ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

16 Nov 2021, 01:21 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

পর্ব ১২

[পূর্ব প্রকাশিতের পর] 


দেখতে দেখতে নরওয়েতে আমরা প্রায় দুই মাস কাটিয়ে দিলাম। অক্টোবর মাস এল বলে, আগেই বলেছি, অক্টোবরের শুরুতে আমরা ১০ থেকে ১২ দিনের একটা ছুটি পাচ্ছি আর সেই ছুটি নিয়ে আমাদের বিশাল প্রস্তুতি। ইউরোপ ভ্রমণের যাবতীয় প্রস্তুতি ইতোমধ্যে শেষ। আমরা প্রথমত পাঁচটি শহরকে কেন্দ্র করে আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনা সাজিয়েছি। প্যারিস, রোম, ভেনিস, জুরিখ এবং প্রাগ। এরই মধ্যে প্লেনের টিকেট কাটা এবং হোটেল বুকিং সারা। তবে, প্যারিসে হোটেল বুকিংটা তখনও বাকি, যদিও আমরা প্রথমেই প্যারিস যাব। [লেখার এই অংশটা আমার জন্য খুবই বিব্রতকর। কেননা, এখানে আমার যে কাজিনের কথা বলব তিনি এখন আর আমাদের মাঝে নেই, র্দীঘ পাঁচ বছর পর বাংলাদেশে এসে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তিনি চিরদিনের জন্য এ মাটির কোলে ঠাঁই নিয়েছেন।] সবুজ ভাই, আমার কাজিন যে কিনা র্দীঘদিন যাবত ফ্রান্স প্রবাসী, আমি নরওয়ে যাবার পর থেকেই তার কাছ থেকে তাগিদ পাচ্ছিলাম, প্যারিসে তার বাসায় যাবার। কিন্তু সময়-সুযোগ মেলাতে মেলাতে দুই মাস পার হয়ে গেল, যখন পরিকল্পনা করলাম তখন আমরা ছোটোখাটো একটি দল। আর ইউরোপের দুই মাসের অভিজ্ঞতায় ইউরোপের বাড়িঘর সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি, তা হচ্ছে বাড়িগুলো দেখতে ছবির মতো সুন্দর হলেও আয়তনে বেশ ছোটই বলা যায়। এর পেছনে কারণও রয়েছে, এরা মূলত খোলা জায়গা বেশ পছন্দ করে, অপ্রয়োজনে ইমারত তৈরি করে ইট-পাথরের জঙ্গল তৈরিতে তাদের ঘোর আপত্তি। পারিবারিক কাঠামো এবং সমাজ ব্যবস্থাও এর অন্যতম নিয়ামক। তাদের পরিবারগুলোও বেশ ছোটো হয়ে থাকে এবং তারা একই জায়গায় আজীবন শেকড় গেড়ে থাকতেও পছন্দ করে না। আবার অন্যদিকে তাদের সমাজ ব্যবস্থায় আত্মীয়-স্বজন একে অন্যের বাড়িতে হুটহাট বেড়াতে গিয়ে দু’চারদিন থেকে যাবে অমনটাও নয়। যাই হোক, আর যে নীতিতেই হোক মূলত পরিবারের সদস্যসংখ্যা হিসাবে তারা বাড়ি বরাদ্দ পেয়ে থাকে অথবা নির্ধারণ করে থাকে। তাই যখন চারজনের একটি দল প্যারিসে গিয়ে ভাইয়ের বাসায় উঠব এটা যেমন উচিত মনে হচ্ছিল না, তেমনি প্যারিসে যাব কিন্তু ভাইয়ের বাসায় না উঠে হোটেলে উঠব একথাও সাহস করে সবুজ ভাইকে বলতে পারছিলাম না। কিন্তু একটা সিদ্ধান্তে তো আসতেই হবে, তাই ফোনে সবুজ ভাইকে জানালাম এবার যেহেতেু আমি মাত্র দু’দিনের জন্য প্যারিসে এসেছি এবং সদলবলে ; তাই তার এলাকায় কাছাকাছি কোনো হোটেলে উঠব এবং পরে তার সাথে বাসায় গিয়ে দেখা করে আসব। আমার এই সিদ্ধান্তে যথারীতি সে প্রচণ্ড বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ, তার আপত্তি ও আবেগের কাছে আমার যুক্তি পরাজিত স্বাভাবিকভাবেই। তার এ ইমোশনটাও খুব একটা অযৌক্তিক নয়, প্রায় ২১ বছরের প্রবাসজীবনে তার ভাতিজা একমাত্র ইরফান ব্যতীত জ্ঞাতিগোষ্ঠীর আর কেউ প্যারিস যায়নি আর সহসা যাবে বলেও পরিকল্পনা করছে না। আমাদের ছেলেবেলাটা একই উঠোনকে কেন্দ্র করে বেড়ে ওঠার কারণে আমাদের পারম্পরিক সম্পর্কের শেকড়টা বেশ গভীর। তাই আমি নিজেও কিছুটা আবেগপ্রবণ। সবুজ ভাইয়ের পরিবার আর আমার সাথে থাকা ট্যুরমেটদের কষ্ট হবে জেনেও প্যারিসে সবুজ ভাইয়ের বাসায় আস্তানা গাড়ার সিদ্ধান্তে এলাম, এ ক্ষেত্রে আমার ট্যুরমেটদের সহযোগী মনোভাব ছিলো নিঃসন্দেহে। এছাড়া অন্য যে চারটি শহর দেখব বলে পরিকল্পনায় ছিল সেসব জায়গায় থাকা নিয়ে খুব একটা ভাবতে হলো না। কেননা, এয়ার বিএনবি আর বুকিং ডটকম এখানে খুবই সহায়ক দুটি সাইট।

অতঃপর এল সেই কাক্সিক্ষত দিনÑ অক্টোবরের ১ তারিখ, আক্ষরিক অর্থেই আমার আগের রাতটি অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর নির্ঘুম কেটেছে। সকাল ৯.৩০ মিনিটে ফ্লাইট। আমরা বেশ সকাল সকালই বেরিয়ে পড়লাম। বোধ করি এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা চারজন কারা তার কোনো পরিচয় মেলে ধরা হয়নি। বলছি, আমি আর বশির দুজন বাংলাদেশি সঙ্গে রয়েছে আবিসা আর সুস্মা নামের দুজন নেপালি তরুণী, তাদের একজন আবার সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ। স্বাভাবিকভাবেই তার উত্তেজনা বেশি। আমি নিজেও কিন্তু কম এক্সাইটেট নই, যার প্রমাণ নির্ঘুম রাত্রিযাপন। সে যাই হোক, সকাল সাতটায় আমরা ব্যাগ অ্যান্ড ব্যাগেজ বিমান স্টেশনে হাজির। বড়োজোর সব মিলিয়ে আমাদের আধঘণ্টা সময় লেগেছিল এয়ারপোর্টে পৌঁছুতে, আমরা আসলে বেশ আগেভাগেই এয়ারপোর্ট পৌঁছে গেছি। অবশ্য এ বিষয়ে আমার তাড়াই ছিল বেশি। কেননা, আমার প্রথম বিমান যাত্রাটা কেমন যেন একটু হজপজ হয়ে গেছিল, কারণও ছিল। আগেই বলেছি, ঢাকা থেকে নরওয়ে পর্যন্ত জার্নিটা ছিল আমার প্রথম আকাশপথে ভ্রমণ। এর আগে বাংলাদেশের আকাশেও ভ্রমণ করা হয়নি। সব প্রথম মিলে আমি নিজেও অনেকটা পাজ্ল ছিলাম। ইউরোপে বিবান যাত্রার আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, সেখানে আগেভাগেই অনলাইন বোডিং করা যায়। যা একদিকে যেমন সময় বাঁচায় তেমনি আগেভাগে সিট বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে। আমরা যেহেতু আগের দিন বোডিং করে নিয়ে ছিলাম তাই এরপোর্টে এসে বাকিটা সময় মূলত ঘুরেফিরে কাটালাম।

নির্ধারিত সময়ে আমাদের যাত্রা শুরু হলো বার্গেন থেকে প্যারিস ঘণ্টা দুয়েকের যাত্রা, ঢাকা থেকে বার্গেন ২২ ঘণ্টা জার্নির পর এ যাত্রা যেন শুরু না হতেই শেষ হয়ে গেল। প্লেনটি যখন ধীরে ধীরে মাটির দিকে নামছিল আমাদের চোখ তখন আইফেল টাওয়ার খুঁজে ফিরছিল। প্লেন ল্যান্ড করার এই সময়টি আমি খুব উপভোগ করি। বেশ উঁচু থেকে ধীরে ধীরে যখন ধরণীতে অবতরণ করে তখন মর্ত্যরে পৃথিবীর এক অন্যরকম রূপ ফুটে ওঠে, বিস্তৃত এক ল্যান্ডস্কেপ-কে পাখির চোখে দেখা সত্যি অসাধারণ। আমরা প্যারিসের ওরলে [Orly] এয়ারপোর্টে পৌঁছুলাম বেলা ১১.৩০ নাগাদ, সময় একটু এদিক-সেদিক হতে পারে। তারপর বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বের হতে হতে আরও প্রায় মিনিট বিশেক লেগে গেল। সবুজ ভাই আগেভাগেই এয়ারপোর্টে অপেক্ষায় ছিল। তবে, তাকে খুঁজে পেতে আমাদের একটু কসরতই করতে হলো বলা যায়। একে তো অচেনা জায়গা, উত্তর-দক্ষিণ জানা নেই। সেইসাথে নেটওয়ার্কজনিত জটিলতাও ছিল। তারপর অনেকটা পথ সিগ্ধ-নির্মল আকাশতলে আমরা সূর্যকে পাশ কাটিয়ে ছুটে চলেছি। দু’পাশে ইমারতের চেয়ে সবুজের সমারোহই বেশি। আর আকাশটা যেন অনেক বেশি নীল আর তার মাঝে সাদা মেঘের ছুটোছুটি ছেলেবেলার শরৎকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। এখন আমাদের শহুরেজীবনে শরৎ-কে শুধু কাশবনেই খুঁজে পাওয়া যায়। বোধ করি ঘণ্টা খানেক সময় লেগেছিল সবুজ ভাইয়ের বাসায় পৌঁছুতে। এলাকাটি শহরের একপাশে, মুল শহর থেকে একটু দূরে শহরতলীতে। অনেকটা কলোনি বা কোয়ার্টার টাইপ আবাসন। আমরা বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকে গাড়ি থেকে নামতেই কানে এলো তাসলিমা ফুনি। হঠাৎ এ চেনা ডাকে চকিতে পেছনে ফিরতেই দেখি ভাতিজা ইরফান, যেন সে চমকে দেবে বলেই ঘাপটি মেরে জালানার পাশে বসে ছিল। আসলেই সে বেশ এক্সাইটেট ছিল আমারও তাগিদ কম ছিল না প্রায় নয় বছর পর দেখা। সবুজ ভাই এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ঢাকায় ঘুরে গেলেও ইরফান তার নয় বছরের প্রবাস জীবনে তখনো পর্যন্ত একবারের জন্যও দেশে আসেনি।

বাসায় ঢুকতেই আরো দু’জন ভাতিজার উষ্ণ আলিঙ্গন আর ভাবির সহজ অভ্যর্থনায় আমাদের ইউরোপ ভ্রমণের শুভ সূচনা হলো। এরপর আমরা আমাদের থাকার জায়গা বুঝে নিয়ে সকলেই একটু ফ্রেস হয়ে নিলাম, তারপর একত্রে বসে বিস্তারিত পরিচয় পর্ব আর ছোটোখাটো আড্ডা হয়ে গেল। এরই ফাঁকে আমরা চার পরিযায়ী নিজেদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে নিয়ে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে খবরাখবর দিলাম। সকাল সকাল বের হয়ে আসার কারণে আমাদের করোরই ব্রেকফাস্ট খুব একটা যুতসই হয়নি, যদিও এতক্ষণ ভ্রমণের উত্তেজনায় তা টের পাচ্ছিলাম না ; এখন একটু থিতু হতেই পেট জানান দিচ্ছে। অবশ্য পেটপুজোর আয়োজনও সম্পন্ন, ভাবি আর ভতিজা ইরফান দু’জনে মিলে ততক্ষণে টেবিল সাজিয়ে নিয়েছে, তো আর অপেক্ষা কেন ?

এতক্ষণ তো বাড়ির অন্যদের সম্পর্কে অল্প-বিস্তর বলেছি, বাড়ির দুই জন গুরুত্বপুর্ণ সদস্যের বিষয়ে তেমন কিছু কিন্তু বলা হয়নি। সবুজ ভাইয়ে দুই ছেলে সলো আর সুপ্ত। বছর পাঁচেক আগে তাদের সাথে দেখা হলেও এতদিন পর তাদের আমাকে মনে থাকার কথা না। মাঝে-সাঝে ভিডিও কলে কথা হলেও তা মনে রাখার জন্য যথেষ্ট ছিল না বলেই আমার মনে হয়, তবু প্রথম দেখাতেই তারা আমাকে যেভাবে জড়িয়ে ধরল, আমি বেশ অবাক একইসাথে অভিভ‚ত। আসলে প্রবাসজীবনে ছোটোরা নিজেদের আপন জনের সান্নিধ্য থেকে একরকম বঞ্চিতই থাকে। শুধু মা আর বাবা এই নিয়ে তাদের আপন ভুবন।