ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

19 Dec 2021, 02:02 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

পর্ব ১৩

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


দুপরের খাওয়া-দাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই একটু আলসেমি আসে। মনে হয়, একটু গড়িয়ে নিতে পারলে ভালো হতো। আবিসা, সুষমা একটু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ খুঁজলেও আমার তাড়ায় তা আর হলো না। আমি আবার বেড়াতে গেলে পুরোটা সময় উসুল করে নেওয়ার পক্ষপাতি। বিশ্রাম তো বাড়ি ফিরে জমিয়ে নেওয়া যায়। যাই হোক, তাড়াহুড়া করেও খুব একটা লাভ হলো না। কারণ, ভাবিও আমাদের সাথে বেরুবেন এবং এটা তিনি তাৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিলেন, সবুজ ভাই আর শিশুরাসহ আমরা একসাথে বের হবো এটা আগে থেকেই ঠিক ছিল। গৃহিণীদের যা স্বাভাব, ঘর-গৃহস্থালী গুছিয়ে নিয়ে এটা-ওটা প্যাক করে বাকশো-প্যাটরা নিয়ে তৈরি হতে হতে বেলা বেশ পড়েই গেল। অক্টোবরের বিকেল এমনিতেই খুব বড়ো হয় না। আমরা বাসে করে যে পর্যন্ত গেলাম সেটা ছিল প্যারিসের মেয়র হাউজ তার ঠিক মুখোমুখি বিখ্যাত ল্যু’ভর মিউজিয়াম, না আজ আমরা মিউজিয়ামে যাচ্ছি না। আমাদের এখনকার গন্তব্য আইফেল টাওয়ার। অবশ্য বাসে যেতে যেতে চোখে পড়ে ইউরোপীয় স্থাপত্য শিল্পের বহু নিদর্শন। বাস্তিলদুর্গ ইতিহাসের বইয়ে পড়া নামটিতে চোখ আটকে যায়, ব্যস্ত নগরীর মাঝখানে ইতিহাসকে সাক্ষ্য দেওয়ার তাগিদে আজো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা যেখানটায় বাস থেকে নেমেছি সেখান থেকে আইফেল টাওয়ার খুব কাছে মনে হলেও প্রায় আধ ঘণ্টা সময় লেগে গেল পৌঁছুতে। এর মধ্যে অবশ্য সেইন নদীর তীর ঘেঁষে যাওয়ার পথে নদীর সাথে কিছুটা সময় কেটেছে। সেইন নদী, নামে নদী হলেও আমাদের ধানমন্ডি খালের কাছেই নার্স্য। অবশ্য শুধু প্যারিসের এই নদী নয়, পুরো ইউরোপজুড়ে আমি যত নদী দেখেছি সবগুলোর আকার-আকৃতি আদতে এ রকমই। তবু তাদের এই নদী নিয়ে যে আবেগ তা সত্যিই অতুলনীয়। সেইন নদীতে রয়েছে পর্যটকদের জন্য বোটিংয়ের ব্যবস্থা আর একটি মজার ব্যাপার হলো ইউরোপের প্রায় প্রতিটি নদীর উপর এপার ওপার যাওয়ার যে এক বা একাধিক ব্রিজ থাকে তার রেলিংগুলোতে নানান রঙের আর ঢঙে তালা ঝুলানো থাকে। এ গুলোকে ‘লাভলক’ বলে। সাধারণত নতুন প্রেমে পড়েছে এমন জুটিরা তাদের ভালোবাসার স্থায়িত্ব উইশ করে এ তালা ঝুলিয়ে থাকে। সেইন নদীর উপর এ ব্রিজটি ‘লাভলক ব্রিজ’ নামে পরিচিত। অনেকটা উপমহাদেশের বিভিন্ন মাজার চত্বরে থাকা অশত্থ বা অশোক গাছে সাধারণ মানুষ যেমন মনোবাসনা পূর্ণ হবে এই কামনায় রং-বেরঙের সুতো বেঁধে থাকে সেরকম।

আমরা যখন আইফেল টাওয়ারের কাছে, তখন সূর্য প্রায় অস্তগত। তবে, আলোচ্ছটা তখনো রয়ে যাওয়ায় এক মায়াবী পরিবেশে আমরা আইফেল টাওয়ারের বিশালত্ব দেখছি। আইফেল টাওয়ারের ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র এর বিশালত্ব অনুভব করা যায়, এর বিশেষত্ব এবং সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে বেশখানিকটা দূর থেকেই দেখা ভালো। আমরা অবশ্য কাছে দূরে দু’টি অবস্থান থেকে আইফেল টাওয়ারকে দেখার সুযোগই নিয়েছি। বিকেল থেকে সন্ধ্যা আমরা আইফেল টাওয়ারের এদিক সেদিক ঘুরে কাটালাম। বলা বাহুল্য, ইউরোপে ঘুরে বেড়ানোর ক্ষেত্রে দু’পা-ই ভরসা, পায়ের উপর এই নির্ভরতা পেটের খিদেটাকে বাড়িয়ে দেওয়ার একটি নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। এত কথা বলার মানে হচ্ছে দুপুরের খাবার এরই মধ্যে হজম হয়ে গেছে। এখন কিছু খেতে হবে। আগেই বলেছি ইউরোপে যখন-তখন যেখানে-সেখানে চাইলেই খাবার জোটে না, এমন না যে সেখানে রেস্টুরেন্ট বা খাবারের দোকানের অভাব রয়েছে বরং পর্যটনকেন্দ্রগুলো ঘিরে খাবারের দোকানগুলো বেশ সেজেগুজেই রয়েছে, যদিও তা নির্দিষ্ট স্থানে এবং শৃঙ্খলা মেনে, কিন্তু হালাল খাবার খুবই দুষ্প্রাপ্য। তবে হাঁটতে হাঁটতে কাছাকাছিই একটি ফাস্টফুডের দোকান পাওয়া গেল, সেখানে বার্গার স্যান্ডুইচের পাশাপাশি ফ্রেঞ্চফ্রাই বিক্রি হতে দেখে আমরা আহ্লাদে আটখানা, ফ্রান্সে এসে ফ্রেঞ্চফ্রাই খাওয়ার এ সুবর্ণ সুযোগ আমাদের কাছে যেন মেঘ না চাইতে জল হয়ে ধরা দিল। তবে মুখে দেওয়ার পর সকল আহ্লাদ পানি হয়ে গেল, আসলে বাঙালির কাছে রসনার আস্বাদই প্রথম পছন্দ, খাবারের নাম বা জাতীয়তা যাই হোক না কেন। খাবারের স্বাদ বাড়ানোর জন্য এর ফিউশন তৈরিতে বাঙালির জুড়ি নেই। তাই নামে চাইনিজ হলেও আমরা যে চাইনিজ খাবার খাই তা আদতে আমাদের দেশে এসে এখানকার ঘরনার হয়ে গেছে। ফ্রেঞ্চফ্রাই খেয়ে মনে হলো আমাদের দেশে তৈরি ফ্রেঞ্চফ্রাই অনেক বেশি মজাদার। আরেকটি কথা যা আমার জানা ছিল না, ফ্রেঞ্চফ্রাই-এর অরিজিন কিন্তু ফ্রান্স না, এটা বেলজিয়ামের খাবার।

খাবারে রসনার তৃপ্তি না হলেও আপাত ক্ষুধা তো মিটল, এরপর আবার পায়ে হেঁটে চলা, পথ একটাই- সেইন নদীর তীর ঘেঁষে। আমরা চলেছি, গন্তব্য ইন্ডিয়া গেট অবধি। ভাবছেন প্যারিসে আবার ইন্ডিয়া গেট এল কোথা থেকে ? তাই তো ! আমারও খটকা লেগেছিল, এ আবার কী ? আসলে এটা একটি স্মৃতিস্তম্ভ অথবা সৌধ যাই বলি না কেন, মূলত প্রথম বিশ^যুদ্ধে নিহত ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান [আর্মির] সৈনিকদের স্মরণে নির্মিত। পথে চলতে চলতে আমরা পন্ট ডি আলমা টানেলও দেখে নিলাম, এই সেই বিশেষ বা কুখ্যাত স্থান, যেখানে প্রিন্সেস অব ওয়েলস ডায়নার গাড়িটি দুর্ঘটনায় পড়েছিল। ইফা ফ্যাশন স্টুডিও-টাও এই পথেই পড়ে। যেখানে তৈরি হয় বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার, আয়োজন করা হয় প্যারিস ফ্যাশন উইকের বিভিন্ন প্রদর্শনী।

ইন্ডিয়া গেট পৌঁছুতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এল, বিকেল বিকেল যখন বাড়ি থেকে বেরুচ্ছিলাম তখন বেশ একটা আরাম দায়ক আবহাওয়া ছিল। বাংলাদেশে ডিসেম্বরের শুরুতে যে রকম নরম-নরম শীত, অনেকটা সে রকম। তাই নিজেদের পরিচ্ছদ প্রস্তুতিও সে অনুযায়ী ছিল। কিন্তু রাত নামতেই শীতের তীব্রতা যে কর্কশভাবে শাষাচ্ছে আর তো টেকা যাচ্ছে না। মূলত শীতের শাষানিতেই সেদিনকার মতো পথপরিক্রমায় ক্ষ্যান্ত দিয়ে ঘরে ফিরতে হলো।

পরদিন বেশ ভোর ভোর বের হবো এমন আশা নিয়ে ঘরে ফিরে চটজলদি রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়লাম। সকাল সকাল ঘুমও ভাঙল, কিন্তু যা হয় আরকি, একজন তৈরি হলেও আরেকজনের দেরি হয়, এছাড়াও ভাবির আদর-আপ্যায়নের মধুর যন্ত্রণাও কম ছিল না। সকালের নাস্তা খেলামই পেটপুরে, সারাদিনের জন্য বের হচ্ছি শুনে উনি আবার দুপুরের খাবার প্যাক করে দিলেন এই করেও সময়ের কিছুটা খরচ হলো। যাই হোক, একসময় সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ; উদ্দেশ্য ল্যু’ভর মিউজিয়াম। কিন্তু বলে না- কপালে না থাকলে ঘি। সেদিন ছিল মঙ্গলবার, ল্যু’ভর সাপ্তাহিক ছুটির দিন। এ জানা তথ্যটা কেন যে সবাই বেমালুম ভুলে গেল, হয়ত দিনের হিসাবে কিছু গোলমাল হয়ে থাকবে। মোনালিসার সাথে সাক্ষাৎ হবে এই আশায় আমাদের মধ্যে একটি চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল, সব উৎসাহ আর উত্তেজনা জলে ধুয়ে আমরা ল্যু’ভর কাছাকাছি একটি খোলা উদ্যানে গিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে কিছুটা সময় কাটিয়ে মনের দুঃখ লাঘবের একটা চেষ্টা করে গেলাম। টিউলিরিজ গার্ডেন হলো একটি সরকারি উদ্যান এটি দুটি অংশে যার একটি অংশ সব সময়ের জন্য উন্মোক্ত অন্য অংশটি অবশ্য দেখা হয়নি তাদের সাপ্তাহিক ছুটির কারণে। ইউরোপের যে, কয়েকটি উদ্যান আমার দেখার সুযোগ হয়েছে সেখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, এরা উপাদানের বৈচিত্র্য থেকে উপস্থাপনার বৈচিত্র্যকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। টিউলিরিজ গার্ডেনের কথাই যদি বলি এখানে খুব ভিন্নধর্মী গাছের বিপুল সমাহার রয়েছে বলা যাবে না তবে এর আর্কিটেকচারে রয়েছে বৈচিত্র্য।

আমাদের দেশের মতো এখানেও বিভিন্ন পর্যটন স্পটে হকার বা স্ট্রিট মার্কেটের দেখা পাওয়া যায়। সকাল সকাল বেরিয়েছি, তবে সকালের সূর্যের সতেজভাবটা অনুপস্থিত বরং বাতাস যেন সূর্যের প্রখরতাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে নিজের আধিপত্য বিস্তারে বদ্ধপরিকর। অর্থাৎ শীতের বাতাস কানে ঝাপটা দিচ্ছে কিন্তু সাথে কানটুপি নেই। হকারের প্রসঙ্গ এ কারণেই টেনে আনা, টিউলিরিজ গার্ডেনেই টুপি বিক্রেতা [হকার] তখন আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিল। বেশ স্টইলিস্ট একটা কানটুপি কিনে নিলাম, দাম কিন্তু মন্দ না, গুনে গুনে আট ইউরো পুরো আটশত টাকা। যেহেতু ল্যু’ভর দেখা হলো না তাই সারাদিনের পরিকল্পনায় একটা হজপজ হয়ে গেল, স্বল্প সময়ের সফরে পরিকল্পনায় এ ধরনের ব্যাঘাত সারাদিনের সমস্ত আয়োজনেই প্রভাব ফেলে। এখন আবার নতুন করে প্লান সাজাতে বসলাম। যেহেতু হাতে বাড়তি সময় রয়ে গেল, তাই আমার কিছুক্ষণ এই উদ্যানেই কাটিয়ে দিলাম। অনেকটা দলছুট হয়ে নিজের মতো করে কাটানো সময়টা কিন্তু বেশ কেটেছে। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা এখানে সেখানে নিজ মনে খেলছে, কিছুক্ষণ তাদের খেলার দর্শক হয়ে একসময় আমিও তাদের খেলার সঙ্গী হয়ে গেলাম।  [চলবে]