অ্যাফেয়ারস মানে সারাবিশ্বে এই মুহূর্তে কী ঘটছে এবিষয়ে তার জানা থাকতে হবে এবং নিজেকে সবসময় আপটুডেট রাখতে হবে। তারপর তার উপস্থাপনার কলাকৌশল, পর্দায় আসার পর তার শারীরিক ভাষা, সংবাদ উপস্থাপনার অভিব্যক্তি, এক্সপ্রেশন। একেকটা নিউজের এক্সপ্রেশন কিন্তু একেক রকম। যদি আধা ঘণ্টা বা একঘণ্টার নিউজ পড়ি সেখানে একেকটা আইটেমের এক্সপ্রেশন একেক রকম দিতে হয়। সবগুলো নিউজের কনটেন্ট এক রকম নয়। কনটেন্ট বুঝে আমাদের তাৎক্ষণিকভাবে মূল্যায়ন করতে হয়। আসলে কোন এক্সপ্রেশনে আমি একটা স্যাড নিউজ পড়ব আর কোন এক্সপ্রেশনে আমি হ্যাপি নিউজ পড়ব। এক্সপ্রেশনটা আমি খুব ইমপোর্টেন্ট মনে করি এবং সেইসঙ্গে মেকআপ-গেটআপ। আমাকে এক গুরুজন বলেছিলেন তুমি যখন স্ক্রিনে যাবে তখন স্ক্রিন জ্বলজ্বল করবে। অর্থাৎ স্ক্রিনে আমি যখন আসব তখন অন্য কোনো চ্যানেলে আর কোনো দর্শক যাতে সুইস ওভার না করতে পারে। নিজেকে এমনভাবে আত্মবিশ^াসের সাথে উপস্থাপন করতে হবে, দর্শক যাতে আমার চ্যানেল থেকে রিমোট টিপে অন্য চ্যানেলে চলে না যায়। সে জন্য আমাকে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে এবং সেই আকর্ষণটা কিন্তু ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ। শুধুমাত্র সাজগোজ এবং একটা সুন্দর শাড়ি পরে নিউজ পড়লাম সে রকম বিষয় নয়। অর্থাৎ আকর্ষণটা হচ্ছে ব্যক্তিত্বের আকর্ষণ যে আকর্ষণের টানে দর্শক আমার নিউজ দেখবে। আসলে এটা একটা আর্ট। এই আর্টটা একদিনে কেউ অর্জন করতে পারে না। দীর্ঘদিনের চর্চার মাধ্যমেই এটা অর্জন করতে হয়। আনন্দভুবন : প্রথম সংবাদ পাঠের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই-তামান্না মৌ : প্রথম সংবাদ উপস্থাপন করি ২০০৬ সালে। ওটা ছিল অক্টোবর মাস। আমার মনে আছে বিকেল ৫টার সংবাদটা আমি পড়েছিলাম। প্রথমদিন অনএয়ারে আমার বাবার কিনে দেওয়া শাড়ি পরে গিয়েছিলাম। সংবাদ উপস্থাপনা করা উপলক্ষে বাবা আমাকে শাড়িটা কিনে দিয়েছিলেন। সেই শাড়ি পরে আমি প্রথম সংবাদ পড়লাম। আর প্রথম দিন সবারই একটু নার্ভাস লাগে। আমারও একটু লেগেছিল। তারপরও আমি চেষ্টা করেছি খুব কনফিডেন্টলি উপস্থাপন করতে। এবং পেয়েছিলামও। এখন তো অনেক চ্যানেল। আমাদের সময় এত চ্যানেল ছিল না। এত সংবাদকর্মীও ছিল না। আমরা যারা ১৪-১৫ বছর যাবৎ নিউজ ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করি আমাদের যে গ্রুমিং, আমাদের যে ব্যাকগ্রাউন্ড মোটকথা আমরা যেরকম উপস্থাপনাকে আন্তরিকভাবে ও গুরুত্বের সাথে নিয়েছি বর্তমান প্রজন্ম আমার মনে হয় সেরকম গুরুত্বের সাথে হয়ত নিচ্ছে না। 

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনা পেশাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন ?

তামান্না মৌ : আমি বলব, সংবাদ উপস্থাপনা একটা নবেল প্রফেশন। এই প্রফেশনে যারা আসে তাদের আসলে নিবেদিতপ্রাণ হতে হয়। এই যে, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারির সময়ে সব কিছু থেমে থাকলেও সংবাদ উপস্থাপনা কিন্তু থেমে থাকে না। সংবাদ উপস্থাপকদের কিন্তু ঠিকই তাদের টিভি স্টেশনে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও সংবাদ উপস্থাপন করতে হয়। কাজেই আমি মনে করি ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধাদের আমরা যেমন সম্মান প্রদর্শন করি তাদের উপর আস্থা রাখি তেমনি সংবাদ উপস্থাপকদের প্রতি সম্মান এবং আস্থা রাখা উচিত। কারণ, আমরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফ্রন্ট লাইনারদের মতো সংবাদ উপস্থাপন করে সবাইকে খবরটা জানাই। দেশ বিদেশে যত ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটছে, সেটা সবার আগে আমরাই পৌঁছে দিই দর্শকের কানে।

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপন করতে গিয়ে কোনো বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন কখনো ?

তামান্না মৌ : সংবাদ উপস্থাপন হচ্ছে সরাসরি সম্প্রচার। এখনে রেকর্ডিং করে প্রচারের কোনো অপশন নেই। টেকনিক্যাল প্রোবলেম পাশাপাশি মাঝে মাঝে অন্য প্রোবলেমও হয়। তবে একবার মিরাকেল একটা ঘটনা ঘটেছিল সন্ধে সাতটার নিউজ পড়ার সময়। এটা ৭-৮ বছর আগের কথা। সে সময় ভূমিকম্পের খুব প্রকোপ ছিল। ঘন ঘন ভূমিকম্প হতো ঢাকা শহরে। তো খবর পড়ার সময় হঠাৎ দেখি স্টুডিও কাঁপছে। আমাদের স্টুডিওটা ৮তলায়। খবরটা যেহেতু লাইভ হচ্ছে তাই আমাকে ভয়ের মাঝেও খুব ঠান্ডা মাথায় খবর পড়েই যেতে হলো। এটা আসলে এমন একটা পারফর্মিং আর্ট, এখানে পিছিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ‘শো মাস্ট গো অন’ লাইভ আমাকে পারফর্ম করেই যেতে হবে। কাজেই ভূমিকম্পের মতো যেকোনো দুর্যোগেও আমার যতক্ষণ পড়ার অ্যাবিলিটি থাকে ততক্ষণ পড়ে যেতেই হবে। আসলে ওই সময়টায় অবশ্যই ভয় এবং আতঙ্ক কাজ করছিল এই ভেবে যে ভূমিকম্পটা খুব বেশি মাত্রায় হবে কি না, এটা আমাদের জন্য বড়ো ধরনের বিপর্যয় বয়ে আনবে কি না। এটা ভাবছি আর সংবাদ পাঠ করছি। এটা অবশ্যই সংবাদ উপস্থাপনাকালীন আমার জীবনের বিব্রতকর একটা ঘটনা।

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনার ওপর আলাদা কোনো প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কী ?

তামান্না মৌ : আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টর্স করি ইংরেজিতে। পরবর্তীসময়ে প্রফেশনে এসে লন্ডনের ব্রুনেল ইউনিভার্সিটি থেকে মিডিয়া অ্যান্ড কম্যুনিকেশনের ওপর সেকেন্ড মাস্টার্স করি। এটা ২০১৮ সালে। আমার থিসিসের বিষয়বস্তুই ছিল সংবাদ উপস্থানের কলাকৌশল। আমি নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এডুকেশনের ওপর আরেকটা মাস্টার্স করছি। এটা হচ্ছে আমার তৃতীয় মাস্টার্স। 

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনার পাশাপাশি অন্য কোনো পেশায় যুক্ত আছেন কী ?

তামান্না মৌ : হ্যাঁ, আমার মেইন প্রফেশন হচ্ছে সরকারি চাকরি। আমি ২৭তম বিসিএস দিয়ে এডুকেশন সেক্টরে কাজ করছি। এই মুহূর্তে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত। সরকারি চাকরির বয়স ১২ বছর পার হয়ে গেছে। চাকরির আগে থেকেই আমি সংবাদ উপস্থাপনায় আছি। সংবাদ উপস্থাপনাকেও আমি পেশা হিসেবে নিয়েছি।

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনা নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী ?

তামান্না মৌ : সংবাদ উপস্থাপনা নিয়ে ভবিষ্যতে অনেক দূর যেতে চাই। সেই সাথে বাংলাদেশের সংবাদ ইন্ডাস্ট্রিকে বিবিসি, সিএনএন-এর পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই। সেইরকম উপস্থাপক আমরা তৈরি করব এটা আমার স্বপ্ন।

আনন্দভুবন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

তামান্না মৌ : আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। 

সাক্ষাৎকার : শহিদুল ইসলাম এমেল