ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

28 Feb 2022, 02:35 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

পর্ব- ১৫

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


আমরা যখন এয়ারপোর্টে তখন ঘড়ির কাঁটা সকাল নয়টার ঘর থেকে খুব একটা দূরে নয়। সবাই মোটামুটি নিশ্চিত, বোডিং টাইম শেষ, সবুজ ভাই তো বলেই বসলো, দেখ, ঢুকতে পারিস কি না আমি বাইরে অপেক্ষা করছি, বোডিং সম্ভব না হলে চলে আসিস, বাসায় ফিরে গিয়ে ভাবব, কী করা যায়। আমরা অনিশ্চয়তা নিয়েই এগুলাম, যদি লাক ফেবার করে। আমরা বোডিং সেকশনে এসে বিশাল লাইন দেখে সত্যি সত্যিই ঘাবড়ে গেলাম, না শেষ রক্ষা হলো না বোধহয়। কিন্তু পাশেই প্রায় খালি কাউন্টার দেখে জানতে চাইলাম, এখানে বোডিং হচ্ছে কি না ? তারা জানালো, এটি প্রায়োরিটি বোডিং, আমরা যেন হালে পানি পেলাম, সেই যে ভুল করে কেনা প্রায়োরিটি বোডিং যা এখন আমাদের জন্য শাপে-বর হয়ে দাঁড়ালো। আমাদের আর ফ্লাইট মিস হলো না, প্লেনে উঠে সবুজ ভাইকে নিশ্চিত করাতে তিনি ফিরে গেলেন। প্লেনে পুরোটা সময় আমাকে এই ঘটনাটাই ভাবালো। আসলে আমার/আমাদের জন্য কী ভালো অথবা প্রয়োজন তা বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। সবটাই আসলে পূর্ব-নির্ধারিত। ছেলেবলায় পড়া ‘তিনটি প্রশ্ন’ গল্পটি মনে পড়ে গেল। লিও টলস্টয়ের ‘তিনটি প্রশ্ন’ গল্পের কথকতায় এখন আর নাই-বা গেলাম, আমরা প্রায় সবাই ছোটো বেলায় গল্পটি পড়েছি। 

আমাদের বিমান রোমের মাটি স্পর্শ করল বেলা আনুমানিক ১১টা ২০মিনিটে, তারপর এয়ারপোর্টের সকল আনুষ্ঠানিকতা সেরে আমাদের সাথে বয়ে আনা নাশতা দিয়ে আমরা উদরের খানিকটা পুর্তি করে নিলাম। বলা হয়নি, ভাবি আমাদের অনেকটা জোর করে সকালের নাশতা প্যাক করে দিয়েছিল আর আমরা নিশ্চিত ছিলাম এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ আমাদের প্যাকেটগুলো ফেলে দেবে। আমাদের অবাক করে দিয়ে প্যারিসের ইমিগ্রেশন আমাদের এ বিষয়ে কোনো প্রশ্নই করলো না, তবে বিপত্তি বাধলো রোমে পৌঁছে। তবে, এখানেও অবাক হওয়া বাকি ছিল। এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ আমার আর বশিরের কাছে থাকা খাবার প্যাকেট নিয়ে প্রশ্ন করলেও তা ফেলে দিল না, আবিশা আর সুষমা অবশ্য এ ক্ষেত্রে মাফ পেল না। অগত্যা দু’জনের খাবার চারজন ভাগ করে খেলাম। এরপর আমাদের হলিডে হোমস বা এয়ার বিএনবির ভাড়া বাসার কর্ণধারের সঙ্গে যোগাযোগ করে পথের নির্দেশনা জেনে নিয়ে পথে নামলাম। রোমের ট্যাক্সি সার্ভিস খুব ভালো একইসাথে সাশ্রয়ীও। লোকেশন অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারিত। গন্তব্যে পৌঁছে আমাদের অস্থায়ী ঠিকানার ল্যান্ডলর্ডকে আমাদের জন্য পথে অপেক্ষমান দেখে আমরা যারপর নাই অবাক হলাম। ইউরোপে আমার এই অল্প সময়ের অভিজ্ঞতায় এ জানা হয়ে গেছে যে, ইউরোপে সময় খরচা করে এ ধরণের কার্টেসি খুব বিরল। তার মানে এটা না যে, তারা বদান্যতা দেখায় না, বরং একটু বেশিই দেখায়। তবে, সময় খরচের ব্যাপারে তারা খুব টনটনে।

ল্যান্ডলর্ডের সহযোগে আমরা সহজে গন্তব্যে পৌঁছে নিজেদের দখল বুঝে নিলাম। ততক্ষণে প্রায় দুপুর আমরা বাকশো-প্যাটরা ঘুছিয়ে রেখে ফ্রেশ হয়ে নিলাম, উদ্দেশ্য একেবারে বের হওয়া অর্থাৎ প্রথমে দুপুরের খাবার খাবো তারপর ঘোরাঘুরি। দিনের বাকিটা সময় যতটা পারি ঘোরাঘুরি করে নিয়ে ফিরবও একবারে। তবে, এখন খাওয়াটাই মুখ্য। আগেই বলেছি, সকালের নাশতাটা যুতসই হয়নি। দু’জনের খাবার চারজনে ভাগ করে খেয়েছি। যাই হোক, পথে নেমে খাবারের দোকান খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না। ইউরোপের অন্য দুটি শহর বারগেন ও প্যারিসে তা রীতিমতো কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। রোমে যেমন এখানে সেখানে তুর্কি অথবা মিশরীয় খাবারের দোকানের সন্ধান মেলে তেমনি বাঙালি খাবারের দোকানের সংখ্যাও নেহায়েত কম না। আমরা বেশ কয়েকটি দোকান ঘুরে একটি মিশরীয় দোকানে স্থির হলাম দুপুরের ক্ষুধা নিবারণের জন্য। খাবার বলতে বিভিন্ন ধরনের পিৎজা আর পাস্তা। বলে নিই, ইটালি কিন্তু পাস্তার জন্য বিখ্যাত। এখানে আরেকটি মজার ব্যাপার ছিল, পিৎজা স্লাইস করে বিক্রি হয়। তাই আমরাও পছন্দমতো কয়েটি ধরনের স্বাদ নিতে পারলাম। এ বেলায় আর পাস্তার দিকে গেলাম না, তবে অবশ্যই ইটালির পাস্তার স্বাদ নেব এমন ইচ্ছে রইল। 

উদরপুর্তি শেষে আমরা পথের খবরের সন্ধানে গেলাম, এ ক্ষেত্রে গুগল মামাই আমাদের ভরসা। মোটামোটি একটা ছক কষে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। প্রথম গন্তব্য মেট্রো স্টেশন যা অবশ্য আমাদের আবাসন লাগোয়া হেঁটে যেতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগে। সেখানে গিয়ে স্টেশনগুলোর দিক নির্দেশ জেনে নিয়ে এবার টিকেট কাটার পালা। একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম ৪৮ ঘণ্টার টিকেট কাটব না সিঙ্গেল টিকেট কাটব, আবিশা অবশ্য বলছিল সিঙ্গেল টিকেট কাটতে, কিন্তু ইউরোপ ভ্রমণের এযাবৎ পর্যন্ত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে বান্ডেল টিকেট অথবা ডে টিকেট সাশ্রয়ী হয়। তাই ভাবনা-চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টার টিকেটই কেটে নিলাম। কেননা, আমাদের রোমে আবস্থানের স্থিতি দুই দিন। 

আমাদের প্রথম লক্ষ্য কলোসিয়াম, কলোসিয়াম রোমান সাম্রাজ্যের এক অনন্য স্থাপনা, ৫০ হাজার দর্শক ধারণ ক্ষমতাসহ অর্ধচন্দ্রাকার ছাদবিহীন মঞ্চ। যার শুরুটা ছিল নাট্যমঞ্চ হিসেবে কিন্তু কালের পরিক্রমায় এতে মিশে যায় রক্ত আর চোখের জল, সে এক বিস্তৃত ইতিহাস। সে দিকে অপাতত না যাই, এখনকার কথায় ফিরে আসি, আমরা যখন কলোসিয়ামে পৌঁছুলাম, তখন বিকেলও প্রায় যায় যায়, স্বভাবিকভাবেই কলাসিয়ামে ঢোকার সময়ও অতিক্রান্ত। বেশ দুঃখ পেলাম। কেননা, আমাদের সুযোগ ছিল আগে আগে রওনা হয়ে ঠিক সময়ে হাজির হওয়ার। তবে গ্রুপ ট্যুরে অবশ্য ঠিক সময়ে কোথাও পৌঁছুতে না পারাটাও খুব সাধারণ ঘটনা। কারণ, একেকজনের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু একেকরকম হয়েই থাকে। 

কলোসিয়াম ঘিরে রয়েছে আরো ছোটো-বড়ো বেশ কিছু স্থাপনা, চারপাশে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বাগান। যেহেতু  ভেতরে যাওয়া হলো না তাই পড়ে পাওয়া এই সৌন্দর্যটুকু উপভোগে আর কার্পণ্য করলাম না। অবশ্য পুরো চত্বরজুড়ে পর্যটকদের বিনোদনের জন্য আয়োজন নেহায়েত কম নয়, রয়েছে ট্রেডিশনাল ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা, ম্যাজিক শো। কলোসিয়ামে ঠিক সামনের দিকটায় সন্ধে হলেই বসে অপেরা। অনেকটা আমাদের দেশের পথনাটকের আদলে এরা বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রসমূহে অপেরার আয়োজন করে থাকে। কিছুটা ডামি হলেও তা বেশ উপভোগ্য। অনেকটা সময় চোখের নিমিষে উধাও হয়ে গেল। এরা কিন্তু বিনেপয়সায় বিনোদন বিলি করে বেড়ায় না। একটা ঝুড়ি বা হ্যাট সামনে থাকে দর্শনার্থীরা তাদের ইচ্ছেমাফিক পয়সা তাতে ফেলে যায়। এরই মধ্যে ঝুপ করে যেন আঁধার নেমে এলো। ঘড়ির কাঁটা ধরে রাত্রি বেশ অনেকটা পথ অতিক্রম করলেও সূর্য সবেমাত্র তার পসরা গুটালো।

রোমের আঁধার আবার বার্গেনের মতো না, আর এটা যেহেতু পর্যটন এলাকা তাই রাতের আঁধার এখানে তেমন জমাট বাঁধতে পারে না। এছাড়া কলোসিয়ামের ভেতরে পুরোটাই আলোকিত, যার ছটা এর বাহির দিকটাসহ আশপাশজুড়ে এক মায়বী আলো বিছিয়ে দিয়েছে। যেহেতু দিন ফুরালো, তাই আজকের মতো ঘোরাঘুরি মুলতবি রাখার পরিকল্পনা করে খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। সম্ভবত বশির কারো কাছে শুনে থাকবে এই এলাকাটাতে বেশ ভালো একটি বাঙালি খাবারের হোটেল আছে, আমরা আপাতত তারই সন্ধানে। কিন্তু অনেকটা পথ হেঁটেও আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত হোটেলটি পেলাম নাÑ অবশ্য কারণও ছিল, আমরা হোটেলের নাম বা এর প্রকৃত অবস্থান কোনোটাই না জেনে খুঁজতে বের হয়েছিলাম, যা ছিল খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো, অবধারিতভাবে না পেয়ে ফিরতি পথ ধরলাম। এটা তো আর আমার দেশ না যে, পথ চলতি লোকজনের কাছে জিজ্ঞেস করে করে পথ পেয়ে যাব। যেহেতু রাত বাড়ছে পাছে পথ ভুল করি তাই আর অ্যাডভেঞ্চারাস না হয়ে মেট্রোর পথ ধরলাম। চলতি পথে কলোসিয়ামের রাতের রূপ দেখে আমাদের থমকাতেই হলো। চেষ্টা চলল ক্যামেরায় বন্দি করার ; এরপর মেট্রো ধরে সোজা আমাদের ডেরার কাছাকাছি নামলাম। তারপর আবার খাবার হোটেল খুঁজতে মনোনিবেশ করলাম, না খুব একটা কসরত করতে হয়নি, একদম আমাদের ডেরায় ঢুকতে যে গলি তার মুখেই বাংলাদেশি ভাতের হোটেল। দুপুরবেলা কেন এটা আমাদের চোখে পড়েনি তাই ভেবে অবাক হলাম। ভাত, মাংস, ডাল তো ছিলই শেষপাতে মিষ্টিমুখও করে নিলাম, কালোজাম দিয়ে।

এয়ার বিএনবির ভাড়া বাসাগুলোতে তো বটেই ইউরোপের কিছু কিছু হোটেলেও সাধারণত অল্প-বিস্তর রান্নার ব্যবস্থা থাকে। আমরা সকালের নাশতা ডেরাতেই সেরে নেব- এই ভাবনা থেকে টুকটাক বাজার করতে একটি সুপার শপে ঢুকলাম। বাজার বলতে ডিম, ব্রেড, মাখন, ও হ্যাঁ পেঁয়াজ, কাঁচামরিচও ছিল। আবিশা সুষমা কিছু ড্রাইফুড কিনে থাকবে, মনে করতে পারছি না। ফিরতি পথে প্রশস্ত ফুটপাথে খোলা রেস্টুরেন্ট দেখে একটু কফি খেতে মন চাইল। কফি খাব বলে রেস্টুরেন্টে ঢুকেই কিন্তু আমাদের মত বদলে গেল। এত এত আইসক্রিম, এত এত ফ্লেবার- সবাই আইসক্রিমের অর্ডার দিলাম। কী, খুব গোলমেলে মনে হচ্ছে ? কনকনে শীতের রাতে খোলা রেস্টুরেন্টে বসে আইসক্রিম খাওয়া সে এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে...  [চলবে]