ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

24 Aug 2021, 02:59 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

পর্ব - ৯

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

নরওয়ের দিন-যাপন মাঝে মাঝেই আমার কাছে কেমন একটা একঘেয়েমি মনে হয়। প্রায়শ মেঘলা আকাশ, যখন-তখন বৃষ্টির আনাগোনা, সঙ্গে প্রচন্ড শীত তো রয়েছেই। যদিও এখনো শরৎ কাটেনি ; তবুও, রৌদ্রজ্জ্বল দিন এখনে বিরল। আর আমরা যারা বছরের প্রায় দশ মাসই সূর্যের প্রখরতা দেখে অভ্যস্ত তাদের কাছে এরকম আঁধার আর লাগাতার বৃষ্টিভেজা প্রকৃতি খুব একটা ভালো লাগার কথা নয়। যারা বৃষ্টিবিলাসী তারা হয়ত মনে মনে আমাকে ধিক্কার দিচ্ছেন। তাদের বলি, এ কিন্তু আমাদের ‘এসো নীপবনে, ছায়াবীথি তলে / এসো করো স্নান নবধারা জলে’ টাইপ বৃষ্টি না। এ বৃষ্টি অনেকটা গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো। একে তো শীত, আর বৃষ্টি যে তার তীব্রতা বাড়াবাড়ি রকম বাড়িয়ে দেয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে ওই যে বলে, বিধাতা কাউকে ষোলকলা পূর্ণ করে দেন না। যদি তাই হতো তবে আলাদা করে স্বর্গ লাভের আর আকাক্সক্ষা থাকত কি ? ভাবছেন এ আবার কি, প্রকৃতির চলন-বলনের কথার মাঝে আবার স্বর্গ-নরক এলো কোথা থেকে ? নরওয়ে সম্পর্কে বোধকরি পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষের ধারণা যে, এটি প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন স্যাঁতসেঁতে প্রকৃতির একটি দেশ। কিন্তু পর্যটকদের জন্য যে এর এত চমৎকার একটি প্রাকৃতিক আবহ আছে, সঙ্গে রয়েছে সুশাসন আর সুপ্রশাসনের আন্তরিক যত্ন , যা প্রকৃতি ও সমাজকে সকলের জন্য নিরাপদ করে তুলেছে, নিজ অভিজ্ঞতা থেকে উপলদ্ধি না করলে বোধহয় জানাটা পূর্ণতা পেত না। এ পর্যন্ত নরওয়ে নিয়ে যা যা লিখেছি তার সম্ভবত শতকরা ৮০ ভাগই এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে। অবশ্য এর প্রকৃতি এতই সুন্দর যে, মুগ্ধতা থেকেই এ সম্পর্কে বেশি করে বলা। আজ তবে প্রকৃতিপ্রসঙ্গ থাক, মানুষ আর মনুুষ্যসমাজের কথা হোক... 

আমরা যে শহরটাতে আমাদের অস্থায়ী আস্থানা গেড়েছি সেই বার্গেনের জনসংখ্যার একটি বড়ো অংশ শিক্ষার্থী, যার আবার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ভিনদেশি। বার্গেন ইউনিভার্সিটিতে বেশ কিছু কোর্সে এক্সচেঞ্জ এডুকেশনে এই ভিনদেশি শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়ে থাকে, যেমন আমরা পাবলিক পলিসি অ্যান্ড গভর্নেন্স কোর্সের একটি মাত্র সেমিস্টার, যার স্থিতি ৫ মাস, তাতে অংশ নিতে বার্গেনে এসেছি। তেমনি এসেছে ঘানা, উগান্ডা, ইথোওপিয়া, নাইজেরিয়া, আমেরিকা, পাকিস্তান, জার্মানি, সুইডেন ইত্যাদি নানাদেশ থেকে। সত্যিই এ যেন ভিন্নমত আর দর্শনের এক চমৎকার সহবস্থান। মাঝে মাঝেই ক্লাসের ফাঁকে শিক্ষার্থীদের আলোচনায় নিজ নিজ দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি আর সমাজব্যবস্থার পোস্টমর্টেম হতো। এ কাজে আবশ্য অগ্রণী ছিল ইথোওপিয়ার ইমানওয়েল। পরে আবশ্য জেনেছি, সে নিজ দেশে রাজনীতির প্রতিহিংসার শিকার হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। তাই হয়ত নরওয়ের এই চমৎকার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিম-ল তাকে মাঝে মাঝেই তার দেশের অসুস্থ রাজনীতির প্রতি ক্ষুব্ধ করে তুলত, যার বহিঃপ্রকাশ শুধু আড্ডাতেই নয়, ক্লাসে তার করা বিভিন্ন প্রশ্নেও ফুটে উঠত।

ক্লাসের কথায় আসি, সাপ্তাহে তিনদিন ক্লাস শুক্র, সোম আর বুধবার। আগেই বলেছি, ক্লাস করা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খুব একটা মাথা ব্যথা নেই কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে তাদের কড়াকড়ি রীতিমতো আমাদের কাছে বাড়াবাড়িই মনে হয়েছে। অবশ্য তা না হলে নির্দিষ্ট সময়ে সেমিস্টার শেষ করাও কঠিন হয়ে যেত। ইতোমধ্যে আমরা আমাদের অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে কাজ শুরু করেছি। শুরুতে ভেবেছিলাম, এ আর এমন কী ? দু’জনের গ্রুপ, সাবজেক্ট প্রতি একটা করে আর্টিক্যালের রিভিউ করতে হবে। হাতে সময় আছে, আস্তে-ধীরে ঠিক করে নিতে পারব। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, এ যেন ছোটোখাটো রিসার্স পেপার, বিভিন্ন রেফারেন্স বই আর আর্টিকেল ঘেঁটে সঙ্গে নিজেদের বোঝাপড়া কাজে লাগিয়ে একটা ড্রাফ্ট দাঁড় করিয়ে ভাবলাম, যাক, পারলাম তো। কিন্তু কোথায় কী, নিয়মমাফিক কোর্স টিচারকে পাঠানোর পর তিনি যখন সংশোধনী আর মন্তব্যসহ ড্রাফ্টা ফেরত পাঠালেন, মাথায় তখন বাজ পড়ার জোগাড়। আবার শুরু থেকে শুরু, এবার আবশ্য কোর্স টিচারের মন্তব্য ও সংশোধনী বেশ সহায়কের ভুমিকা পালন করেছে। এতো ছিল শুধু আর্টিকেল রিভিউ, প্রেজেনটেশান তখনো বাকি। 

এই ক্লাস আর অ্যাসাইনমেন্টের ব্যস্ততার মাঝে ডাক পেলাম বার্গেন পুলিশ দপ্তর থেকে। যারা আমাদের অস্থায়ী আবাসন কার্ড ইস্যু করবে, আর সে উদ্দেশ্যেই তাদের দপ্তরে গিয়ে নিজের নাম-ঠিকানা এন্ট্রি করে ছবি তুলে আসতে হলো। আমাদের এনআইডি কার্ড যে সিস্টেমে ইস্যু করে, ঠিক সেরকম। এখানে অবশ্য পুলিশ দপ্তরে যাওয়ার গল্পটা একটু না বললেই নয়। তারা আমাদের নামের অদ্যাক্ষর দিয়ে সিরিয়াল করেছে এবং সেই মাফিক সাক্ষাৎকারের দিনক্ষণ ঠিক করেছে। আমরা যে-ক’জন একই দিন-ক্ষণে যাবার নিমন্ত্রণ পেয়েছি, তারা সবাই একই সঙ্গে রওনা হলাম। পুলিশ স্টেশনটি আমাদের স্টুডেন্ট হাউজ থেকে সম্ভবত চারটি স্টেশন পরে এবং আবধারিতভাবে বিবানই আমাদের ভরসা। স্টেশন ঠিকঠাক চিনে নিয়ে বিবান থেকে নামলাম, কিন্তু এরপর পথের দিশা গুলিয়ে গেল এবং অবাক করার মতো বিষয় হলো, পথচারীদের মধ্যে একজনকেও পেলাম না, যে বা যারা পুলিশ স্টেশনটি চেনেন। এক্ষেত্রে ‘গুগল মামা’ও আমাদের কিছুক্ষণ গোলগোল ঘোরালো। অবশ্য শেষমেশ নির্ধারিত সময়েই আমরা পুলিশ স্টেশনে পৌঁছেছিলাম। আসলে যাদের নরোজিয়ান পুলিশ দপ্তর কেমন হতে পারে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই আথবা যে বা যারা আগে কখনো এ দপ্তরে আসেননি তারা চিনতে ভুল করতেই পারেন। এ আমাদের চিরচেনা পুলিশ স্টেশন নয়, করপোরেট আফিসের আদলে তৈরি ভবনটিতে এত ছোটো করে দপ্তরের নাম লিখা তাও আবার নরোজিয়ান ভাষায় যে, চিনে নেওয়া কষ্টসাধ্য বৈকি। 

পুলিশ দপ্তরে আমদের প্রোফাইল এন্ট্রি হওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আমাদের নিজ নিজ ডাকবাক্শে আমাদের অস্থায়ী আবাসন কার্ড পৌছে গেল। এখানে একটি কথা বলতে ভুলে গেছি, বার্গেনের স্টুডেন্ট হাউজে একটি করে রুম বরাদ্দ পাওয়ার পাশাপাশি আমরা প্রত্যেকে একটি করে ব্যক্তিগত ডাকবাক্শেরও অস্থায়ী মালিকানা পেয়েছি। নরওয়ে এসে এই বিষয়টিও আমাকে অবাক করেছে, এই যে তারা প্রযুক্তিতে এতটা এগিয়ে তবুও প্রযুক্তির পাশাপাশি এত এত ঐতিহ্যকে এত যত্নে আগলে রেখেছে যে, তার চিহ্ন শহরজুড়ে ছড়িয়ে আছে। বার্গেন শহরের প্রতিটি বাড়িতেই একটি করে চিঠির বাক্শো আছে। না, এটা শুধু বাড়ির সৌন্দর্য বর্ধক হিসেবে অলস পড়ে আছে তা নয়। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের চিঠিসহ ব্যক্তিগত বা সামাজিক অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্র কিন্তু এখনো এই ডাক মারফতই আসে।

বার্গেন পুলিশ দপ্তর থেকে ইস্যু করা অস্থায়ী আবাসন কার্ডটি আমাদের কাছে মূলত মুক্তির টিকেট হয়ে এল। এতদিন তো অবসর সময়টুকু বার্গেনের এদিক-সেদিক ঘুরেফিরে কেটেছে, এখন আমরা চাইলে ইউরোপের সেনজিনভুক্ত সবক’টি দেশের যেকোনোটিতে যেতে পারব। সেপ্টেম্বরের এই সময়টাতে ইউরোপের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মের ছুটি বলবৎ থাকলেও আমাদের কোর্স চালু রয়েছে। আর ক্লাস সিডিউল যেহেতু এমনভাবে করা যে মধ্যবর্তী গ্যাপ বড়োজোর দুই দিন, তাই এই দুইদিনের ছুটি সম্বল করে ইউরোপ-দর্শনে বেরিয়ে পড়াটা সম্ভব নয়। তাই অপেক্ষা অক্টোবরের জন্য। কেননা, অক্টোবরের শুরুতে টানা বার দিনের একটা বিরতি রয়েছে। সে সময়টাকে সামনে রেখে আমরা দশ দিনের একটি ট্যুরপ্ল্যান করে ফেললাম। সেইমতো শুরু হলো প্রাক-প্রস্তুতি অর্থাৎ প্লেনের টিকেট কাটা, হোটেলের বুকিং দেওয়া ইত্যাদি। তার মানে বিশাল কর্মযজ্ঞ আর ততোধিক উত্তেজনায় আমাদের দিন কাটছে।

ইউরোপ ট্যুর তো সেই অক্টোবরে এখন সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি, তাই বলে সময়টা ঘরে বসেই কাটবে ? মোটেই না, আমরা নরওয়েতে আমাদের অস্থায়ী বসবাসের সময়ের যথাসম্ভব সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করছি এর প্রাকৃতিক রূপসুধা উপভোগ করে। আগেই বলেছি, বার্গেনের পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ভ্রমণের জন্য মাসব্যাপী ব্যবহার্য টিকেট ব্যবস্থা রয়েছে, যদিও কেউ চাইলে প্রতিদিনের বা সাপ্তাহিক টিকেটও কাটতে পারেন। তবে, আমারা যারা প্রতিদিন বাইরে যাই তাদের জন্য মাসক্যাপী ব্যবহার্য টিকেটই সাশ্রয়ী। এই টিকেটের আরো একটি সুবিধা হলো, বাস, ট্রাম বা বোট সকল বাহনেই এটি কার্যকর। তখনো পর্যন্ত প্রয়োজনে অথবা নিছক ঘোরাঘুরি করতে বাস বা ট্রাম যা বিবান নামে পরিচিত তাতে ভ্রমণ করলেও বোটে ভ্রমণ হয়নি। তাই এক দুপুরে ক্লাস শেষে বেরিয়ে পড়লাম বোটে ভ্রমণের স্বাদ নিতে...