ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

10 Oct 2021, 02:12 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন  -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

পর্ব ১১

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


আগস্টের শেষ অথবা সেপ্টেম্বরের শুরু এই সময়টাতে আমরা আমাদের অস্থায়ী আবাসন কার্ডটি হাতে পাই। আর তখন থেকেই আমাদের পরিকল্পনা ও প্রতীক্ষা ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে ঘুরতে যাওয়ার- এজন্য অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস, পরীক্ষা ইত্যাদির সিডিউলের দিকেও খেয়াল রাখতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে একটি অ্যাসাইনমেন্ট জমা করে দিয়েছি। আগেই বলেছিলাম, অক্টোবরের শুরুতে দশদিনের একটি ছুটি রয়েছে, তাই আমাদের টর্গেট টাইম আপাতত সেপ্টম্বরের ৩০ আথবা অক্টোবরের ১। ফারজানা অবশ্য এরই মাঝে ছয়দিনের একটি ট্যুর দিয়ে এলো তার পরিবারসহ। যেহেতু ফারজানার ছেলে এবং হাসবেন্ড স্বল্প সময়ের জন্য নরওয়েতে এসেছে, তাই অনেকটা তড়িঘড়ি করে তাকে প্লান করতে হলো। যাই হোক, তাদের উইরোপ ভ্রমণ শেষে পড়ে থাকা শেষ কয়েকটি দিন তারা কাটিয়েছে শপিং করে এবং বারগেনের বিভিন্ন চেনা-অচেনা জায়গায় ঘুরে-ফিরে। এমনি একটি ডে-ট্রিপে আমি ফারজানাদের সঙ্গী হলাম। এরই মধ্যে আমি বোধ করি বেশ কয়েকবার বারগেনের সাতটি পাহাড়ের কথা প্রসঙ্গক্রমে বলেছি, তার মধ্যে হাতের নাগালে ফ্লোয়েন-এ বার কয়েক যাওয়া হয়েছে, আর অন্য পাহাড়গুলোর মধ্যে যেটিতে পর্যটকদের ওঠার জন্য বাহনের সুব্যবস্থা রয়েছে তার নাম উল্রিকেন। এছাড়া বাদবাকিগুলোতে শুধু যাদের ট্র্যাকিংয়ের অভ্যাস আছে তারাই যেতে পারবেন। সুতরাং, আমার মতো যারা একটু উঁচুতে উঠে হাঁপিয়ে যায়, তাদের সেদিকে না যাওয়াই ভালো। 

পাখির চোখে হ্রদ দেখা

দিনক্ষণ, তারিখ বা বার কোনোটাই এখন ঠিকঠাক মনে করতে পারব না, তবে সেদিন ক্লাস ছিল না নিশ্চিত। আমরা নাস্তা সেরে, কিছু শুকনো খাবার বাক্শোবন্দি করে বেলা দশটানাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। রোদ ঝলমলে দিন, প্রথমে ফ্যানটপ থেকে লাইট ট্রেনে তারপর বাসে উল্রিকেনের কাছাকাছি স্টপেজ, তারপর যথারীতি পায়ে হাঁটা। খুব বেশি হাঁটতে হয়নি, সম্ভবত মিনিট সাতেক পায়ে হেঁটে আমরা উল্রিকেনের পাদদেশে পৌঁছে গেলাম। সেখানে ছোটো একটি টিকেট কাউন্টার। উলৃরিকেনের চূঁড়ায় ওঠার জন্য আমাদের মতো আয়েসী ভ্রমণপ্রিয়াসীদের জন্য রয়েছে ক্যাবল কারের ব্যবস্থা আর তার টিকেটের জন্যই এই টিকেট কাউন্টার। খোঁজ নিয়ে জনালাম, এখানে দুই ধরনের টিকেট আছে, সিঙ্গেল আর ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্যামিলি প্যাকেজ। আমরা চারজনের ফ্যামিলি প্যাকেজটাই নিলাম, যা বেশ সাশ্রয়ীও বটে। টিকেট কেটে লাইনে দাঁড়ানোর মিনিটদশেক পর আমাদের সুযোগ এল। আমার ক্যাবল কারে উঠে পড়লাম। আমরা ছাড়া আরও দুজন ছিল আমাদের সাথে। চলতে শুরু করতেই একটা ধাক্কা মতো খেলাম তারপর টানা র্শর্শ শব্দ, এবং এই শব্দটা অনেকক্ষণ ধরেই কানে বাজতে থাকল, একইসাথে দৃশ্যপটে ঘটে যেতে লাগল দ্রুতলয়ের পরিবর্তন। কোনো কিছুই স্পস্ট নয়, ঘোর লাগা কিছু সময়, মনে হচ্ছে ছায়াছবি, একটা কিছু চোখের পর্দা ছুঁয়ে যাচ্ছে। বেশ খানিকটা সময় লাগল ধাতস্থ হতে। আসলে এটিকে ক্যাবল কার না বলে ক্যাবল লিফ্ট বলাই বোধহয় উত্তম। কেননা, এটা টানা কেবল উপরের দিকেই ছুঁটছে বলে মনে হচ্ছে। 

উল্রিকেনের

ঠিক কতক্ষণ লেগেছিল উপরে পৌঁছুতে তা অবশ্য মনে নেই কিন্তু উপরে পৌঁছে প্রথমে আমার যে অনুভূতি হয়েছে তা হলো যেন কোনো বহুতল ভবনের ছাদে পৌঁছেছি। বেশ কিছু টাওয়ার আর মাঝারী একটি কংক্রিটের ছাদ চোখে পড়ল। টাওয়ারগুলো মুলত পাখির চোখে শহর দেখার উদ্দেশ্যে নির্মিত। আর ক্যবল কার স্টেশনের জন্য বাকি স্থাপনাগুলো তৈরি করা হয়েছে। ছোটো একটি টি-স্টলের মতোও রয়েছে, যা দেখে আমার রাস্তার ধারে টং দোকানের কথা মনে পড়ে গেল। তবে হঠাৎ দেখা এই চিত্র বেশ হতাশাব্যঞ্জক। তখন মনে হতেই পারে এত খরচ করে কেন এলাম। ওই যে বলে সবুরে মেওয়া ফলে, একটু সবুর করে সামনে এগুতেই দৃশ্যপটে ব্যাপক পরিবর্তন। ইট-পাথরের মায়া ছেড়ে রুক্ষ পাথুরে পথের দিকে এগুতেই প্রকৃতি যেন ধীরে ধীরে তার রূপের ডালি উজাড় করে দিল, প্রকৃতি তখন যেন ময়ূরের মতো একটু একটু করে তার রূপের পসরা মেলে ধরছে...। 

আমরা প্রথমেই একটা ঢালু মতো এবড়ো-থ্যাবড়ো পথ ধরে এগুলাম। বোধ করি একেই বলে বন্ধুর পথ। ইউরোপে আমরা সাধারণত কেডস্ই পরে থাকি যেহেতেু প্রচুর হাঁটতে হয়, সেদিনও ব্যতিক্রম ছিলো না। তবে, ফারজানা সেদিন তার জুতো নির্বাচনে একটু গ-গোল করে থাকবে, তাই তার জন্য এ বন্ধুর পথে সমানতালে এগিয়ে চলা একটু কষ্টকরই ছিল। ফারজানার ছেলে সাবিত ছোটো হলে কি হবে, সে ছিল সব থেকে অ্যাকটিভ, আমি আর সাবিত দুজন অনেকটা এগিয়ে থেকে চলছিলাম। চলতি পথে লোকজনের আনাগোনা আমাদের কৌতূহলী করে তুলেছিল, তাই রুক্ষ পাথুরে পথে সূর্য মাথায় করে এগিয়ে যেতে যেন বদ্ধপরিকর ছিলাম। ইউরোপে সূর্য এক আরাধ্য বস্তু, তবে শরতের এই শেষভাগেও সূর্যের তাপ নেহায়েত কম ছিল না। যাই হোক পথটি কৈশোরে পড়া ওয়েস্টার্ন গল্পের রহস্যময় প্রান্তরের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। পথ কিন্তু আমাদের নিরাশ করেনি। আমারা আভাস পাচ্ছিলাম মরুদ্যানের এবং তা হঠাৎ-ই যেন পথের বাঁকে ধরা দিল।

পাহাড়ের চূঁড়া বলতে যেমন বেশ অপরিসর একটি পাটাতন কল্পনায় থাকে, বাস্তবে কিন্তু উল্রিকেনের উপরটা তেমন ছিল না। আমি কখনো মালভূমি দেখিনি। কিন্তু এখানে এসে আমার মনে হলো, মালভূমি বুঝি এমনই হয়। পুরো চূঁড়া এলাকাটা দৃষ্টি গোচর হয়নি, এমনকি আমরা অনেকটা হেঁটে হেঁটে বোধকরি এর একচতুর্থাংশও দেখে উঠতে পারিনি। পাহাড়ের অতটা উঁচুতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেক, যার চারধারটা সবুজের বেষ্টুনি দিয়ে ঘেরা। লেকে দু-একটা বাহারি বোট, দূরে এক বা একাধিক নিঃসঙ্গ ছোট্ট বাড়ি, যেগুলো কি না হলিডে হোমস নামে পরিচিত। এখানে-সেখানে ক্যাম্প ফায়ারিংয়ের স্মৃতিচিহ্ন। বোঝা যায়, আপাত পাথুরে এ বিরানভূমি মোটেই বিজন নয়। সপ্তাহান্তে এখানে লোকের আনাগোনা নেহয়েত কম নয়। লেকের ধারে বসে এর সুশীতল পানির পরশ নিতে নিতে কল্পনায় কোন এক নিঃসঙ্গ বাড়ির বাসিন্দা হয়ে উঠেছিলাম। মনে হচ্ছিল এ অপার্থিব সৌন্দর্যে বরাবরের জন্য হারিয়ে গেলেও কোনো ক্ষতি নেই। আমরা চারজন একসাথে একপথে পাড়ি দিয়ে যখন একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম তখন যেন আমরা সবাই এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে নিজেদের কল্পনার জগৎ সাজাচ্ছিলাম। প্রকৃতির ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপের এটা বোধকরি ভয়ঙ্করতম দিক। মানুষের মনোজগতে সাংঘাতিক তোলপাড় তৈরি করতে পারে। ভয়ঙ্কর সুন্দর, সত্যিই তাই গোলাপি পাথুরে প্রান্তরে মাঝে মাঝেই সবুজ ও সোনালি ঘাসের মাঝে ছুটে বেড়াচ্ছে দলছুট দুধসাদা ভেড়া।

লেকের ধারে লেখক

উলৃরিকেনের চূঁড়ায় ছোটো ছোটো লেক বা জলাধার দেখে আমার বান্দরবানের বগা লেকের কথা মনে পড়ে গেল, যা নিয়ে বেশ কিছু মিথ প্রচলিত। তবে, আমার কাছে মনে হয়েছিল ঠিক যেন কাকচক্ষু জলের এক বিশাল চোখ, ঘনসবুজ পল্লবে ছাওয়া। বিদেশ-বিভূঁইয়ে যখনই প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য দেখি, মনের ভেতরে চুপটি করে থাকা কষ্ট যেন ডানা ঝাপটায়। যদিও ছেলেবেলা থেকেই সবুজ শ্যামলিমা বাংলার রূপগল্প শুনে আজন্ম শহুরে আমি প্রকৃতির যে ছবি কল্পনায় এঁকেছি বাস্তব আসলে ততটা শ্যামলরূপে আমার কাছে ধরা দেয়নি। না এ প্রকৃতির কৃপণতা নয় ; এ আমাদের প্রকৃতির প্রতি নিদারুণ অবহেলা। বগা লেকে গিয়ে আমি এতটাই আপ্লুত ছিলাম যে, দুর্গম পাহাড়ি পথের ধকলটাকে নিতান্তই তুচ্ছ বলে মনে হয়েছিল। তবে ততটাই শংকিত হয়েছিলাম যে, হয়ত আর কিছুকাল পরে এ লেকের অস্তিত্বই থাকবে না। অন্য কিছু নয়, শুধু সো-কল্ড ভ্রমণ বিলাসীদের বিলাসী  স্থানে ব্যবহৃত সাবান আর শ্যাম্পুর খোসা দিয়ে একদিন এ লেকটি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ইতিহাসের পাতায় ‘ছিল’ বলে ঠাঁই নেবে।

কত সময় উলৃরিকেনের চূঁড়ায় লেকের ধারে বসে কাটিয়ে দিলাম তার হিসাব নেই, বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ ঠিক টের পাচ্ছি, না সূর্যের তেজ কমেনি বরং যেন আরো তেতে উঠেছে। আমাদের সাথে আনা রসনা রসদ অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে অন্যদিকে ক্ষুধা আর তৃষ্ণা দুটোই প্রবল হয়ে উঠেছে। তাই সেদিনকার মতো প্রকৃতির রূপমাধুর্যের সাথে আপাত বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ফিরে এলাম ফ্যানটপের ইট-কাঠের ছোট্ট কোঠুরিতে।  [চলবে]