একদল স্বপ্নদ্রষ্টা যুবকের ভিন্নধর্মী আয়োজন পাকশী নাইন্টি’স

25 Jan 2022, 03:56 PM খবর শেয়ার:
একদল স্বপ্নদ্রষ্টা যুবকের ভিন্নধর্মী  আয়োজন পাকশী নাইন্টি’স

‘স্মৃতির শহরে দুরন্ত কৈশোরে’ এই শিরোনামকে হৃদয়ে ধারণ করে পাবনা জেলার, ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশী রেলওয়ে ফুটবল গ্রাউন্ডে একদল স্বপ্নদ্রষ্টা যুবক, যারা জন্মস্থান, খেলার মাঠ, শৈশবের দুরন্তপনা-সহ নানা স্মৃতিতে বিজড়িত, সেইসব কয়েকজন বন্ধুর পরিকল্পনায় আয়োজন করে ভিন্নধর্মী অনুষ্ঠান পাকশী নাইন্টিই’স। পাকশীর বিভিন্ন স্কুল থেকে পাস করা নানা বয়েসি প্রায় সহস্রাধিক মানুষ এই আয়োজনে অংশগ্রহণ করেন। বিস্তারিত লিখেছেন শেখ সেলিম...


‘মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে

স্মৃতিগুলো যেন আমার এ হৃদয়ে, বেদনার রঙে রঙে ছবি আঁকে’

-হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

শৈশব প্রতিজন মানুষের জীবনের মধুর একটি সময়। শৈশব কালের দিনগুলো ছিল দুরন্তপনা, দুষ্টুমি আর সারাদিন ছোটাছুটি করে দৌড়ে বেড়ানোর এক অন্যতম মুহূর্ত। প্রতিটি মানুষকেই শৈশব হাতছানি দিয়ে ডাকে। বারবার ফিরে যেতে মন চায় ফেলে আসা সেই শৈশবের দিনগুলোতে। মনে পড়ে অবাধে ঘোরাফেরা আর খেলে বেড়ানোর সেইসব দিনগুলোর কথা। শৈশব শব্দটি মনে করলেই স্মৃতির পাতায় হাতড়াতে শুরু করে ফেলে আসা সোনালি দিনগুলো।

কার না মনে পড়ে সেই ছেলেবেলার কথা ! দিনগুলো এখন শুধুই স্মৃতি হয়ে আছে। ছেলেবেলার সেই বন্ধুদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি। আজো কাঁদায় ফেলে আসা সেই দিনগুলো। আধুনিক শহরের ইট পাথরের তৈরি বড়ো বড়ো অট্টালিকায় বন্দি মানুষ প্রায় সময়েই হাঁপিয়ে ওঠে। স্মৃতিকাতর মানুষগুলো, স্মৃতির সঙ্গে আলিঙ্গন করার সুযোগ পেলেই চলে যান শৈশবের স্মৃতির কাছে। প্রাথমিক, নিম্নমাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বন্ধুত্বের সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সেই সময়ে সবচেয়ে আপন হয়ে ওঠে সহপাঠীরা। যেকোনো সুখ-দুঃখ শেয়ার করা হয় বাল্যবন্ধুকে। এসএসসি শেষ করে একেক বন্ধু চলে যায় একেক কলেজে। নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে সময়ও লাগে। এক সময় নতুন জায়গা হয়ে ওঠে আপন। উচ্চমাধ্যমিকের পর থেকেই যেন বাল্যবন্ধুদের, বন্ধুত্বের দূরত্ব বাড়তে থাকে। মেধা ও সামর্থানুযায়ী দীর্ঘদিনের স্মৃতিকে লালন করে আলাদা হতে হয় তাদের।

বর্তমান যুগ প্রযুক্তির। এই যুগে কেউ হারিয়ে গেলেও খুঁজে পাওয়া যায়, গত শতকের নয়ের দশকের আগে এমন সুযোগ ছিল না। তখন ইচ্ছে থাকা সত্তে¡ও পুরনো বন্ধুকে খোঁজে পাওয়া দুস্কর ছিল। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মস্তিকে শৈশবের নানা স্মৃতি মনে পড়ে। আজকাল আমরা অনেক সংগঠন দেখতে পাই, যারা অতীতকে স্মরণীয় করে রাখতে, শৈশবে ফিরে যেতে, শৈশবের সেইসব বন্ধুদের নিয়ে বিভিন্ন সংগঠন করছেন। এমনি একটি সংগঠন ‘পাকশী নাইন্টিই’স’। একদল স্বপ্নবাজ যুবক, যারা স্বপ্ন দেখলেন কৈশোরে ফিরে যাবার। ইতোমধ্যে যারা সমাজের বিভিন্ন সেক্টরে স্বমহিমায় নিজেদের দাঁড় করিয়েছেন। তারা তিনটি প্রজন্মকে এক করতে উদ্যোগ নিলেন গেট টুগেদারের। তাদের চোখে-মুখে স্বপ্ন একই মঞ্চে তিন প্রজন্ম। স্বপ্নের জালটাও বুনন করেছেন পাকশী চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের এসএসসি ’৯২ ব্যাচের উল্লাস, উজ্জ্বল, শিপলু, সজল, পার্লি ও পিকু। মূলত এই কয়েকজন স্বপ্নদ্রষ্টার উদ্যোগে ‘স্মৃতির শহরে দুরন্ত কৈশোরে’ শিরোনামে একটি গেট টুগেদারের আয়োজন করা হয় ২৫ ডিসেম্বর ২০২১। দিনব্যাপী এই আয়োজনে সকাল থেকেই ছিল নানা ধরণের অনুষ্ঠান। দেশের বিভিন্ন প্রান্তর থেকে আসতে থাকে পাকশী চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের নানা আবর্তনের ছাত্রছাত্রীরা।

পদ্মা পাড়ের সবুজ ছোট্ট শহর পাকশী’র ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষদের নিয়ে ফেসবুক-ভিত্তিক একটি বিনোদনমূলক সামাজিক পরিবার পাকশী নাইন্টিন‘স। সব সদস্যের অংশগ্রহণে বিনোদন ও ভাব বিনিময়ের মঞ্চ হিসেবে কাজ করছে পাকশী নাইন্টিন’স। তারই ধারাবাহিকতায় সবাই মিলে একটি আনন্দমুখর দিন কাটায় ২৫ ডিসেম্বর ২০২১। পাকশীর বিভিন্ন স্কুল থেকে পাশ করা বিভিন্ন বয়সী প্রায় সহস্রাধিক মানুষ এই আয়োজনে অংশগ্রহণ করেন। পাকশী নাইন্টিন’স-এর অধিকাংশ সদস্য তাদের নিজ কর্মগুণে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং রাষ্ট্র তথা সমাজে পেশাগতভাবে নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত।

অভিনেতা মাজনুন মিজানের সাবলীল উপস্থাপনায় দিনব্যাপী এই আয়োজন শুরু হয় সকাল ৮.৩০ মিনিটে। গিফট হ্যাম্পার ও বুফেতে নাস্তা সংগ্রহ করে আসন গ্রহণ করেন সবাই। জাতীয়সংগীতের সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন অতিরিক্ত সচিব ও বরিশাল বিভাগের মাননীয় বিভাগীয় কমিশনার আমিনুল আহসান কামাল, সংগঠনের পতাকা উত্তোলন করেন গেট টুগেদার আয়োজনের আহŸায়ক সাজ্জাদ খান শিপলু।

পাকশীর নব্বই প্রজন্মের না ফেরার দেশে চলে যাওয়া বন্ধুদের নিয়ে উপল হাসানের বানানো একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি মঞ্চের বিশাল স্ক্রিনে ভেসে উঠলে সবার চোখ ছলছল করে ওঠে। সবাই দাঁড়িয়ে একমিনিট নীরবতা পালন করেন। উদ্বোধনী নৃত্য হিসেবে আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে গানটির সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে শিশুরা।

মনিরুল ইসলাম উজ্জ্বল পাকশী নাইন্টিন’স-এর শুরুর গল্পটা মোহনীয় ছন্দে সবাইকে শোনান। কবি সজল মনির বছরজুড়ে পাকশী নাইন্টিন’স-এর বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে কথা বলেন। সংগঠনটির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন যশোরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সাহাদত স্বাধীন। স্মৃতিচারণ করেন বরগুনার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেজবাউল হক লিটন, পাকশী কলেজের সম্মানিত শিক্ষক তারিক জামান পলাশ, পুলিশ সুপার আজিম উল আহসান তমাল-সহ পাকশীর প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা।

দুপুরের পরে জাহিদ সালাম পার্লী ও মৌসুমী ইসলাম শান্তার সঞ্চালনায় শুরু হয় ভিন্নধর্মী একটি বিনোদনমূলক গানের আসর ‘গানা খাজানা’। হাসন এস উল্লাস এর গ্রন্থনা ও পরিকল্পনায় এই আসরে গান পরিবেশন করেন পাকশী নাইন্টিন’স গ্রæপের ওয়াহিদ, হিরণ, নিপা, সুবর্ণাসহ আরো অনেকেই।

সন্ধ্যার পর লেজার শো’তে পাকশীর ঐতিহ্যবাহী পাইলট রেলগাড়ি, চানমারীর মাঠ, রুপপুর সাকো, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ-সহ পাকশীর বিভিন্ন স্থাপনা আলোক রশ্মী খেলায় ফুটে ওঠে। অন্যদিকে ফুটতে থাকে আতশবাজি চারিদিক আলোকিত করে। লেজার শোর বর্ণিল আলোর খেলায় আলোকিত হয়ে ওঠে পুরো মাঠ। সকলেই প্রাণ ভরে উপভোগ করে লেজার শোর এ বর্ণিল আয়োজন।

ডেভলপার প্রতিষ্ঠান ‘দূর্বা ডেভলপমেন্ট’-এর সৌজন্যে মঞ্চ আলো করে হাজির হয় ৯০ দশকের তরুণ সমাজের ক্রেজ মাকসুদ ও ঢাকা ব্যান্ড। সারামাঠ জুড়ে বয়ে যায় আনন্দের ঢেউ। মাকসুদ গেয়ে চলেন একের পর এক জনপ্রিয় গান। বয়স ভুলে অনেকেই ফিরে যান কৈশোরে গানের তালে তালে। এ যেন এক মনোরম দৃশ্য। বাঁধভাঙা উল্লাসে ফেটে পড়েন সবাই। সেদিন শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশে চাঁদের মতোই আলো ছড়িয়েছিল পাকশীর সহস্রাধিক মানুষ। সবার ভালোবাসার রঙে রঙিন হয়ে উঠেছিল সবার মনের আকাশ।

অনুষ্ঠানটির মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন পাকশী চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠের এসএসসি ’৯২ ব্যাচের ছাত্ররা। মিডিয়া পার্টনার ‘নাগরিক টিভি’ ও ‘আনন্দভুবন’।