ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

30 Jan 2022, 12:37 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

পর্ব- ১৪

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


প্যারিসের দ্বিতীয় দিনটি আমাদের ভুল দিয়ে শুরু, তাই বোধহয় একটু এলোমেলোভাবেই আমরা দিনের প্রথমভাগটা কাটিয়ে দিলাম। প্রথমে টিউরিলিজ গার্ডেন, তারপর অনেকটা পথ হেঁটে আবার সেই পন্ট ডি আলমা টানেলের কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম, সেখানে আরেকটি খোলা উদ্যানে বসে বাড়ি থেকে প্যাক করে আনা খাবার দিয়ে দুপুরের ভোজন সেরে নিলাম। আসলে পথে নামলে সময় থেমে থাকে না, আমরা মোটামুটি উদ্দেশ্যহীনভাবেই সকাল থেকে দুপুর অব্দি কাটিয়ে দিলাম। এরপর আমরা কিন্তু উদ্দেশ্য নিয়েই পথে নামলাম অর্থাৎ দূর থেকে আইফেল টাওয়ারের পূর্ণরূপ দেখবো। আবার ভাতিজা ইরফানের শরণাপন্ন হলাম এবং তার নির্দেশনা মোতাবেক ট্রামেও চড়ে বসলাম। ট্রামে স্টেশনগুলোর নাম নির্দেশ করা থাকে, ট্রামে উঠে আমাদের প্রথম কাজ হলো পরপর স্টেশনগুলোর নাম মিলিয়ে নেওয়া আর এখানেই আমরা খানিকটা বিভ্রান্ত হলাম, ইরফান যে স্টেশনটির নাম বলেছে সেটি হচ্ছে trocadero, কিন্তু মেট্রোতে উঠে বশির আরো একটু নিশ্চিত হওয়ার জন্য একজন সহযাত্রীর কাছে বিষয়টি জনাতে চাওয়াতেই বিপত্তিটা ঘটে, আর আমরাtrocadero না নেমে এগিয়ে গিয়ে পরের স্টেশন passy-তে নামি। আর তাতে যা হওয়ার তাই হলো অর্থাৎ আবার হেঁটে একটি স্টেশন পিছিয়ে আসা। এখানে অবশ্য ইরফানের উপর বশিরের আস্থার ঘাটতি দায়ী, সে কিছুটা সংশয়ে ছিল ইরফান যেহেতু ল্যু’ভর মিউজিয়ামের সাপ্তহিক বন্ধের দিনটি ভুলে গিয়েছেল সুতরাং এ ক্ষেত্রেও সে ভুল করে থাকতে পারে। যাই হোক, ভুলের মাশুলটা আমাদের সবাইকেই গুনতে হলো সময় আর শ্রম দিয়ে। তবে আইফেল টাওয়ার ওয়চপয়েন্টে গিয়ে মন ভালো হয়ে গেল। বেশ বড়ো খোলা চত্বর, মাটি থেকে বেশখানিকটা উঁচুতে। অনেক সিঁড়ির ধাপ নানান দিকে থেকে উঠে এসেছে। উপরে ওঠার পর দৃশ্যটা বেশ চেনা-চেনা মনে হয় হচ্ছিল। এখানে-সেখানে হকারেরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসেছে- সেল্ফিস্টিক, ক্যাপ,  সানগ্লাস-সহ নানান স্যুভেনির বিক্রি হচ্ছে এখানে সেখানে। একইসাথে রয়েছে পর্যটকদের ভীড়। পর্যটকদের ভীড় ঠেলে একদম সামনে যেতে না পেরে মোটামুটি একাধারে একটি নিরিবিলি জায়গা খুঁজে নিলাম কিছু ছবি তুলবো বলে। কিন্তু না,জায়গাটি খুব একটা যুতসই হলো না অর্থাৎ সেখান থেকে আইফেল টাওয়ার পুরোটা দেখা যাচ্ছিল না। এরই মাঝে শুরু হলো টিপটিপ বৃষ্টি, ইউরোপে শীতকালের এই বৃষ্টি বেশ যন্ত্রণার, একেতে হাঁড়-কাঁপানো শীতের কোন মাপ-জোপ নেই তার উপর কাটাঘায়ে নুনের ছিটার মতো এই বৃষ্টি যেন আক্ষরিক অর্থেই শেল হয়ে ত্বকে বিঁধছিল। তবে এরই মধ্যে কিন্তু আমাদের ফটোসেশন থেমে নেই, অভাব শুধু একটু সুবিধা মতো লোকেশনের যেখান থেকে আইফেল টাওয়ার পুরোটা হাতের মুঠোয় আসবে। কী অবাক লাগছে ! না, আবাক হওয়ার মতো কিছু নেই, যেমন করে সূর্যকে আমরা হাতের তালুতে বন্দি করি, তেমনি আর কি। যাই হোক, ভীড়ের  প্রচণ্ডতায় আমাদের সেই ইচ্ছেটা অপূর্ণ রেখে আমরা আমাদের পরবর্তী গন্তব্য আইফেল টাওয়ারের পথে রওনা হলাম, অর্থাৎ এবার আমরা আইফেল টাওয়ারের চ‚ড়ায় উঠবো।




 আইফেল টাওয়ার

আবারও  প্রচন্ড ভীড় আমাদের ইচ্ছেয় বাধ সাধলো। সঙ্গী-সাথি বলতে ছিল সেই প্যাঁচপ্যাঁচে বৃষ্টি। আবশ্য ইউরোপিয়ানরা বৃষ্টির এ উপমা শুনলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে। তারা কিন্তু তাদের আবহাওয়া, দেশ বা ভাষা সম্পর্কে কোনোরূপ নেতিবাচক মন্তব্য বরদাস্ত করে না। যদিও আমাদের মতো দেশ বা ভাষা আথবা ঋতুর রূপমাধুর্য নিয়ে দিবসভিত্তিক বন্দনার আড়ম্বর তাদের নেই ; তাদের পুরোটাই হৃদয়ে এবং অনুভবে ধারণ করা। তত্ত¡কথা ছেড়ে বাস্তবে আসা যাক, প্রায় মাইলখানেক লম্বা লাইনের অংশ হয়ে আমরা যখন টিকিট কাউন্টারে, তখন বুঝতে পারলাম এই পথ অত সহজ নয়, বরং টিকিট কেটে নিয়ে আবার অতিক্রান্ত পথে দ্বিগুণ অতিক্রম করা বাকি। আবার ঘুরে ফিরে বৃষ্টির কথা আসে, যা সেই তখন থেকেই আমাদের সঙ্গী এখন সে আরো জেঁকে বসেছে। আমাদের তা মোকাবিলার প্রস্তুতি বড়োই দুর্বল সুতরাং ঢাল-তলোয়ার ছাড়া এতটা সময় আপেক্ষা করা ঠিক হবে না তা বুঝতে আমাদের খুব একটা বেগ পেতে হলো না। সুতরাং টিকিট না কেটে ব্যর্থ মনোরথে ফিরেই চললাম। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। একটু একটু খিদে সবারই অনুভূত হচ্ছে। বাড়ি ফিরে (সবুজ ভাইয়ের বাড়ি) গেলে হয় কিন্তু রাতে আমাদের আবার ইরফানের বাসায় দাওয়াত, এই যাওয় আসা খুব সাশ্রয়ী হবে না হিসাব তাই বলে। তাই বাকিটা সময় আইফেল টাওয়ারের আশপাশ ঘুরে কাটিয়ে দেবো মনে করে টাওয়ারের ঠিক উল্টো দিকে প্রায় নদীর উপরে এক রেঁস্তোরায় আমরা জাকিয়ে বসলাম। যদিও খিদে লেগেছে তবে আবারও সেই হালাল খাবারের ভাবনা থেকে অন্য কিছু খাওয়া বাদ দিয়ে বেশ বড়োসড়ো মগে কফির অর্ডার দিয়েই সন্তষ্ট থাকতে হলো, এটা অবশ্য আমার জন্য প্রযোজ্য, অন্যেরা টুকটাক কিছু খেয়ে নিল। ঘণ্টাখানেক সেখানে কাটিয়ে আমরা ইরফানের ডেরায় হাজির হলাম। ফোনে ইরফানের কমেন্ট্রি শুনতে শুনতে আমরা ট্রাম বাস এবং সবশেষে পদব্রজে পৌঁছে গেলাম ইরফানের ঠিকানায়।

 আইফেল টাওয়ারের নিচ থেকে

ইরফানের বাসায় গিয়ে ফ্রেস হয়ে একটু রান্না ঘরে ঢুঁ মারলাম, নৈশভোজের আয়োজন দেখতে। রান্না ঘরে ঢুকে আমি রীতিমতো আবেগাপ্লুত, না আয়োজনেরর বিলাস দেখে নয়, বরং যে ছেলেটি দেশ ছাড়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত মায়ের হাতে মাখানো ভাত ছাড়া খেতে পারতো না, সে আজ নিজে নিজে পোলাও, রোস্ট-সহ নানান পদের আয়োজন করেছে এবং খাওয়ার পর দেখলাম স্বাদের বেলায়ও কোনো ঘাটতি ছিল না। ইরফানের এ আয়োজন অনেক্ষণ পর্যন্ত আমাকে একটা ঘোরের মধ্যে রেখেছিল। আসলেই সময় পরিস্থিতি মানুষকে কত সাবলীল আর স্বাবলম্বী করে তোলে। প্রায় দশ বছর পর দেখা ভাতিজা যে আজ অনেক বড়ো হয়ে গেছে তা যেন তখন উপলদ্ধি করলাম।

সেইন নদীর ওপর রেস্তোরা

খাওয়া-দাওয়া শেষে গল্প আর আড্ডায় রাত তখন প্রায় ১২টা। না, এবার তো ফিরতেই হয়, আবার ভোর ভোর যাত্রা। আগেই বলেছি আমাদের দশদিনের ছুটি সম্বল করে আমরা ইউরোপ ভ্রমণে বের হয়েছি, দু’দিন করে আমরা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মোট পাঁচটি শহর ভ্রমণ করবো যার শুরুটা হলো প্যারিস দিয়ে, আগামীকাল আমরা রোমের উদ্দেশে যাত্রা করবো। বাড়ি ফিরে আমরা সব গোছগাছ করার পর একটা বিষয়ে একটু চিন্তিত ছিলাম লাগেজ নিয়ে। ইউরোপের ছোটোখাটো লোকাল এয়ারলাইন্সগুলোর সার্ভিস অনেকটা আমাদের লোকাল বাসের মতো, আমরা প্যারিস থেকে রোমে সম্ভবত Bravais Airlines-এর টিকিট কেটেছিলাম। এসব এয়ারলাইন্সে ইকোনোমিক টিকিটে যাত্রী প্রতি সর্বোচ্চ আট কেজি ওজন বহন করার সুযোগ থাকে। আট কেজি মানে আট কেজিই, প্যারিসে এসে আমরা টুকটাক কেনাকাটা করে ছিলাম এবং ক্ষেত্রবিশেষে কারো কারো লাগেজের ওজন হয়তো একটু বেশি হয়ে থাকবে। এখানে অবশ্য লাগেজ কেনার অপসন রয়েছে, এয়াপোর্টের ঝামেলা এড়াতে বশির আর আমি লাগেজ বা ওজন কেনার সিন্ধান্ত নিলাম। সব ঠিকঠাকই ছিল কিন্তু শেষ মুহূর্র্তে কোথায় যেন ভুল হয়ে গেল। পেমেন্ট কমপ্লিট ; ম্যাসেজ এলো, প্রাইরোটি চেক ইন পারচেজ সফলভাবে সম্পন্ন। আমি আর বশির কিছুক্ষণ বেকুব হয়ে বসে রইলাম। তারপর গচ্চা যাওয়া ইউরোর শোক কাটিয়ে নিয়ে আবার লাগেজ কেনায় মনোনিবেশ করলাম।

আমাদের ফ্লাইট ছিল সম্ভবত সকাল ন-টায়। প্যারিসে এসে আরেকটি বিষয় অনুধাবন করলাম, অল্প খরচে প্লেনের টিকিট কাটতে গিয়ে আমরা সড়ক পথের খরচ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছি। আমরা রোমের ফ্লাইটে উঠবো Beauvais airport থেকে যা সবুজ ভাইয়ের বাড়ি থেকে প্রায় ১০০ কি.মি দূরে। সরাসরি বাস থাকলেও তার সময় আমাদের যাত্রার সময়ের সাথে মেলানো বেশ কঠিন ছিল। অবশ্য অত ভাবনার কিছু ছিল না, সবুজভাই আমাদের পৌছে দেবে বলে নিজে ঘুমুতে চলে গেল, আর আমাদেরও নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে বলে গেল। যেহেতু ভোর-ভোর উঠতে হবে তাই চাইলেও নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমতে পারলাম না। সকালবেলায় সময় মতোই আমরা তৈরি হয়ে নিতে পেরেছিলাম, কাক্সিক্ষত সময়ে যাত্রাও শুরু হয়েছিল, কিন্তু অর্ধেকটা পথ পাড়ি দিয়ে মনে শঙ্কা, শেষ রক্ষা হবে তো ! সবুজভাই ১৪০ কি.মি. স্পিডে গাড়ি চালিয়ে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না, আসলে তার নিজেরও কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না Beauvais airport-এ পৌছুতে কতটা সময় লাগতে পারে। নিশ্চিত ফ্লাইট মিস করবো- এই আশঙ্কা নিয়ে আমরা অনেকটা দাঁতে-দাঁত চেপে আছি আর পথের দূরত্বের সঙ্গে সময়ের হিসাব মিলাচ্ছি।  [চলবে]