টি-২০ বিশ্বকাপ, ২০২১-এর সেরা খেলোয়াড় ডেভিড ওয়ার্নার...

22 Dec 2021, 12:52 PM ক্রীড়াভুবন শেয়ার:
টি-২০ বিশ্বকাপ, ২০২১-এর সেরা খেলোয়াড় ডেভিড ওয়ার্নার...

টি-২০ বিশ্বকাপে ধারাবাহিক ভাবে দাপুটে ব্যাটিং করেছেন ডেভিড ওয়ার্নার। দেশকে প্রথমবারের মত কুড়ি ওভারের জেতানোর অন্যতম যোদ্ধা এই অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার। সঙ্গত কারণেই ওয়ার্নারকে টুর্নামেন্টের সেরা প্লেয়ার হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে। ওয়ার্নার টি-২০ বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান শিকারি হয়েছেন। ২৮৯ রান এসেছে তার ব্যাট থেকে। ওয়ার্নার বিশ্বকাপ ফাইনালে। নিউজিল্যান্ডের ১৭২ রান তাড়া করতে নেমে ৩৮ বলে ঝোড়ো ৫৩ রানের ইনিংস খেলেন। ওয়ার্নারের শুরুটা ছিল চমৎকার। অন্যদিকে কেন উইলিয়ামসন ৪৮ বলে ৮৫ রানের অধিনায়কোচিত ইনিংস খেলেও ট্র্যাজিক নায়ক হয়েই থেকে গেলেন...

গত ১৪ বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দলের যে অপেক্ষার প্রতীক্ষা ছিল তার অবসান হলো গত ১৪ নভেম্বর রবিবার টি-২০ বিশ্বকাপ, ২০২১ শিরোপা জেতার মধ্যে দিয়ে। বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী এই দলের ঝুলিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের কোনো শিরোপা ছিল না। এবারের বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা নিজেদের দখলে নেয় তারা। এই ম্যাচের পরে, অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান ডেভিড ওয়ার্নারকে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের জন্য বেছে নেওয়া হয়।
ডেভিড ওয়ার্নার এই টুর্নামেন্টের ৭ ইনিংসে ২৮৯ রান করেছেন, যার মধ্যে ৩টি হাফ সেঞ্চুরি রয়েছে। এই দুর্দান্ত পারফর্মেন্সের জন্য তিনি টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। এতে খুশি ক্যাঙ্গারু শিবির।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ঠিক আগেই শেষ হয়েছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগের [আইপিএল] আসর। সেখানে সানরাইজার্স হায়েদ্রাবাদের হয়ে সাইড বেঞ্চেই সময় কাটিয়েছেন ডেভিড ওয়ার্নার। ফর্মহীনতার কারণে তাকে খেলানো হয়নি তখন।
অথচ তিনিই কি-না জাতীয় দলের জার্সিতে যেন পুরোপুরি ভিন্ন ক্রিকেটার। ধারাবাহিক উজ্জ্বল পারফর্মেন্সে জিতে নিয়েছেন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে এ পুরস্কার জিতলেন তিনি।
বিশ্বকাপের গুরুত্বপূর্ণ সব ম্যাচে মহামূল্যবান একেকটি ইনিংস এসেছে ওয়ার্নারের ব্যাট থেকে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ফাইনালেও তার ব্যাট থেকে এসেছে ৩৭ বলে ৫৩ রানের ঝকঝকে ও গুরুত্বপূর্ণ একটি ম্যাচ উইনিং ইনিংস।
সবমিলিয়ে বিশ্বকাপের ৭ ম্যাচ খেলে তিন ফিফটিতে ২৮৯ রান করেছেন অস্ট্রেলিয়ান এই ওপেনার। যা কি-না এবারের আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান। ফাইনালে ৫৩ রান করার আগে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনালেও করেছিলেন ৪৯ রান। এবারের বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ ইনিংস ৮৯ রানের। যা তিনি খেলেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সুপার টুয়েলভের শেষ ম্যাচটিতে। সেই ম্যাচে বড়ো জয়ের কল্যাণেই সেমির টিকিট নিশ্চিত করেছিল অস্ট্রেলিয়া।
অর্থাৎ পরপর তিন ম্যাচে ওয়ার্নারের ব্যাট থেকে এসেছে ৮৯, ৪৯ ও ৫৩ রানের অসাধারণ ৩টি ইনিংস। যাতে ভর করে বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় বেছে নিতে কোনো সমস্যাই হয়নি দায়িত্বে থাকা নির্বাচকমণ্ডলীকে।
ফাইনালে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জেতে অস্ট্রেলিয়া। শিরোপা জয়ের লড়াইয়ে ব্যাট হাতে দলকে পথ দেখান ওয়ার্নার। ৩৮ বলে ৪টি চার ও ৩টি ছক্কায় ৫৩ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন বাঁহাতি এই ওপেনার।

এক নজরে ডেভিড ওয়ার্নার
ঘরোয়া ক্রিকেট : আক্রমণাত্মক বামহাতি ব্যাটিংয়ে অভ্যস্ত ওয়ার্নার। পাশাপাশি দ্রুত দৌড়িয়ে ফিল্ডিং করেন এবং মাঝেমাঝে স্পিন বোলারের ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হন তিনি। অফ-স্পিন বোলিংয়ের সঙ্গে লেগ স্পিন বোলিংয়ের যোগসূত্র রক্ষা করেন সবসময়। ১৭০ সেন্টিমিটারের দীর্ঘদেহী শরীরে শক্তিশালী হাতের ব্যাটিংয়ে বলকে শূন্যে ওঠাতে পারেন অবলীলায়। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে নিউ সাউথ ওয়েলসের পক্ষে টোয়েন্টি-২০ আন্তর্জাতিকে শন টেইটের বলকে অ্যাডিলেড ওভালের ছাদে পাঠান। সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডেও তিনি একই বোলারকে মোকাবেলা করে সফলকাম হন। তাসমানিয়ার বিপক্ষে অপরাজিত ১৬৫ রান করে একদিনের সর্বোচ্চ রান করেন ব্লুজের খেলোয়াড় হিসেবে। পরবর্তীসময়ে ৫৪ বলে ৯৭ রান করে অল্পের জন্য অস্ট্রেলীয় ঘরোয়া ক্রিকেটে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়তে পারেননি।
ওয়ার্নার ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম সফল ব্যাটসম্যান। তিনি তিনটি আসরে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হিসেবে অরেঞ্জ ক্যাপ লাভ করেন এবং ৫,০০০-এর অধিক রান করেন।

আইপিএল : ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ফেব্রুয়ারি ওয়ার্নার সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের অধিনায়ক হিসেবে কেন উইলিয়ামসনের স্থলাভিষিক্ত হন। এছাড়া ৮ অক্টোবর ওয়ার্নার আইপিএল-এর ইতিহাসে প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে ৫০টি পঞ্চাশোর্ধ্ব রানের ইনিংস খেলেন। এই ম্যাচে তিনি ৪০ বলে ৫২ রান করেন এবং তার দল কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে ৬৯ রানের জয় পায়। ১৮ অক্টোবর ওয়ার্নার প্রথম বিদেশি খেলোয়াড় এবং সবমিলিয়ে ৪র্থ খেলোয়াড় হিসেবে আইপিএল-এ ৫০০০ রান সম্পন্ন করেন। এই ম্যাচে তিনি ৩৩ বলে ৪৭ রান করেন কিন্তু তার দল কলকাতা নাইট রাইডার্সের কাছে সুপার ওভারে হেরে যায়। এছাড়া তিনি সবচেয়ে কম ইনিংস [১৩৫] খেলে ৫,০০০ রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট : ঘরোয়া ক্রিকেটে তার এ সাফল্যের প্রেক্ষিতে জানুয়ারি, ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অস্ট্রেলিয়ার টোয়েন্টি-২০ দলে অন্তর্ভুক্ত হন। ১১ জানুয়ারি, ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টোয়েন্টি-২০ আন্তর্জাতিকে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অভিষিক্ত হন। টোয়েন্টি-২০ আন্তর্জাতিক ইতিহাসে দ্বিতীয় দ্রুততম অর্ধ-শতক করেন ৪৩ বলে ৮৯ রান, যাতে ৭টি চার ও ৬টি ছক্কার মার ছিল। ওয়ার্নার ক্রিস গেইলের শতকের চেয়ে মাত্র ১১ রান দূরে ছিলেন। অভিষেকে তার ৮৯ রান ছিল টোয়েন্টি-২০ আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ও পঞ্চম সমতাসূচক সর্বোচ্চ স্কোর। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে ২৩ ফেব্রুয়ারি, টি-২০-তে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মাত্র ২৯ বলে ৬৭ রান করেন। তার ৫০ রান আসে মাত্র ১৮ বলে। এর ফলে তিনি তার নিজস্ব ১৯ বলের রেকর্ড ভঙ্গ করেন ও যুবরাজ সিংয়ের পর দ্বিতীয় দ্রুততম অর্ধ-শতক করেন।
ট্রান্স-তাসমান ট্রফির ১ম টেস্টে শেন ওয়াটসনের আঘাতপ্রাপ্তিজনিত অনুপস্থিতিতে টেস্ট অভিষেক ঘটে ওয়ার্নারের। ১ ডিসেম্বর, ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে কুইন্সল্যান্ডের ব্রিসবেনে অনুষ্ঠিত ১ম টেস্টে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তার এই অভিষেক। প্রথম ইনিংসে তিনি মাত্র ৩ রান করেন। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র চার বলে অপরাজিত ১২ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেন। পুল শটের মাধ্যমে জয়সূচক রানটি করেন তিনি। ১২ ডিসেম্বর, ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তার প্রথম শতক করেন। হোবার্টে অনুষ্ঠিত নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তিনি ১২৩ রানে অপরাজিত থাকেন। এর ফলে তিনি ৬ষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে চতুর্থ ইনিংসে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যাটিং করেন।

ক্রিকেট বিশ্বকাপ : ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ক্রিকেট বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের লক্ষ্যে ১১ জানুয়ারি, অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট কর্তৃপক্ষ অস্ট্রেলিয়া দলের ১৫-সদস্যের চূড়ান্ত তালিকা জনসমক্ষে প্রকাশ করে। এতে তিনিও অন্যতম সদস্য মনোনীত হন। ৪ মার্চ, ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে আফগানিস্তানের বিপক্ষে নিজস্ব সর্বোচ্চ ও অস্ট্রেলিয়ার ওডিআই ইতিহাসে ২য় সর্বোচ্চ ১৭৮ রান সংগ্রহ করেন। তার উপরে রয়েছে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে শেন ওয়াটসনের ১৮৫ রান। এর ফলে বিশ্বকাপের ইতিহাসে অস্ট্রেলিয়া ৪১৭/৬ সর্বোচ্চ রান তোলে। খেলায় তার দল ২৭৫ রানের বিশাল ব্যবধানে জয়সহ বিশ্বকাপে সর্ববৃহৎ জয় পায়। এ জয়টি একদিনের আন্তর্জাতিকে অস্ট্রেলিয়ার সর্বোচ্চ ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অঙ্গনে দ্বিতীয় বৃহত্তম জয়। এছাড়া ২০১৭-’১৮ খ্রিষ্টাব্দে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের ভারত সফরে ব্যাঙ্গালুরু একদিবসীয়তে তিনি ১২৪ রানের দুরদান্ত ইনিংস খেলেন। ম্যাচের সেরা নির্বাচিত হন এবং সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার একমাত্র জয়টি আসে এই ম্যাচে।

উইকেট রক্ষণ : অক্টোবর, ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টের দ্বিতীয় দিনে ব্রাড হাড্ডিন কাঁধে আঘাত পেলে, ডেভিড ওয়ার্নার ও গ্লেন ম্যাক্সওয়েল যৌথভাবে ৯৬তম ওভার থেকে ১২২তম ওভার পর্যন্ত এবং পাকিস্তানের প্রথম ইনিংসের ১৬৩তম ওভার পর্যন্ত এ দায়িত্বে ছিলেন। পাকিস্তানের দ্বিতীয় ইনিংসের শুরু থেকে ৫১তম ওভার পর্যন্ত ওয়ার্নার উইকেট রক্ষণে ছিলেন। এ পর্যায়ে ম্যাক্সওয়েল ৬১তম ওভারে ইনিংস শেষ হওয়া পর্যন্ত উইকেটের পিছনে ছিলেন। ওই সময়ে ওয়ার্নার উইকেট-রক্ষক হিসেবে একটি ক্যাচ নিয়েছিলেন।
গ্রন্থনা : শহিদুল ইসলাম এমেল
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া