প্রান্ত থেকে কেন্দ্রের অধিশ্বর : হাসান আজিজুল হক -মনি হায়দার

19 Dec 2021, 02:21 PM শ্রদ্ধাঞ্জলি শেয়ার:
প্রান্ত থেকে কেন্দ্রের অধিশ্বর : হাসান আজিজুল হক -মনি হায়দার

বাংলা কথাসাহিত্যের বরপুত্র হাসান আজিজুল হক সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন, জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহে। এবং অস্বীকার করার উপায় নেই, তিনি যথেষ্ট বয়সে উপনীত হয়েছিলেন। যেহেতু মৃত্য অনিবার্য, অমোঘ- সুতরাং পরিণত মৃত্য স্বস্তিদায়ক। অনেকে প্রচলিত ধারায় প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, অপূরনীয় ক্ষতি হয়েছে হাসান আজিজুল হকের প্রয়াণে। এবং বিশিষ্ট কেউ প্রয়াত হলে জীবিত বিশিষ্ট জনেরা, এসব প্রচলিত বাক্য বলে থাকেন। প্রশ্ন, এসব ছেদো বাক্য উদগীরণ করে কি কখনো প্রয়াতজনকে ফিরিয়ে আনা যায় জীবিতলোকে পুনর্বার ? যায় না। কারণ, মহাজীবনের কাছে মানুষের এই জীবন খুব সীমিত। সুতরাং নতুন করে ভাবনার কেন্দ্রে চলে যাওয়া যায়।

বরং নমস্য কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হককে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করতে পারি, স্মরণে রাখতে পারি- সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। কীভাবে সম্ভব হাসানকে স্মরণে রাখা ? হাসান আজিজুল হক কী রেখে গেছেন ? তিনি রেখে গেছেন প্রচুর গল্প, দুটি উপন্যাস-‘সাবিত্রি উপাখ্যান’ ও ‘আগুনপাখি’। সেইসঙ্গে বিকল্প চিন্তার বেশ কয়েকটা প্রবন্ধ-গ্রন্থ। প্রবন্ধ পুস্তকের নামগুলো পড়লেই হাসান আজিজুল হকের চেতন জগতের মর্মপীড়ার সঙ্গে আমরা পরিচিত হতে পারি। প্রবন্ধ পুস্তক : কথাসাহিত্যের কথকতা, চালচিত্রের খুঁটিনাটি, অপ্রকাশের ভার, সক্রেটিস, অতলের আধি, কথা লেখা কথা, লোকযাত্রা- আধুনিক সাহিত্য, একাত্তর : করতলে ছিন্নমাথা, ছড়ানো ছিটানো, কে বাঁচে কে বাঁচায়, বাচনিক আত্মজৈবনিক, চিন্তনকণা, রবীন্দ্রনাথ ও ভাষা ভাবনা। সর্বমোট তেরোটি প্রবন্ধ পুস্তকের মধ্যে আমরা, ছেঁদো বাক্যর মালিকেরা কয়টা পড়েছি ? পড়িনি অনেকটাই- পড়ার অভ্যাসটাই তো আমরা খেয়ে ফেলেছি অনেক আগেই। এ একধরনের মুখস্থ আপ্ত বাক্য উচ্চারণ করে বাহবা কুড়াই। খুব সস্তা আবেগে ইন্টারনেটে মগ্ন অন্যের পোস্ট দেখার ও লেখার জন্য। একইসঙ্গে থাকে হাসানের সঙ্গে কার কার ঘনিষ্ঠ ছবি আছে, সেইসব ছবির পোস্ট দেওয়ার নিকৃষ্ট হিড়িক।

হাসান আজিজুল হকের অনেক কীর্তি।

কিন্ত শ্রেষ্ঠ কীর্তি প্রান্তে বসবাস করে কেন্দ্রকে শাসন করার দুর্জয় ক্ষমতা। বাংলাদেশ পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায়, আয়াতনে ক্ষুদ্র। এই ক্ষুদ্র দেশটির কেন্দ্র- সকল কিছুর ক্ষমতা রাজনীতি ব্যবসা বাণিজ্য সংস্কৃতির লালন পালন- সবই কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত, মানে ঢাকা শহরের মধ্যে ঘুরপাক খায়। আমরা ঢাকা শহরের নানাবিধ নিন্দায় মুখর থাকি আবার জীবনের নান্দীপাঠের প্রয়োজনে সেই ঢাকা শহরের জঞ্জালের মধ্যেই ফিরে ফিরে আসি। ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের সঙ্গে ইঁদুর বিড়ালের অঙ্কের জটিলতায় সম্পর্ক নির্ণয় করি। কিন্তু হাসান আজিজুল হক এই কুক্ষিগত ভরকেন্দ্রের বাইরে, সুদূর বিভাগীয় শহর রাজশাহীকে ভরকেন্দ্র তৈরি করেছিলেন নিজস্ব চৈতন্যে আর সংস্কৃতি চিন্তার ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। সবাই রাজধানীতে আসে, কারো সঙ্গে দেখা করতে, কারো সঙ্গে সর্ম্পকের জটিলতায় নিজস্ব রসায়ন তৈরি করতে, কেউ আসে ক্ষমার সঙ্গে গুড়ের মিশেলে পায়েস রান্না করতে, সেই মানচিত্রে একমাত্র বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনড়, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হাসান আজিজুল হক। আমি যাব না, তোমরা আসো আমার কাছে, কারণ, আমি ক্ষমতার কেন্দ্র পছন্দ করি না। আমার কেন্দ্র মানুষ- সাধারণ মানুষ, গবীর গবুরো, খেটে খাওয়া মানুষ- আমার কেন্দ্র উজান।

‘উজান’ হাসান আজিজুল হকের বাড়ির নাম। ‘উজানে’ আজকাল কে বায় নৌকা ? সবাই স্রোতের সঙ্গে স্রোতের মিঠাই মণ্ডামাখা স্রোতের রাতের জলে ভেসে যেতে আকুল, ব্যাকুল। সুযোগ না পেলে আছাড়ি-পাছাড়ি কান্না কাতর অনুনয় বিনয়, পা ধরাধরি। সেই বিপুল লোভাক্রান্ত স্রোতের রাতের বাইরে দাঁড়িয়ে নিজের সৃজনকলায় নির্মাণ ও নির্মিতির কাঁটা কম্পাসে হাসান আজিজুল হক বলেন, ‘আমি এখানেই থাকব’ এবং হাসান আজিজুল হক কথা রেখেছেন। তিনি উজানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মহাকালের শূন্যরেখায় হারিয়ে গেছেন কিন্ত রেখে গেছেন প্রান্তিকজনের জন্য দৃঢ়তার অমলিন মানচিত্র। 

বাংলাদেশের বা তৃতীয় বিশ্বের মানুষ মাত্রই ‘হাসপাতাল’ সর্ম্পকে ধারণা রাখেন। মানুষ রোগাক্রান্ত হলে হাসপাতালে যায়, রোগ মুক্তির আশায়। কিন্ত সেই ‘হাসপাতাল’ই যখন রোগাক্রান্ত, ধুকে ধুকে হাড় জিরজিরে কুকুরের স্টাইলে জিহ্বা বের করে ঝিমায়, আগত রোগীদের অবস্থাটা বোঝা যায় না- রুগ্ন রক্তখচিত সেই চিত্রটা বোঝার জন্য, দেখার জন্য হাসান আজিজুল হকের ‘পাতালে হাসপাতালে’ গল্পটা মানচিত্রের সিনেমা হতে পারে। গল্পের মানচিত্র থেকে পাঠ নিই-

‘তাড়াতাড়ি করে লোক তিনটে ঘাড় থেকে জোয়াল ফেলে দিলো। তাদের কাঁধ থেকে লোকটা ধুপ করে মেঝেয় পড়ে। তার যে-পাটি বুড়ো চাষীটার কাঁধে আঁকশির মতো আটকানো ছিল, সেই পাটিকে বাঁচাতে বুড়ো হাটু গেড়ে বসতে যায়। এই করতে গিয়ে কোমরের লুঙ্গিটার কষি আলগা হয়ে খুলে পড়লো। বুড়ো হুমড়ি থেয়ে মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে। লুঙ্গি সড়াৎ করে হাঁটুর কাছে চলে আসে। এমারজেন্সির লোকটি তার অনেক আগেই টেবিলে মন দিয়েছে। সেখানে কি মধু আছে, সেই জানে। চাষী তিন জনে গোছগাছ হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে। একজন মাথা থেকে গামছা খুলে নিয়ে হাওয়া খায়। বুড়ো লুঙ্গি ঠিকঠাক করে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে লোকটি টেবিলের উপর দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাদের দিকেই চেয়ে আছে।

সে বলে, হুজুর ?

এমারজেন্সি দেয়ালের দিকে মুখ ফেরালো।

যাকে বয়ে আনা হয়েছে তার একটা পা ফুলে ঢোল হয়ে আছে। সেই পাটা মেঝেয় লম্বা করে দিয়ে অন্য পাটি গুটিয়ে দেয়ালে আধা হেলান দিয়ে চুপচাপ শুয়ে চোখ পিটপিট করতে থাকে। ফোলা পায়ের তলা থেকে রস গড়িয়ে পড়ছে। একটা বড়ো নীল মাছি দুবার তারে পায়ের তলায় বসে খোঁজখবর নিয়ে তার আপন লোকজনদের খবর দিতে চলে গেল। পুরো বাহিনী এসে পৌঁছুতে দেরি হলো না।

কী আশ্চার্য! এমারজেন্সির লোকটা আবার জিজ্ঞেস করলো- কী ব্যাপার ?

বুড়ো ফের বলে, হুজুর ! অন্য দুজন চাষী কুতকুতে বিষণ্ন চোখে চেয়ে রইলো। 

কোথা থেকে আসা হয়েছে ?

তালপুকুর থিকা- বুড়ো বলে।

পায়ে কী হয়েছে ?

হুজুর স্যার, বুড়ো শুরু করে, লোকটা মরে যাচ্ছে পায়ের ব্যাদনায়-

হুড়মুড় করে তিন চারজন লোক ঢুকলো ঘরে। তাদের মধ্যে সামনের ছোকরা উৎসাহে টগবগ করছে। সোজা টেবিলের কাছে এগিয়ে এসে বলে, দেখেছেন ?

এমারজিন্সের কর্তব্যরত বলে, কী নখ খুটতে থাকে।

দেখেন নি, আজকের কাগজ দেখেন নি ? বলতে বলতে সে টিবলের উপর পা ঝুলিয়ে বসে পড়ে। বাকি কজন তাড়াতাড়ি চেয়ার বেঞ্চি টেবিলের কোণ দখল করে উৎসুখ মুখে পরস্পরের দিকে চেয়ে থাকে।

আজকের কাগজে বেতনের স্কেল দিয়েছে, দেখেন নি ?’

হাসান আজিজুল হকের ‘পাতালে হাসপাতালে’ গল্পটা বেশ বড়ো। এই গল্পের মধ্যে দিয়ে তিনি প্রান্তিক বিপন্ন কিন্নর তিনজন চাষীর প্রতিছায়ার দেয়ালে শব্দের গাঁথুনিতে তৈরি করেছেন, প্রান্তজনের বাস্তব মানচিত্র। বাংলাদেশের নিরন্ন কোটি কোটি মানুষের প্রতিদিনের নারকীয় বয়ান... তো তিনিই তো প্রান্তজনের প্রতীক হবেন। হয়েছেনও। ‘মা মেয়ের সংসার’ গল্প তো আরও ভয়ানক মানচিত্র ঘোলাটে বিক্ষত বাংলাদেশের অস্থি আর শয্যার...

‘ভূষণের একদিন’ মুক্তিযুদ্ধের গল্পে তিনি দেখিয়েছেন ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হায়েনা হারামজাদা সৈন্যদের আগ্রাসী আক্রমণে বাংলার নিপীড়িত সাধারণ দুঃখী মানুষ কীভাবে মৃত্যুশীতলতার মধ্যে প্রবেশ করেছে, কেমন করে লাঞ্ছনার বিষাক্ত পুকুরে ডুবে জীবন ধারণের চেষ্টা করেছে। ‘মন তার শঙ্খিনী’ গল্পে হাসান আজিজুল হক দেখিয়েছেন নারীর শঙ্খিনী মনের বিচিত্র গতি-প্রকৃতি। নারী কেবল সুন্দরের আধার নয়, নারী প্রতিশোধেরও নগ্ন ইস্পাত। ‘লাল ঘোড়া আমি’ অসামান্য কিশোর উপন্যাস হাসান আজিজুল হকের। মানব চরাচরের বিচিত্র বিবিধ জীবনাচারের মধ্যে লাগামহীন ক্ষমতার যে চর্চা ও সেই চর্চার মধ্যে মৃত্যুর বীজ লুকিয়ে থাকে- তারই বিস্ময়কর প্রকাশ ‘লাল ঘোড়া আমি’।

কেন্দ্রকে অস্বীকার করার স্পর্ধা অনেকেই রাখেন না। কেউ কেউ রাখেন, বিশ্ব বাংলাসাহিত্যের ধারাবাহিকতায় হাসান আজিজুল হক একজনই, তিনি প্রান্তে থেকে কেন্দ্র শাসন করেছেন, নিজের তেজ ও সৃজনশীলতার বিক্রিয়ায়। হাসান আজিজুল হক বাংলার মানচিত্রের প্রান্তিকজনের প্রামাণ্য কথাশিল্পী। 

লেখক : কথাসাহিত্যিক