ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

22 Mar 2022, 01:30 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন  -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

পর্ব- ১৬

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


পরদিন সকাল সকাল বের হবো এমনটা ইচ্ছা পোষণ করে ঘুমুতে গেলাম, ঘুমও ভাঙল সকাল সকাল কিন্তু সেই নাশতা করে তৈরি হয়ে সবার সময় এক করতে গিয়ে আবার যথারীতি দেরি হয়ে গেল। আমাদের আজকের গন্তব্য রোমের ভ্যাটিকান। আমরা যখন ভ্যাটিক্যান নগরীর দ্বারে বেলা তখন সাড়ে এগারো প্রায়। রোদ বেশ কড়া হলেও এ আমেজটা কিন্তু মায়াময়। ভ্যাটিকান সিটিটা আদতে আমার কাছে একটি মিউজিয়ামের মতো মনে হলো। একে তো প্রচণ্ড ভীড় তার ওপর মাথাপিছু প্রায় দেড়শো ইউরো টিকেট, না আমরা এর ভেতরটায় ঢুকিনি, তবে এর বাইরের কাঠামো এবং পারিষদ ভবনসমূহ-ও কম আর্কষণীয় নয়। বিশাল এলাকার সীমানাদেয়াল ঘেষে স্বেতশুভ্র প্রাসাদ মাঝখানটায় উন্মুক্ত চত্বর, এখানে সেখানে রয়েছে ছোটো ছোটো জলের ফোয়ারা আর আছে অগণিত পরিযায়ী পাখি। চমৎকার আলো ঝলমলে সকাল, সকালই বলা যায়। কারণ, ঘড়ির কাঁটা ১২টার দিকে ধাবমান থাকলেও তা তখন মধ্যহ্ন ছোঁয়নি। প্রথমে ভ্যাটিকান সিটির চারধারের বিশাল থাম দেওয়া বারান্দা ধরে হেটে এসে আমরা ছায়াছায়া একটা জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়লাম। দেখছিলাম মানুষ আর পাখির মিতালি, নানান জন নানান ভঙ্গিমায় স্থির চিত্রে নিজেদের ধরে রাখতে ব্যস্ত, আমরাও ব্যতিক্রম নই, একটু ফাঁক ফোকরে আমরাও কিন্তু ছবি তুলে নিলাম। বশির এরই মাঝে ভিডিও কলে তার পরিবারকে ইতিহাসের এই অনবদ্য স্থাপনার সৌন্দর্যের নির্যাসটুকু পৌঁছে দিল।

এতক্ষণে বোধকরি বেলা মধ্যাহ্ন অতিক্রম করল, পেটে অনেক্ষণ কিছু পড়েনি আরো কতক্ষণ পর দুপুরের খাবারের সন্ধান মিলবে তাও জানা নেই। তাই এসময়টাতে সঙ্গে আনা সামান্য শনপাপড়ি আর বিস্কুট দিয়ে ক্ষিদেকে একটু বোঝ দেবার চেষ্টা করলাম। তারপর আরো কিছুক্ষণ ভ্যাটিকান সিটিকে ঘিরে যে আয়োজন তাই দেখে কাটিয়ে দিলাম। ইউরোপের যেখানেই যাই না কেন, পথ পাড়ি দিতে হলে অনেকটা পথ দু’পায়ের ওপর ভরসা করতে হয়। যেহেতু দুপুর তার সময়টাকে গুটাতে শুরু করেছে তাই আমরাও আমাদের এ বেলার আয়োজন গুটিয়ে বেরিয়ে পরলাম, প্রথম উদ্দেশ্য দুপুরের খাবার খেয়ে নেওয়া। বলাই বাহুল্য, ধারেকাছে কোনো রেস্তেুারাঁ না থাকাই স্বাভাবিক। আর কতটা দূরে আছে তাও জানা নেই খুঁজেপেতে সময় লাগবে সেই চিন্তাকে মথায় রেখে হাঁটতে শুরু করলাম। বাংলাদেশের মতো ইউরোপের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রগুলোর আশেপাশেও কিন্তু স্ট্রিট শপিংয়ের সুযোগ আছে। রোমেও এর ব্যতিক্রম নয়, তবে রোমে এই কাজটিতে বাঙালির সম্পৃক্ততা অনেক বেশি। পথে যেতে যেতে আমরা এমন কিছু বাঙালির অস্থায়ী দোকান থেকে নানান রকম জাঙ্ক জুয়েলারি আর সুভ্যানির কিনলাম, দোকান বলতে আসলে ভ্যানের ওপর পসরা সাজিয়ে ফেরি করা, যেটা আমাদের দেশে পথে পথে খুব পরিচিত দৃশ্য। রথ দেখা কলা বেচা এই পদ্ধতিতে আমরা শপিং করতে করতে এগুচ্ছি আর খোঁজ করছি কোথায় দুপুরের খাবার সেরে নেওয়া যায়। বেশ খানিকটা হাঁটতে হলো অবশেষে খোঁজ মিলল খাবারের দোকানের। সারি বেধে রাস্তার দু’ধারে দোকানগুলোর অধিকাংশই বাঙালি দোকান, যাক আর খাবার নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, ভাতই জুটবে নিশ্চিত। আমরা দোকানের ভেতর দিকটাতে একটি টেবিলের দখল নিয়ে বেশ আয়েস করে ভাত মাংস ভর্তা আর ডালের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষার সময়টি গল্প করেই কাটালাম, প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে কুশল বিনিময়ও হলো এই সুযোগে।

খাওয়া-দাওয়া শেষে আবার পথে, যদিও ঘড়ির কাঁটা তিনটের ঘর ছাড়িয়েছে কিন্তু মাথার ওপর তখনো গনগনে সূর্য। ভ্যাটিকান সিটি থেকে আমরা পিজ্জা ডি ত্রোভির [piazza di trevi] পথে। সিদ্ধান্ত নিতে একটু সমস্যা হচ্ছিল কীভাবে যাবো, হেঁটে না মেট্রোতে, যেভাবেই যাই, সময় ৩০মিনিট কম-বেশি লাগতে পারে। ভেবে নিয়ে আয়েসকে প্রাধান্য দিয়ে মেট্রোতে যাওয়াই ঠিক হলো। আচ্ছা, পিজ্জা ডি ত্রেভিতে কেন যাচ্ছি, মূলত গুগোল ম্যাপ থেকে জানলাম, ঐতিহাসিক এক ফোয়ারার কথা, যার নাম ত্রেভি ফোয়ারা [fontana di trevi ], কথিত আছে, এটি পৃথিবীর বিখ্যাত কিছু ফোয়রার মধ্যে অন্যতম। জানা যায়, রেনেসাঁর শৈল্পিক যুগের সূচনা কালে এ ফোয়ারাটি নির্মিত হয়। মেট্রো থেকে নেমে আবার খানিকটা হাঁটা পথ- রোমের এই পাশটায় রাস্তাগুলো আবার বেশ সরু গলির মতো। আমরা যখন ফোয়রার কাছে পৌঁছলাম তখন সেখানটায় প্রচণ্ড ভীড়, এর আগে আমি ইউরোপের আর কোনো পর্যটন কেন্দ্রকে ঘিরে একসাথে এতো লোকের সমাগম দেখিনি। একটু ফুসরত খুঁজছিলাম, দু-একটা ছবি না তুললে কী হয় ? কিন্তু খুব একটা সুবিধা করতে পারিনি, ছবি যে তুলিনি তা না, তবে মনের মতো হয়নি। অবশ্য ততক্ষণে ছবি তোলার আশা ছেড়ে দিতে হলো, সূর্য তখন এক পাশে হেলে পড়েছে, ফোয়ারার মূল স্ট্রাকচার ঘিরে তখন এক মায়ময় ছায়া। আমরা একটু দূর থেকে এর বিশেষত্ব বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছি। একটা জিনিস খেয়াল করলাম, ফোয়ারার স্বচ্ছ জলে প্রচুর কয়েন পড়ে আছে, আরও অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, এগুলো পর্যটকরাই ছুড়ে ছুড়ে ফেলছে। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে গিয়ে মজার এক জনশ্রুতি  জানলাম, এই ফোয়ারায় পয়সা ফেললে যে ফেলবে সে আবার কখনো-না-কখনো রোমে ফিরে আসবে।

বেশিক্ষণ এই ভীড়ে দাঁড়িয়ে থাকা গেল না। কেননা, এখানটাতে পর্যটকদের আনাগোনা বেশ বাড়াবাড়ি রকমেরই বেশি। আর অন্যদের সুযোগ দেওয়াটাও জরুরি, তাই আমারা ফিরতি পথ ধরলাম। ফোয়ারার পথে যাওয়ার সময় পথের ধারে কিছু ছোটো ছোটো দোকান চোখে পড়ে, যার অধিকাংশই চামড়ার তৈরি বাহারি ব্যাগ আর জুতোর সমাহারে সাজানো। আর কে না জানে, ইটালি চামড়াজাত পণ্যের জন্য বিখ্যাত। তাই একটু নেড়েচেড়ে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। ফেরার পথে যেহেতু নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই, তাই তেমন কোনো তাড়া নেই। আমরা বেশ আয়েসেই পথ চলছিলাম আর আয়েসী এই সময়ের সুযোগটাকে কাজে লাগালাম, ঢুকে পড়লাম নান্দনিকভাবে সাজানো একটি চামড়ার পণ্যের দোকানে। বলছিলাম একটু নেড়েচেড়ে দেখবো কিন্তু মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যদি বাজেটে মিলে তাহলে অন্তত একটি ছোট পার্স হলেও কিনব। দু-একটা দোকান ঘুরে অবশ্য ব্যাটেবলে মেলানো গেল। ছাইরঙা ছোট্ট ব্যাগ বেশ পছন্দ হলো আর দামটাও আমার সাধ্যের মধ্যে তবে আর আশাকে অপূর্ণ রেখে লাভ কী ? কিনেই নিলাম।

আগেই বলেছি, আজ আর নির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই, পড়ন্ত বিকেলটা এলোমেলো ঘুরেই কাটিয়ে দেব। আর উইরোপে শরৎ বিকেল বা সন্ধে কাটানো কোনো ব্যাপারই না। তাদের চলতি পথে এতসব সৌন্দর্য আয়োজন ছড়ানো থাকে যে, পথিক ক্ষণেক্ষণে থমকায়, সৌন্দর্যের কিছুটা ছটা নিজের মনে ধারণ করে আবার পথ চলে। যেমন, রোমের এই বিকেল আমরা উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে একটি চৌমাথার মতো জায়গায় এসে থামলাম। ছোট্ট একটা ফোয়ারা ঘিরে পথিকদের জন্য কংক্রিটের বেদি, যা বিশ্রামের পাশাপাশি বেশ শান্তিময় এক অনুভূতি দেয়। এখানটাতে বসে আমরা যখন আড্ডায় মশগুল, তখন কানে বাজলো ‘গোলাপ নিবেন ?’ কিছুটা চমকে তাকাতেই দেখি, মাঝবয়সী এক প্রবাসী বাঙালি একঝুড়ি গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে। টকটকে লাল তাজা গোলাপের সৌন্দর্যকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, কিন্তু উইরোপে গোলাপ তো আর আমাদের দেশের মতো সস্তা দরে বিকোয় না, তাই একঝুড়ি গোলাপ থেকে গুনেগুনে মাত্র তিনটি গোলাপ কেনা হলো। অবশ্য গোলাপগুলো বশিরের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য উপহার ছিল, তবে বশিরও কিন্তু উপহার থেকে বঞ্চিত হয়নি বরং তার উপহারটা আরও চমকপ্রদ ছিল। স্বয়ং বিক্রেতার তরফ থেকে পাওয়া উপহার, চাট্টিখানি কথা ! আসলে একেই বলে স্বদেশীর প্রতি ভালোবাসা।

পথে পথে ঘুরে ক্ষিদে পায়নি বটে কিন্তু চায়ের তৃষ্ণা ছিল খুব। তবে, এর জন্য অবশ্য খুব একটা কসরত করত হয়নি। রোমের এদিকটায় পথের ধারে হাজারো ছোটো ছোটো রেস্তোরাঁ বা কফিশপ রয়েছে। আমরা দেখেশুনে বেশ সুন্দর মতো একটি কফিশপে ঢুকে পড়লাম। চায়ের সাথে টাও চলল অবশ্য। আরেকটি মজার ব্যাপার, কফিশপটি তার্কিশ হলেও এর এটেন্ড কিন্তু বাঙালি, এটা বাড়তি পাওনা। বিদেশ বিভূঁয়ে বাঙালি দেখলেই কেন যেন এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। এরপর সন্ধ্যার শেষে রাত্রের আগমনে আলো ঝলমলে রোমের পথে আরো কিছুক্ষণ আমাদের পদচিহ্ন রেখে আমরা আমাদের আবাস পথে রওনা হলাম, অবশ্য ফিরতি পথে রাতের ভোজন সেরে নিতে ভুললাম না। সে রাতে একটু তাড়াতাড়িই ঘুমুতে গেলাম। কেননা, পরদিন ভোরে আমরা আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করব...