ইউরোপের ১৫০ দিন সৈয়দা -তাসলিমা আক্তার

24 Apr 2022, 12:56 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন সৈয়দা -তাসলিমা আক্তার

ভেনিসের খাল, সাবমার্কো


পর্ব ১৭
[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ভেনিস, হ্যাঁ স্বপ্নের ভেনিস। আমি বেশ এক্সাইটেট, এমনিতে আমি ঘুমকাতুরে মানুষ বিশেষ করে সকালটাতেই আমার ঘুমের গভীরতা যেন বেড়ে যায়, তবে কোথাও বেড়াতে গেলে এই আমি আবার ভোরের পাখি হয়ে যাই। আর যদি এমন কোনো বিষয় থাকে যা আমার বহুদিনের কোনো ইচ্ছেকে ছোঁয়ার মতো ঘটনা তাহলে তো কথাই নেই, ঘুম তখন দূর দ্বীপবাসিনী। বেশ ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাকিদেরও ঘুম থেকে তুলে নিয়ে নাস্তার জোগাড়যন্ত করে আগেভাগেই তৈরি হয়ে নিয়ে হাতে বেশ কিছু সময় নিয়ে রওনা দিলাম। যদিও মেট্রো স্টেশন আমাদের আবাস লাগোয়া তবুও বাড়তি সাবধানতা যে রেল স্টেশনে পৌঁছুতে কতটা সময় লাগবে তা জানা নেই আর সকালের এই সময়টায় মেট্রোতে প্রচণ্ড ভিড় থাকে। সুতরাং এখানেও কতটা সময় লাগবে তা আন্দাজ করা মুশকিল। আর অচেনা জায়গায় একটা স্বাভাবিক অনিশ্চয়তা কাজ করেই, অন্তত আমার ক্ষেত্রে তো বটেই। আরও আছে ইউরোপের রেল স্টেশন বলি আর এয়ারপোর্ট বলি আয়তনে এতো বিশাল যে পূর্ব-অভিজ্ঞতা না থাকলে নির্দিষ্ট প্লাটর্ফম বা টার্মিনাল খুঁজে পাওয়াও কম ঝক্কির কাজ নয়। যাই হোক, পরপর দুটি মেট্রো ছেড়ে দিয়ে তার পরের বার আমরা মেট্রোতে জায়গা করে নিতে সক্ষম হলাম। আর সবচেয়ে ভালো দিক হলো মেট্রোর স্টেশন একদম রেল স্টেশন ঘেঁষেই। যেহেতেু হাতে বেশ সময় নিয়ে বের হয়েছিলাম সেহেতু স্টেশনে পৌঁছে সবকিছু বুঝেশুনে নেওয়ার যথেষ্ট সময় হাতে ছিল। আমরা আমাদের গন্তব্য আর সময় মিলিয়ে আমাদের প্লাটফর্ম খুঁজে নিয়ে মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে প্লাটফর্ম লাগোয়া একটি কফিশপে ঢুকলাম, রথ দেখা আর কলা বেচা দুটো উদ্দেশ্যই এখানে কাজ করেছে। কেননা, সকালের চা-পর্বটা আমরা বাকি রেখেই বেরিয়ে ছিলাম আর এখন তো আমাদের বেশ কিছক্ষণ অপেক্ষাও করতে হবে।

রোম রেল স্টেশনে ভ্রমণ সঙ্গীদের সাথে লেখক


নির্দিষ্ট সময়েই আমাদের যাত্রা শুরু হলো, ইউরোপের ট্রেন জার্নি বেশ মজার এবং ক্ষেত্র বিশেষে বেশ ব্যয় বহুলও। ভ্রমণ পিয়াসী বিলাসী লোকজন যারা একইসঙ্গে সময় এবং অর্থের দিক থেকে ধনী তাদের প্রথম পছন্দ ট্রেন। আমরাও অনেকটা শখের বশে স্বাদের ভিন্নতার জন্য ট্রেনযাত্রা বেছে নিয়েছিলাম। এর আগেও একবার ইউরোপের ট্রেনে চড়ার সুযোগ হয়েছিল। তবে, সে সময়ের সঙ্গে এখনকার তফাৎ হচ্ছে, তখন সে-যাত্রায় ট্রেন প্রায় ফাঁকা ছিল তবে এ যাত্রায় আমার দেশের ট্রেনে যেমন হয় তেমন ভিড় না হলেও ট্রেনে যাত্রী পরিপূর্ণই বলা যায়, দু’চারটা সিট এদিক-সেদিক ফাঁকা থাকলেও থাকতে পারে। আমরা পাশাপাশি দুটো সিট নিয়ে গুছিয়ে বসলাম। পথের দু’ধারের দৃশ্যই বেশ মনোরম আর দৃষ্টিনন্দন। আসলে প্রকৃতির স্বাভাবিকতার সৌন্দর্য পৃথিবীর যে-কোনো আয়োজনকে ছাড়িয়ে যায়। আর প্রকৃতির এই স্বাভাবিক চিরচেনা রূপের মাধুর্যে হারিয়ে যেতে যেতে আমরা একসময় ঠিক আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। বেলা তখন বোধ করি ১২টা হবে। স্টেশন থেকে বেরুতে গিয়ে আমরা বেশ দ্বিধান্বিত, কোন পথে বের হবো। বেশ কিছুক্ষণ যাত্রীদের আসা যাওয়া পর্যবেক্ষণ করে, এমনকি লোকজনদের জিজ্ঞেস করেও আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না যে, কোন পথে বের হলে আমাদের জন্য সহজ বাহন মিলবে। শেষমেশ বশির কিছুটা পথ এগিয়ে খোঁজ নিয়ে এল যে, সবচেয়ে নিকটবর্তী গণ-পরিবহণ কোথা থেকে পাওয়া যেতে পারে। স্টেশনের বাইরে বেশ খটমটে রোদ, তেজও বেশ, যেন একটু মশকরাই করছে শীত নিয়ে আমাদের বাড়াবাড়ি রকমের ভীতিকে। আমরা হেঁটে হেঁটে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে তারপর আমাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম। না, বাসে যাব না, ট্যাক্সিতেই যাব। কারণ, অবশ্য যৌক্তিকÑ প্রথমত, আমাদের ক্যাম্প হাউজের সঠিক লোকেশন সম্পর্কে আমরা কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলাম, তা ডাউন বাসস্টপ থেকে কতটা দূরত্বে তাও জানা নেই, এইসব ভাবনা-চিন্তা করেই পরে ট্যাক্সিই বেস্ট অপশন বলে মনে হলো। ইউরোপেও চুক্তিতে ট্যাক্সি চলে জানা ছিল না। এর আগে পর্যন্ত আমি ধরেই নিয়েছিলাম, অ্যাপের বাইরে যে ট্যাক্সিগুলো চলে সেগুলো সম্ভবত দূরুত্ব অনুযায়ী নির্ধারিত ভাড়ায় চলে থাকে। এ ক্ষেত্রে মোটামুটি দরদাম করে একটি ট্যাক্সি ভাড়ায় নিয়ে আমরা আমাদের নতুন আবাসে পৌঁছলাম।

ঝরাপাতার পথ


এর আগে ক্যাম্প হাউজ সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকায় বিষয়টি নিয়ে বেশ একটু উত্তেজনা কাজ করছিল। কিন্তু যখন পৌঁছলাম, বেশ হতাশ হলাম। আগেই বলেছি, বোধহয় ইউরোপে হোটেল বা হলিডে হাউজ বুকিংয়ের দুটি জনপ্রিয় সাইট হচ্ছে এয়ার বিএনবি এবং বুকিং ডটকম। রোমে আমরা যে হলিডে হাউজে ছিলাম তা এয়ার বিএনবি থেকে বুক করা ছিল এবং নিঃসন্দেহে তা বেশ ভালো ছিল। আর ভেনিসের এই হাউজটি আমরা বুকিং ডটকম থেকে নিই। এখানে এসে আমরা এতটাই হতাশ যে, আমাদের অন্য আরেকটি গন্তব্য প্রাগে যে হোটেলটি বুকিং ডটকম থেকে বুক করা ছিল তা তৎক্ষণাৎ বাতিল করি। কেন এই হতাশা ? একটু মনে হয় ব্যাখ্যা করা দরকার, তার আগে একটু বর্ণনা দিই : ক্যাম্প হাউজ এমন, যেখানে পুরো স্থাপনাই চাকা লাগানো কাঠের পাটাতনের উপর নির্মিত, যেন চাইলেই পাততাড়ি সহজেই গোটানো যায়। তবে, এখানে কিন্তু একটি সুইমিংপুল আছে, এটি দেখে কিন্তু স্থায়ী বলেই মনে হলো। ক্যাম্প হাউজের রুমগুলো একপাশে সারি সারি দিয়ে রাখা মাঝে ছোট্ট রাস্তা, কেমন যেন বস্তি বস্তি ভাব, প্রতিটা রুম খুপরি সাইজের, লাগোয়া বাথরুম আছে ঠিকই তবুও যেন এটি জাতে উঠতে পারল না। আবার মর্যাদার দিক থেকে তিন তারকা তকমা নিয়ে বসে আছে। এ যেন ‘ঘটি ডুবে না, নামে তাল পুকুর।’ আর আমার কাছে এর থেকে আমাদের ভাষাণ চরের রোহিঙ্গদের জন্য তৈরি স্থাপনা অনেক বেশি আকর্ষণীয় বলে মনে হলো।
মনের মধ্যে খচখচানি নিয়েই নিজেদের রুম বুঝে নিলাম। এদিকে দুপুর অনেকক্ষণ যাবৎই অপেক্ষায়, আমরা তখনো লাঞ্চ করিনি। দেরি না করে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম খাবারের সন্ধানে। তার আগে অবশ্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ডেইলি টিকেট সংগ্রহ করতে ভুললাম না। ভেনিসে আমার অনেক দুঃখের স্মৃতি জমা হলো। শুরুটা তো থাকার জায়গা নিয়ে, তারপর আসি খাবারের কথায়। ভেনিসের যে দিকটায় আমাদের অস্থায়ী বাস সেটা আদতে শহরের একটু প্রান্তসীমায় কিছুটা গ্রাম গ্রাম আবহ আছে, তাই এদিক সেদিক খুব ছড়ানো-ছিটানো দোকান-পাট নেই। আমরা অনেকটা হেঁটে গিয়ে মোড়ের মাথায় একটি ছোট খাবারের দোকান পাই ; প্রচণ্ড খিদের সময় এ যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতোই, কিন্তু দোকানের ভেতরে ঢুকে চন্দ্রাহত হলাম। কেন সে ব্যাখ্যায় আর না যাই। বাকি তিনজন টুকটাক কিছু খেয়ে নিলেও আমার আর দুপুরের খাওয়া হলো না।

ফুলের পসরায় লেখক

এরপর আমাদের গন্তব্য ভেনিসের মূল আকর্ষণ শতখালের জাল বিছানো সান মার্কো বা সান মার্ক। যেখান থেকে শুরু জলের পথ, তা সে অবারিত হোক অথবা দালন-কোঠার ফাঁক-ফোঁকরে হোক। আমরা যখন সান মার্কোতে তখন কেবল দুপুর গড়িয়ে বিকেলের শুরু। ঝকঝকে সোনালি রোদ জলের ’পরে লুটোপুটি খাচ্ছে। সান মার্কোর একদিকটাতে রয়েছে ঘাট, বেশ সাদামাটা অনেকটা ফেরিঘাটের আদলে, আবার ঘাট ছেড়ে খানিকটা বাঁয়ে গেলে দেখা মেলে অপূর্ব সুন্দর রিয়াটো ব্রিজ। রয়েছে প্রাদের মতো স্থাপনা যা আদতে শপিং সেন্টার, খাবারের দোকান হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিশাল বিশাল থাম আর উঁচু ছাদ মাঝ দিয়ে করিডোরের মতো রাস্তা, এগুলো আসলে অনেকটা সেতু হিসেবেও কাজ করে। এ করিডোর ধরে আমরা চলে গেলাম ঘাট থেকে খানিকটা দূরে বেশ চওড়া বাঁধানো পাড়, ছিমছাম এক চাতাল মতো জায়গায় যার একধারে বিখ্যাত কেএফসির আউটলেট, অন্য ধারটা বেশ খানিকটা ঢিবির মতো উচু হয়ে গিয়ে আবার জলের সাথেই মিলে মিশে একাকার। রোদ তখনো সোনালি আভা ছড়াচ্ছে, সেই সাথে দুধসাদা সমুদ্র পাখির [সি গাল] আনাগোনা। তবে, তারা কিন্তু আমাদের সাথে দূরত্ব বজায় রেখেই চাতালে রোদ পোহাচ্ছিল। বিকেল একটু না পড়তেই বাতাস খারের জলের সাথে যোগসাজসে শীতের হিম ছড়ানোর দুষ্ট খেলায় মেতেছে। আমরা যারা দুপুরে কড়ারোদ আর ভ্যাপসা গরমের কথা মাথায় রেখে সেভাবে নিজেদের তৈরি করে পথে নেমেছি তারা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি শীতের হাড় কাঁপানো কাঁপন কাকে বলে।
আজ আমরা আর জলের বুকে ভাসলাম না। তা আগামীকালের জন্য তুলে রাখলাম। কারণ, একে তো পড়ন্ত বেলা তার ওপর হঠাৎই আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হলো। ইউরোপে রোদ-বৃষ্টির এই খেলা নৈমিত্তিক। তবে, ভর সন্ধ্যায় বৃষ্টি মাথায় বোটিং খুব একটা উপভোগ্য হবে না বলে মনে হলো। আরও আনুসাঙ্গিক কিছু কারণও অবশ্য ছিল, এই যে হঠাৎ শীত জেঁকে বসছে তার ওপর আমি তখনো পর্যন্ত উপোস। এইসব কার্যকারণ বিবেচনায় বিকেলটা অলস ঘুরাঘুরিতে কাটিয়ে দিলাম। সান মার্কোর মার্কেট-গুলো তো বটেই সন্ধের মুখে খালের ধার ঘেঁষে বাড়িগুলোতে যখন আলো জ¦লে উঠল, তখন যেন চারিধার একবারে স্বর্গীয় সৌন্দর্যে সেজে উঠল। খালে জলের ক্লান্তিহীন কলকল শব্দে বয়ে চলা, আর চারধারের মায়াবী আলো... সেইসঙ্গে খানিক আগের হঠাৎ বৃষ্টির রেশ সবকিছু মিলে প্রকৃতির এই অনিন্দ্য সুন্দরের মাঝে আমরা কিছুক্ষণ মূক হয়ে বসে ছিলাম। তখন বোধকরি পৃথিবীর কোনো শব্দই আর কোনো আবেদন তৈরি করতে সক্ষম নয়। না, বেশ গুরুগম্ভীর কথা হয়ে যাচ্ছে, আসলে সময়টা যেন স্বপ্নের জগতের। তবে, পেটের ক্ষুধা স্বপ্ন সমাপ্তিতে বেশ কার্যকর ওষুধ। ফিরে এলাম ধুলোর ধরণীতে। না, ক্ষুধাকে আর অবহেলা করা যাচ্ছে না। এবার মিশন খাদ্যের অনুসন্ধান। খালের পাশ ঘেঁষে মূল ভূখণ্ডে আমরা ফিরে এলাম। অবশ্য দুপুর বিকেলের সন্ধিক্ষণে খাদ্য অনুসন্ধানে আরেকবার চেষ্টা চলেছিল কিন্তু সফল হয়নি। সেই যে কেএফসির কথা বলে ছিলাম সে সময় তা বন্ধ ছিল। যাই হোক, এবার নতুন উদ্যোমে এগিয়ে চললাম। এ পাশটা মূলত বিভিন্ন স্যুভেনির দোকান। আমরা দেখতে দেখতে পথ চলছি, এ পথে যেতে যেতে বেশ কিছু বাঙালির দোকান অথবা বাঙালি সেলসম্যান আছে এমন দোকান খুঁজে পেলাম, তারপর তাদের কাছ থেকে পথ জেনে আমরা খাবারের দোকনের সন্ধান পেলাম। তবে কি শেষ রক্ষা হলো ? তখনো পর্যন্ত না, সেই আবার হালাল-হারামের প্রসঙ্গ। তবে, অনেক খুঁজেপেতে একটি পিৎজাশপ পেলাম, সাথে পেলাম এক প্রবাসী বাঙালি ভাইকে, যাকে আমরা আমাদের ক্রাইসিসটা বুঝিয়ে বলাতে সে দায়িত্ব নিয়ে সায়মন মাছের পিৎজা তৈরি করে দিল। আমাদের অবশ্য এজন্য বেশখানিকটা সময় অপেক্ষা করতে হলো, অবশেষে সারাদিন শেষে উদোরপুর্তি। সারাদিনের প্রচণ্ড ক্ষুধার পর এই পিৎজা যেন অমৃত।

ভ্রমণসঙ্গীদের সং্গে লেখক, পেছনে রিয়াটো ব্রিজ

মূল খাওয়া পর্বের পর চলল কফি খাওয়া, বাইরে বেশ ঠান্ডা তাই পিৎজাশপে বসেই কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে পরের দিনের পরিকল্পনার একটি ছক করে নিয়ে আমরা ক্যাম্পে ফিরে এলাম। আগেই বলেছি খুপরি মতো রুম। বিছানা ছাড়া মেঝেতে হেঁটে চলার মতো কোন জায়গা অবশিষ্ট ছিল না, তাই রুমে ফিরে ফ্রেশ হয়ে সরাসরি বিছানায় ঠাঁই নিতে হলো। পরদিন বেশ ভোরে ঘুম ভেঙে গেল, বাকিরা তখনো ঘুমে। যেহেতু নাশতার সময় আরো দেরি আছে তাই কাউকে আর জাগালাম না, একাই বেরিয়ে পড়লাম আশপাশটা একটু ঘুরে দেখব বলে। ক্যাম্প হাউজের চারধারটা একটু ঘুরেফিরে বেড়িয়ে পরলাম। আগেই বলেছি, ভেনিসের এদিকটাকে ঠিক শহর বলা চলে না, শহরের উপকণ্ঠ বলা যায়। সাধারণভাবে প্রতিদিনের পথচলায় যে-পথ ব্যবহার করা হয় আমি সে-পথে না গিয়ে অন্য পথের পথিক হলাম। গত একদিনের অভিজ্ঞতায় যতটুকু বুঝেছি এ অঞ্চলটাতে জন-মানুয়ের আনাগোনা মূলত এই ক্যাম্প হাউজ ঘিরেই, তাই বেশ খানিকটা পথ হেঁটে এসেও কোনো মানুষ বা যানের দেখা মেলেনি। মাঝারি মাপের পিচঢালা পথ, দু’ধারে নাম না জানা বাহারি গাছ সোনালি আর লালের মিশেলে ঝরাপাতায় পুরো পথটিই রঙিন। মাঝে-সাঝে দু’-একটা বাঙলো প্যাটার্নের বাড়ি, ফার্ম হাউজ চোখে পড়ছে ঠিকই কিন্তু এগুলোতে প্রাণের চিহ্ন আছে কি না তা বুঝতে পারছি না। অবশ্য, দূর থেকে তা বুঝতে পারার কথাও নয়। পথ আর প্রকৃতির রূপের আবেশে পড়ে সত্যি অনেকটা দূর চলে এসেছি। এখানটায় মোবাইলের নেটওয়ার্ক ঠিকমতো কাজ করে না, অন্যেরা হয়ত জেগে উঠে আমার সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে চিন্তায় পড়ে যাবে- এ ভাবনায় ক্যাম্পে ফিরে এলাম।
যা ভেবেছিলাম, আমার ভ্রমণসঙ্গীরা ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে নাশতা করবে বলে। সকালের নাশতাটা হোটেল ভাড়ার সাথে যুক্ত ছিল। নাশতার আয়োজন কম ছিল বলা যাবে না। তবে, বৈচিত্র্যের অভাব ছিল নিঃসন্দেহে। নাশতা সেরে সকাল নয়টা নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়লাম আবারও সান মার্কোর উদ্দেশ্যে। যথারীতি হেঁটে হেঁটে মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত গেলাম, যেখান থেকে গতদিন টিকেট কেটেছিলাম। তবে, আজ সেখানটায় এক ভিন্ন চিত্র, দিনটি সম্ভবত শনিবার ছিল। মেট্রো স্টেশন এলাকাজুড়ে হলিডে মার্কেটের আয়োজন, যেখানে ঘরগৃহস্থালীর নানান সামগ্রীর আয়োজন তো ছিলই। তবে, চোখে পড়ার মতো এবং মন জুড়িয়ে দেওয়ার মতো যে আয়োজনটি ছিল তা হচ্ছে ফুলের পসরা, শুধু যে বর্ণে-গন্ধেই অনিন্দ্য ছিল তা নয়, পরিবেশনায় ছিল নান্দনিকতার ছোঁয়া। এই সুন্দরের মঝে কেটে গেল বেশ খানিকটা সময়। আমাদের যে অন্যকোনো গন্তব্য ছিল খানিকক্ষণের জন্য আমরা তা ভুলেই গেলাম। ঘড়ির কাঁটায় চোখ পড়তে মনে হলো না, এখন যাওয়া উচিত। মেট্রো বা ট্রাম স্টেশন কাছেই, দু’ মিনিটের পথ। আমরা স্টেশনে পৌঁছে যথারীতি মেট্রোর জন্য অপেক্ষা করছি, প্রায় মিনিট বিশেক কেটে গেল কিন্তু কোনো বাহনের দেখা নেই। আমরা একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম, ভুলটা কোথায় গতদিন তো এই স্টেশন থেকেই আমরা মেট্রো ধরেছিলাম। আরো মিনিট পাঁচেক অপেক্ষার পর এক পথচারীকে জিজ্ঞেস করতেই জানাল হলিডে মার্কেটের কারণে আজ এ স্টেশন বন্ধ। মেট্রো ধরতে হলে আমাদের পরের স্টেশন পর্যন্ত যেতে হবে। দূরত্ব খুব বেশি না হওয়ায় আমরা হেঁটেই রওনা হলাম, মাঝখান থেকে আধ-ঘণ্টা সময় অযথাই নষ্ট হলো।


চাতালে বসে রোদ পোহানো

সান মার্কোতে পৌঁছেই আমরা প্রথমে বোটের টিকেট কেটে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম, না আর সময় নষ্ট করতে চাইনি। খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষায় থাকতে হয়নি। বোটগুলো আনেকটা আমাদের দেশের লোকাল বাসের মতো বেশ গাদাগাদি ভীড়। অনেক কসরত করে জানালার পাশে একটু জায়গা পেয়ে আমরা সেখাটাতেই দাঁড়িয়ে বসে যাত্রা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ বাদে ছোট্ট একটি ডেক আবিস্কার করতে পারলাম। আমি আর বশির গিয়ে ডেকে দাঁড়ালাম সেখানটাতেও ভিড়, এরই মাঝে শুরু হলো বৃষ্টি ; এটা অনেকটা শাপে-বর হলো। ডেকটা অনেকটাই ফাঁকা হয়ে গেল। আমি সঙ্গে আনা ছাতা মেলে নিয়ে বেশ গুছিয়েই বসলাম, যদিও বৃষ্টির ছাট থেকে পুরোপুরি নিস্তার ছিল না কিন্তু ভালো লাগা ছিল শতভাগ। জলের ওপর বৃষ্টির নাচন আর কানে গোঁজা হেডফোনে হারানো দিনের গানÑ আমি যেন অনন্ত প্রকৃতির রূপে হারিয়ে গেলাম। বোটে করে আমরা প্রথম যে জায়গাটায় গেলাম সেটার নাম ‘মোরানো’, এটি বিখ্যাত গ্লাস শিল্পের জন্য। যারা নিয়মিত মাসুদ রানার পাঠক বা পাঠক ছিলেন তাদের কাছে এ নামটি বেশ পরিচিত। তবে আজ আমরা এখানে প্রাচীন এক দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য উপভোগ করা ছাড়া অন্য কোনো রহস্যের সন্ধানে আসিনি। আরও একটি উদ্দেশ্য আছে অবশ্য। সে নিয়ে কথা হবে পরের পর্বে...  

[চলবে]