ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

22 Sep 2021, 12:10 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

পর্ব ১০

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

বেশ কিছুদিন থেকেই মনে মনে পরিকল্পনা করে চলেছিলাম বারগেন শহরে নৌভ্রমণের। আসলে নৌভ্রমণ না বলে নৌ পারাপার বলাই ভালো। যদিও বারগেন টু কোপেনহেগেন বা নরওয়ে টু ফিনল্যান্ড যাতায়াতের যে নৌবিহারের ব্যবস্থা রয়েছে তা আয়েস আর অবকাশ যাপনের জন্য তুলনাহীন। তবে, এতে সাধ আর সাধ্যের বিষয়টি সম্পৃক্ত। এটা অবশ্য অনেকটা দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মতো। দিনটা বোধকরি বুধবার। রিসার্চ মেথডলজি ক্লাসটা সকাল ৯.৩০ মিনিটে শুরু হয়, মাঝে মাঝে অবশ্য স্থান-কালের হেরফের হয়ে থাকে তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা আগেভাগেই স্টুডেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়। আসলে স্টুডেন্ট সাপোর্ট সিস্টেম বা স্টুডেন্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম যাই বলি না কেন, এটি একটি অ্যাপস্ যা MIIT UIB টওই নামে পরিচিত, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে, সে অবশ্য অন্য প্রসঙ্গ। তবে MIIT UI-তে প্রতিদিন একাধিকবার লগইন করা আর তথ্য বা নিদের্শনাতে চোখ বুলানো আমাদের নিত্যদিনকার রুটিন। সেদিন হয়ত আলসেমি করে আগেভাগে অ্যাপস্-এ লগইন করা হয়নি, প্রতিদিনকার মতো তৈরি হয়ে ক্লাসের উদ্দেশে রওনা দিয়েছি। পথে যেতে যেতে একবার MIIT UIB লগইন করে নিশ্চিত হতে চাইলাম ক্লাসের ভেন্যু ঠিক আছে কি না, ব্যস মুহূর্তেই চক্ষু চড়কগাছ। ভেন্যু পরিবর্তন করা হয়েছে এবং ইতোপূর্বে সেখানটায় আমাদের কোনো সেশন হয়নি, অগত্যা গুগল মামাই ভরসা। তবে শেষ পর্যন্ত গুগল মামাও হোচট খেল, তখন সতীর্থরাই ভরসা, তবে এখানও বিপত্তি কয়েকজনকে ফোন করা হয়ে গেছে কিন্তু কাউকেই পাচ্ছি না, সম্ভবত নেটওয়ার্ক সমস্যা। অবশেষে পাভেলকে পাওয়া গেল পথের দিশা খুঁজে পেতে। 

গল্প-গুজব আর ফাঁকে ফাঁকে নানান ঢঙে ছবি তুলতে তুলতে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম

বলছিলাম নৌবিহারের কথা। তার মধ্যে আবার ক্লাস এলো কোথা থেকে ! আসলেই এ যেন অনেকটা ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে গেল। না কিছুটা প্রাসঙ্গিকতা আছে বলছি, যেহেতু বুধবার ক্লাস সকাল সকাল শুরু হয়, তাই শেষও হয় সকাল সকাল। যে-কারণে ক্লাস শেষে দিনের বেশ খানিকটা সময় হাতে রয়ে যায়, যাকে পুঁজি করে কাছেপিঠে ঘুরে আসা যায়, আর সেই জন্য এই গৌরচন্দ্রিকা বা শিবের গীত গাওয়া। ক্লাস শেষে নৌবিহারে যাওয়ার পরিকল্পনা একান্ত আমার নিজের ছিল, আগেভাগে কাউকে জানানোও হয়নি। সচরাচর এ-সকল ক্ষেত্রে ফারজানা আমার সাথি হয় আথবা আমি ফারজানার। কিন্তু আজ ফারজানার অন্য ব্যস্ততা থাকায় সে যাচ্ছে না এছাড়া ইতোমধ্যে তার এ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়ে গেছে। যাই হোক, ভাবছিলাম যদি সতীর্থদের কেউ সঙ্গী হয় তবে যাত্রাটা মন্দ হয় না আর যদি নেহাতই কারো আগ্রহ না থাকে তবে সেই চিরন্তন বাণী ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে...’ না, একলা আর যেতে হয়নি, একে একে সাতজন সতীর্থ এক হয়ে গন্তব্যের পথে পা বাড়ালাম। 

পুরোটা পথ খোলা ডেকেই কাটিয়ে দিলাম

শুধু বারেগেন না, সমস্ত ইউরোপজুড়ে একই নিয়ম যা আমজনতাসহ এলিট শ্রেণি প্রায় সকলের জন্য প্রযোজ্য হয় বাস বা ট্রাম চড়ো অথবা পায়ে হাঁটো। আর যারা প্রকৃত অর্থেই অর্থ আর বিত্তে বিলাসী তাদের গোনায় নাই-বা আনলাম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৌঘাট খুব বেশি দূরে নয় ; আবার এতোটাও কাছে নয়, আমাদের দেশে এ পরিমাণ দূরুত্ব আমরা সাধারণত হেঁটে যাই না। তবে, ইউরোপে এ ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই, তাই পায়ে পায়ে আমরা এগুলাম। জাহাজঘাটাটি বিশ্ববিদ্যালয় লাগোয়া ফিসমার্কেট এলাকায়। এখানটায় আমাদের প্রায়ই আসা হয়, কেননা, এ এলাকাটা মূলত মার্কেট প্লেস, ফিসমার্কেট নাম হলেও সবধরনের প্রয়োজনীয় আর বিলাসী পণ্যের পসরা নিয়ে মার্কেটগুলো সেজেগুজে থাকে। জাহাজঘাটা থেকে যেমন অভ্যন্তরীণ ছোটো ছোটো নৌ যান ছেড়ে নোঙর ফেলে তেমনি বিশাল বিশাল বিলাসী জাহাজও এ ঘাটে এসে জিরিয়ে যায়। জাহাজ বা লঞ্চ যাই বলি না কেন, তার সিডিউল জানা ছিল, তাই কিছুটা তড়িঘড়ি করে প্রথম লঞ্চটা ধরবো বলে তাড়াহুড়া করছিলাম, যা একটুর জন্য মিস করলাম। তারপর আবার ঘন্টাখানেক অপেক্ষা। অবশ্য এ-রকম একটি দলের পক্ষে আড্ডায় ঘণ্টা পার করে দেওয়া কোনো ব্যাপারই না। সেই সাথে আছে পায়রাদের সঙ্গ, সময় বোর হওয়ার সময়ই পায়নি। যথারীতি আমরা পরের লঞ্চের যাত্রী হলাম। আসলে এটাকে লঞ্চও বলা যায় না, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ছোট্ট তরী নামটিই এর জন্য মানানসই।

তরীটি দুটি তলায় বিভক্ত। উপরের তলার অর্ধেকটা আবার খোলা ডেক। যারা এর নিয়মিত যাত্রী যাকে ডেইলি প্যাসেঞ্জার বলে, তারা নিচতলা আর ওপর তলার ঘেরা অংশে বসে বা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ইউরোপীয়ানদের এই এক অভ্যাস পাবলিক ট্রান্সপোর্টে তারা বসার জায়গা বা সিট খালি থাকলেও বসতে খুব একটা আগ্রহ বোধ করে না, কেন করে না, কারণ আমার অজানা। যা বলছিলাম, আমরা গুটিকয়েক যারা শুধুমাত্র ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে তরীর যাত্রী তারা পুরোটা পথ খোলা ডেকেই কাটিয়ে দিলাম। আমার এই যাত্রাটা এতটাই উপভোগ্য ছিল যে, যাত্রাপথেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, সময় পেলেই বোটে উঠে পড়ব।

জলে বা স্থলে, পাহড়ে বা সমতলে যেখান থেকেই বারগেন শহরটাকে দেখি না কেন, এর প্রতিটি দৃশ্যপটই অসাধারণ। প্রকৃতির পরম মমতা দিয়ে ঘেরা এক শহর বলে আমার মনে হয়। জাহাজের গতি খুব বেশি না আমরা রেলিংয়ের ধার ধরে অনেকটা ঝুঁকে জলের তরঙ্গময় নাচন দেখছিলাম আর অন্যদিকে বাতাস যেন অনেকটা ঈর্ষান্বিত হয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছিল অবিরাম। তবে, আমরা বাতাসকে নিরাশ করিনি। জল আর হাওয়া এই দুয়ের মিলিত আবেশ আমাদের যাত্রাকে পূর্ণ তো করেছে বটেই সাথে সাথে দূর দিগন্তকে কাছে পাওয়ার বাসনাও তৈরি করে দিয়েছে। তাই যেতে যেতই আমরা বারগেনের কিছু জনপ্রিয় নৌবিহারে সাথি হবো বলে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা করে ফেললাম, যদিও পরবর্তীসময়ে তা আর সফল করা সম্ভব হয়নি। সে গল্প অন্যদিন হবে। গল্প-গুজব আর ফাঁকে ফাঁকে নানান ঢঙে ছবি তুলতে তুলতে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। এখন যদি গন্তব্যের নাম ঠিকানা জানতে চান তাহলে অবশ্য বিপদে পড়ে যাব। একে তো নরোজিয়ান ভাষাটা স্বাভাবিকভাবেই আমার কাছে দুর্বোধ্য, তার উপর এতদিন পর মনে করে লেখা, পাঠক ক্ষমা করবেন নিশ্চয়ই।

খাড়ির ধার ঘেঁষে বিছানো বড়োবড়ো পাথরের চাঁইয়ে বসে পড়লাম

জাহাজ জেটিতে ভিড়লে জাহাজের সকল যাত্রী এক এক করে নেমে পড়ল, আমরাও নামলাম। মিনিট দশেকের মধ্যে জাহাজটি আবার তার ছেড়ে আসা গন্তব্যে রওনা দিবে। প্রথমটায় আমরা একটু দ্বিধায় ছিলাম, আমরা কি এখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করব না ফিরতি জাহাজে উঠে পড়ব। শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো কিছু সময় কাটিয়ে যাব এ বিজন চরে। আসলে আমার কাছে এটা বিজন চর বলে মনে হলো, আশেপাশে কোনো লোকালয় বা দোকানপাট নেই। অবশ্য বারগেনে যত্রতত্র দোকানপাট থাকার কোনো সুযোগও নেই। এ তো আর আমার দেশ নয়, যে যার মতো স্বাধীন সা¤্রাজ্যের বিস্তার ঘটাবে। এখানে সবকিছুই অত্যন্ত পরিকল্পিত ও সুনিদিষ্ট নিয়মে আবদ্ধ। আমরা জাহাজ থেকে নেমে একটু এদিক সেদিক পায়চারি করে খাড়ির ধার ঘেঁষে বিছানো বড়োবড়ো পাথরের চাঁইয়ে বসে পড়লাম। পাথরের চাঁইগুলো যেন আমাদের জন্যে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, এটি কি প্রকৃতির খেয়াল না নগর কর্তৃপক্ষের সুচিন্তিত ভাবনার বাস্তবায়ন তা অবশ্য বোঝার উপায় নেই। খাড়ির এ পাশটিতে স্বচ্ছ পানির ধারা যেন পাতালপুরির পথ খুলে দিয়েছে বেশ তল অবধি দেখা যায়। আমরা বসে বসে জলের তলার অধিবাসীদের যাপিত-জীবনের কর্মব্যস্ততা উপভোগ করছি। কেউ কেউ মাছ গুনছে, কেউ-বা আবার মাছের পরিচয় জানা বোঝার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে নাসরিন যেন একটু গুনগুনিয়েও উঠল। আসলে জল আর দূরের জঙ্গলের রূপের মোহময়তা আর এলোমেলো বাতাস আমাদের যেন অন্য কোনো জগতের পথিক করে তুলেছে। সুন্দর আর ভালো সময়গুলো যেন দ্রুতই ফুরায়। বেলাও পড়ে এল, আমাদের পেটপূজাটা যে বাকি রয়ে গেল, ক্ষিদেটা বেশ ভালোমতোই অস্তিত্ব জাহির করছে। ফিরতে হবে। কীভাবে ফিরব এ সম্পর্কে পূর্ব কোনো পরিকল্পনা না থাকায় বুঝে উঠতে সময় লাগল আসলে আমরা কীভাবে ফিরতে পারব। কাছেপিঠে দুটো বাস স্টপ ছিল কিন্তু কত নম্বর বাস আমদের পথে যাবে আর স্টপটাই বা কোনটা এর জন্য অবশ্য রীতিমতো গবেষণা করেতে হয়েছে।