আমি প্রতিনিয়ত শিখছি -মৌসুমী আহমেদ লোপা

20 Sep 2021, 11:39 AM সংবাদ উপস্থাপক শেয়ার:
আমি প্রতিনিয়ত শিখছি  -মৌসুমী আহমেদ লোপা

টিভি সংবাদ উপস্থাপনার ক্ষেত্রে স্পষ্ট উচ্চারণ, মিষ্টি কন্ঠ, সুন্দর বাচনভঙ্গি ও আকর্ষণীয় চেহারা এবং দর্শকপ্রিয়তা বা জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে হাতে গোণা যে-কজন সংবাদ উপস্থাপক এগিয়ে আছেন মৌসুমী আহমেদ লোপা তাদের মধ্যে অন্যতম। ছেলেবেলা থেকেই নাচ এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করতেন তিনি। দর্শকনন্দিত এই সংবাদ উপস্থাপকের বিস্তারিত আনন্দভুবন পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো ...

আনন্দভুবন : কেমন আছেন ?

মৌসুমী আহমেদ লোপা : এই তো, ভালো আছি। কোভিডের এই সঙ্কটকালীন যতটা ভালো থাকা যায়, চেষ্টা করছি। পৃথিবীর সুস্থতার অপেক্ষায় আছি আমরা সবাই।

আনন্দভুবন : শুরুতেই জানতে চাই, সংবাদ উপস্থাপক হয়ে ওঠার গল্পটা কী ছিল ?

মৌসুমী আহমেদ লোপা : সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার স্বপ্নটা ছিল সেই ছেলেবেলা থেকেই। সবসময় আমার ভাবনাতে ছিল বড়ো হয়ে আমি সংবাদ উপস্থাপক হব। আসলে আমি সাংস্কৃতিক একটি পরিবারে জন্মেছি। বাবা, বড়ো ভাইয়া, আপু গান করতেন আর আমি নাচ শিখতাম। পাশাপাশি স্কুলজীবন থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করতাম। যা ছিল আমার স্বপ্ন। প্রতিটি কাজে মাকে আমি পাশে পেয়েছি। সাংস্কৃতিক কাজে পরিবারের সবাই আমাকে উৎসাহ দিতেন। আমি যখন ক্লাশ টু-তে পড়ি তখনই বড়ো ভাইয়া লিটন আমাকে ‘শাব্দিক সাংস্কৃতিক একাডেমি’তে নাচ শেখার জন্য ভর্তি করে দেন। তখন থেকেই আমার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পা রাখা। এসবই আমাকে সংবাদ উপস্থাপক হতে সাহায্য করেছে। তাছাড়া পরিবারের সদস্যরা স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন। তবে সেটা পূরণে পুরো ক্রেডিট দিতে চাই আমার হাসবেন্ড মারুফ আহমেদকে। আমার সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার প্রবল ইচ্ছার কথা ও জানত। তাই ঢাকায় এসেই সিভি তৈরি করে নিজেই ড্রপ করেছে ভালো ভালো চ্যানেলগুলোতে। এরপর কয়েকটি চ্যানেল থেকে আমাকে ডাকা হয়। তারপর সেখান থেকে সময় টিভিতে লিখিত পরীক্ষা, ভাইবা এবং অডিশন দিলাম এবং সুযোগও পেয়ে গেলাম। তারপর ২০১৪ সালে সময় টিভি থেকে যমুনা টিভিতে যোগ দিই। এখনও যমুনাতেই আছি। এর আগে আমি বাংলাদেশ বেতার রংপুর এবং রাজশাহী কেন্দ্রে কাজ করেছি এগার বছর। 

আনন্দভুবন : পরিবার থেকে কি কোনো সহযোগিতা পেয়েছেন ?

মৌসুমী আহমেদ লোপা : আপনি তো জানেন, এই পেশায় টাইম সিডিউল ফিক্সড থাকে না। দিন-রাত-ভোর যখন তখন কাজ থাকতে পারে। পরিবারের সাপোর্ট ছাড়া খুব কঠিন এই কাজ করা। আল্লাহর রহমতে আমি শুরু থেকেই পুরো সহযোগিতা পেয়ে আসছি পরিবার থেকে। বিয়ের আগে যখন রোিডওতে ছিলাম তখন বাবা-মা, ভাইবোন খুব সহযোগিতা করত। ২০০২-এর দিকে মা আমাকে রেডিওতে নিয়ে যেত আর কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বসে থাকত। বিয়ের পর আমার হাজবেন্ড মারুফ আহমেদের কাছ থেকে উৎসাহ, সহযোগিতা সবই পাচ্ছি।

আনন্দভুবন : প্রথম সংবাদ উপস্থাপনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাই

মৌসুমী আহমেদ লোপা : প্রথম সংবাদ উপস্থাপনা ছিল আমার কাছে স্বপ্ন পূরণের দিন। একটা অন্যরকম অনুভূতি ছিল আমার ভেতর। তবে কেন যেন প্রথমদিন সংবাদ উপস্থাপনা করতে গিয়ে আমার ভেতর কোনো ধরনের ভয় কাজ করেনি। শুধু একটা চিন্তা ছিল আমাকে ভালো করতে হবে। কতটুকু ভালো করতে পেরেছি জানি না। তবে, নিউজ পড়া শেষে অফিসের সবাই বলেছিল তুমি ভালো করবে। বাসার এবং বন্ধুদের সবার কাছ থেকেই উৎসাহ পেয়েছি। আরেকটা কথা শেয়ার না করলেই নয় আজ থেকে এগার বছর আগে আমি যেদিন সময় টিভিতে প্রথম সংবাদ উপস্থাপন করতে যাব তার একদিন আগে আমার হাসবেন্ড মারুফ আমাকে ফোন করে বলল, দশ মিনিট পর বাসার নিচে নামো। আমি বাসার নিচে নেমে সত্যি সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম। আমার সামনে একটা অ্যালিয়ন গাড়ি। গাড়ির চাবি দিয়ে মারুফ আমাকে বলল, এটা তোমার গাড়ি। কাল অতদূরে অফিস করতে কীভাবে যাবে, তাই কিনলাম। প্রথম সংবাদ উপস্থাপন করার জন্য এটা আমার জন্য একটা বড়ো সারপ্রাইজ। আমার কাজের প্রতি তার কতটা শ্রদ্ধা আর সাপোর্ট সেটা আমি সেদিন বুঝেছি। পরদিন ওর কিনে দেওয়া গাড়িতে আমি প্রথম সংবাদ উপস্থাপন করতে সময় টিভিতে যাই। 

আনন্দভুবন : একজন ভালো সংবাদ উপস্থাপক হওয়ার জন্য কী কী গুণ থাকা দরকার বলে আপনি মনে করেন। কোন জিনিসগুলো জানা দরকার ?

মৌসুমী আহমেদ লোপা : একজন ভালো সংবাদ উপস্থাপকের প্রথমেই শুদ্ধ উচ্চারণে স্পষ্টভাবে কথা বলা রপ্ত করতে হবে। বাচনভঙ্গি হতে হবে সুন্দর। তার মিষ্টি এবং আকর্ষণীয় কণ্ঠ থাকতে হবে। নিউজের কনটেন্ট অনুযায়ী এক্সপ্রেশন দিতে হবে। তবে সব এক্সপ্রেশনেই পরিমিতিবোধ থাকতে হবে। সংবাদ এতটাই সাবলীলভাবে পড়তে হবে যে, দর্শক আগ্রহ নিয়ে খবর দেখবে। পোশাক ও সাজ সম্পর্কেও যথেষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে। এমন কোনো পোশাক পরা যাবে না, বা এমন কোনোভাবে সাজা যাবে না, যা সংবাদকে ছাপিয়ে যায়। দেশের ভেতর এবং বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে সে সম্পর্কে অবশ্যই জানা থাকতে হবে। তাৎক্ষণিক যেকোনো পরিস্থিতিতে ভীত না হয়ে দক্ষতার সাথে সামলে নিতে হবে। নিজেকে একজন নিউজম্যান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। 

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপন করতে গিয়ে কোনো বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হয়েছেন কি ?

মৌসুমী আহমেদ লোপা : তেমন কোনো বিব্রতকর অবস্থায় পড়িনি। তবে, একদিন অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছি। খবর পড়তে পড়তেই হঠাৎ করে হেচকি শুরু হয়ে গেল। খুব কষ্টে কন্ট্রোল করার পরও দুয়েকবার সাউন্ডটা অনএয়ার হয়েছিল। তবে আরেক দিনের একটা স্মরণীয় ঘটনা শেয়ার করি : অফিসের প্রিন্টারটা হঠাৎ করেই নষ্ট হয়ে যায়। স্ক্রিপ্ট ছাড়াই নিউজ পড়তে বসে যাই। ঘটনাটা ঘটল ঠিক স্টিং চলার সময় অটোকিউ [যা দেখে আমরা সংবাদ পড়ি] চলে গেল। আমার হাতে হার্ড কপিও নেই, অটোকিউড নেই, বোঝেন কী একটা অবস্থা তখন ! তাৎক্ষণিক আমি স্টিং চলার সময় ইশারা করলাম প্রোডিউসারকে সে তখন টকব্যাকে হেডলাইন বলছিল আর আমি শুনে শুনেই একটু শর্ট করে এডিট করে পড়ে যাচ্ছিলাম। হেডলাইনের পর প্রথম স্টোরিটা পর্যন্ত ওভাবেই পড়তে হয়েছে। কোনোরকমে বিপদ থেকে সেদিন বেঁচে যাই। পরে ভাবলাম, নিউজ রুমের সবাই খুব প্রশংসা করবে আমাকে। কিন্তু কেউই এটা নিয়ে কোনো কথা বলল না। পরে যখন জিজ্ঞেস করলাম, কোনো ঝামেলা বোঝা গেছে কি না তখন সবাই বলছিল কেন কিছুৃ হয়েছিল নাকি। তবে প্রোডিউসার মিঠু ভাই বলেছিলেন, ‘আপা আপনি খুব ভালোভাবে হ্যান্ডেল করেছেন তাই কেউ কিছু বুঝতে পারেনি, যার জন্য প্রশংসাও করেনি। সেজন্য আপনার খুশি হওয়া উচিত।’ এজন্য আমি প্রোডিউসারকে ধন্যবাদ দেব, তিনিও দক্ষতার সাথে প্রেজেন্টারকে শান্ত রাখতে পেরেছিলেন। এরকম বিপর্যয় যখন তখন হতে পারে সেটা নান্দনিকতার সঙ্গে সামলে নিতে হবে। জানি না, কতটুকু পারছি তবে মনপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি। 

আনন্দভুবন : সংবাদ উপস্থাপনার পাশাপাশি অন্য কোনো পেশায় যুক্ত আছেন কি ?

মৌসুমী আহমেদ লোপা : আমি সংবাদ উপস্থাপনার পাশাপাশি বার্তাকক্ষ সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছি। এছাড়া করপোরেট প্রোগ্রামগুলো আমি করছি। আর যেকোনো কারণেই হোক এই পেশাকে আমরা নির্ভরশীল পেশা হিসেবে এখনো বলতে পারি না। আমি চাই, সংবাদ উপস্থাপনা এমন একটা জায়গায় উন্নীত হোক, যেন এটি স্বতন্ত্র পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। আমাকে মানুষ শুধু একজন সংবাদ উপস্থাপক হিসেবেই চিনুক। আমি প্রতিনিয়ত শিখছি। এখনো অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। যতটুকু শিখতে পেরেছি তা অন্যদেরও কিছুটা হলেও শেখাতে চাই। 

আনন্দভুবন : আনন্দভুবনকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

মৌসুমী আহমেদ লোপা : আপনাকেও অনেক ধান্যবাদ। ধন্যবাদ আনন্দভুবনকেও। 

সাক্ষাৎকার : শহিদুল ইসলাম এমেল