হাসান আরিফ : মানুষের জাগরণে দারুণ বিশ্বাসী এক কণ্ঠস্বর -মীর মাসরুর জামান

26 Apr 2022, 02:59 PM শ্রদ্ধাঞ্জলি শেয়ার:
হাসান আরিফ : মানুষের জাগরণে দারুণ বিশ্বাসী এক কণ্ঠস্বর -মীর মাসরুর জামান

‘মানুষ জাগবে ফের জাগবে মানুষ’ বলে কোথাও থেকে প্রবল এক ধ্বনি কি ভেসে আসছে ? মানুষের জাগরণে এমন দারুণ বিশ্বাসী উচ্চারণ হাসান আরিফের মতো আর কে করতে পারে ? 


হাসান আরিফ। পরানের গহীন ভেতরে যাঁর শুধু মানুষ আর মানুষ। মানবিকতা-মাতৃভ‚মি-মুক্তিযুদ্ধ-মাতৃভাষা যাঁর শিল্পচেতনার উৎস। হাসান আরিফ। আবৃত্তিশিল্পী, সংগঠক, নির্দেশক, প্রশিক্ষক। সৃজনশীল ও প্রগতিশীল সংস্কৃতিজন। সার্বক্ষণিক সক্রিয় সংগঠক। মাত্র ৫৭ বছরের জীবনে প্রিয় দেশজুড়ে তাঁর কত যে কর্মের স্বাক্ষর!  


হাসান আরিফ। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর কুমিল্লার সাহেব বাড়ি নানার বাড়িতে জন্ম। মা রওশন আরা। বাবা আবুল ফজল মো. মফিজুল হক। বড়ো ভাই হাসান ইকবাল আর ছোটো বোন রাবেয়া রওশন। বসবাস ছিল ঢাকায়। পরিবারেই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মাঝে বড়ো হয়েছেন হাসান আরিফ। 


আবৃত্তিজন হাসান আরিফ

আবৃত্তি হাসান আরিফের প্রাণের শিল্প। এই শিল্পের শক্তিতে তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে দেশের প্রথম দিকের আবৃত্তি সংগঠন ‘স্বরিত আবৃত্তি চক্র’র সাথে যুক্ত হন তিনি। এর মধ্য দিয়ে তাঁর সংগঠনভিত্তিক আবৃত্তিচর্চার শুরু। গত শতকের আটের দশকেই আবৃত্তিশিল্পে গুণী শিল্পী ও সংগঠক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান হাসান আরিফ। রাজধানী এবং ঢাকার বাইরের মঞ্চ ও গণমাধ্যমে তাঁর নিয়মিত পরিবেশনা মুগ্ধ করে মানুষকে। নিজের এবং অন্য সংগঠনগুলোর আয়োজনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি একক আবৃত্তি অনুষ্ঠানও করেন হাসান আরিফ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের বাইরে বিভিন্ন মঞ্চে তাঁর উল্লেখযোগ্য আবৃত্তি পরিবেশনা রয়েছে। কিছু যৌথ ও একক অ্যালবামে তাঁর আবৃত্তি সারাদেশ এবং দেশের বাইরের মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। ডিজিটাল যোগাযোগের দ্রুত বিকাশের এই সময়ে ফেসবুক-ইউটিউবসহ অনলাইন মাধ্যমেও তাঁর অনেক আবৃত্তি রয়েছে। 

   

বিভিন্ন সংগঠনের সাথে আবৃত্তি প্রযোজনার গ্রন্থনা ও নির্দেশনা করেছেন হাসান আরিফ। এ পর্যায়ে তাঁর প্রথম প্রযোজনা স্রোত আবৃত্তি সংসদের সাথে ‘আমরা তোমাদের ভুলব না’। এ ছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য আবৃত্তি প্রযোজনাগুলো হলো, স্রোতের সঙ্গে ‘মুক্তিযুদ্ধ রূপকথা নয়’ ও ‘উত্তর নেই প্রশ্নের পাহাড়’; দৃষ্টি এবং চট্টগ্রামের প্রমা’র সঙ্গে ‘মা’, প্রমার সঙ্গে ‘জননী বাংলা’, শ্রুতিঘরের সঙ্গে ‘মুক্তিযুদ্ধ নিরন্তর’, স্বরব্যঞ্জনের সঙ্গে ‘ঘুম নেই অতঃপর’, স্বরশ্রুতি’র সঙ্গে ‘বাংলাদেশ’ ও ‘চিৎকার কর মেয়ে’, পাবনার বনমালী শিল্পকলা কেন্দ্রের সঙ্গে ‘রাখাল রাজার গল্প শোনো’, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গে ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিক ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’। সব কাজেই মুক্তিযুদ্ধ দেশ আর মানুষের কথা বলে গেছেন এই গুণী। প্রযোজনাগুলোর মধ্যে, ‘উত্তর নেই প্রশ্নের পাহাড়’ করোনাকালে অনলাইনে নির্মাণ ও প্রচার করা হয়েছিল। হাসান আরিফের ইচ্ছে ছিল, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে এর মঞ্চায়ন করবেন। 


কিছু উপন্যাসের শ্রুতি পরিবেশনায় কণ্ঠ দিয়েছেন হাসান আরিফ। এর মাঝে ফৌজিয়া খানের নির্মাণে বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস ‘রাত ভরে বৃষ্টি’ শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে। তাঁর এ ধরনের আরও কিছু কাজ অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। 


শিল্পবোদ্ধারা বলেন, হাসান আরিফের নির্মাণ ও পরিবেশনায় সুস্পষ্ট স্বকীয়তা ছিল ; সুগভীর চিন্তার প্রতিফলন ছিল। এই শিল্পের বিকাশে কিছু সফল নিরীক্ষাও তিনি করে গেছেন। তাঁর পরিবেশনা এবং প্রযোজনাগুলোর মধ্যে এর প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। দেশজুড়ে  যে আবৃত্তি প্রশিক্ষণগুলো তিনি পরিচলনা করেছেন সেখানেও আবৃত্তির আঙ্গিক নির্মাণে সৃজনশীল চিন্তার কথা ছড়িয়ে দিয়ে গেছেন হাসান আরিফ।  


সাংগঠনিক আবৃত্তি চর্চায় হাসান আরিফ একপর্যায়ে আবৃত্তি সংগঠন শ্রুতিঘর-এর সঙ্গে যুক্ত হন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই সংগঠনের সঙ্গেই ছিলেন তিনি। শ্রুতিঘরের জন্য অনেক দলীয় আবৃত্তি ও আবৃত্তি প্রযোজনার গ্রন্থনা ও নির্দেশনা করে গেছেন হাসান আরিফ।


আবৃত্তিশিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য হাসান আরিফকে গোলাম মুস্তাফা আবৃত্তি পদক এবং বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি স্মারকে ভ‚ষিত করে বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ। এ ছাড়াও বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভ‚ষিত হয়েছেন তিনি। হাসান আরিফ তাঁর স্বজনদের কাছে বলতেন, দেশের আবৃত্তিশিল্পকে তিনি যে উচ্চতায় দেখে যেতে চেয়েছিলেন তা পারলেন না। 

  

সংগঠক হাসান আরিফ

হাসান আরিফের জীবনে শিল্পচর্চা ও সাংগঠনিক কর্মকাÐ হাত ধরাধরি করে চলেছে। নিজে আবৃত্তি সংগঠন যেমন করেছেন অন্য সংগঠন গড়ে তুলতেও সহযোগিতা করেছেন তিনি। এই কাজ তিনি করেছেন দেশজুড়ে। হাসান আরিফ দীর্ঘদিন বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাথে শুরু থেকেই সক্রিয় হাসান আরিফ একপর্যায়ে এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এই দায়িত্ব পালন করেন। 


নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-সহ দেশের সব গণতান্ত্রিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের আন্দোলনে ভ‚মিকার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা আর জঙ্গিবাদ প্রতিরোধেও সোচ্চার ছিলেন হাসান আরিফ। রাজধানীতে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নির্মম জঙ্গি হামলার পর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে গুলশান পর্যন্ত গান-কবিতার মিছিল শিরোনামে যে সৃজনশীল কর্মসূচি হয়েছিল, তার পেছনে মুখ্য ভ‚মিকা পালন করেন হাসান আরিফ।   


আরিফ ভাই

হাসান আরিফের স্বজনদের একজন বলছিলেন, যারা তাঁর কাছে এসেছেন, তাদের প্রত্যেকেরই জীবনে একটি করে ‘আরিফ ভাই’ স্থায়ী হয়ে আছেন। সব বয়সের মানুষের কাছেই একান্ত আপনজন ছিলেন হাসান আরিফ। সবাই নির্দ্বিধায় সব তাঁর সঙ্গে মিশতে পারতেন। সুখ-দুঃখ সবকিছু নিয়ে কথা বলতে পারতেন। নির্ভার হতে পারতেন। সবারই যেকোনো দুর্দিনে পাশে থেকেছেন হাসান আরিফ। ভিন্ন মাত্রার রসবোধের জন্যও বিখ্যাত হাসান আরিফ। তাঁর সঙ্গে আড্ডার স্মৃতি স্বজন-বন্ধু সবার জন্য এক মূল্যবান সম্পদ।  


তবু ঘুম নেই...

হাসান আরিফ ২০২১-এর ডিসেম্বরে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। সে সময় তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিক ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন অনুষ্ঠানের জন্য আবৃত্তি প্রযোজনা ‘মহাবিজয়ের মহানায়ক’-এর নির্দেশনার কাজ করছিলেন। এই প্রযোজনার মহড়া চলার মাঝেই তাঁর করোনা শনাক্ত হয়। এরপর তাঁকে রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে চারমাস চিকিৎসাধীন থাকেন তিনি। দীর্ঘদিন তাঁকে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যাওয়ায় বেশ কয়েকবারই তার অবস্থা সংকটাপন্ন হয়। হার্ট অ্যাটাকেও আক্রান্ত হন তিনি। ফুসফুস ও কিডনির সমস্যা-সহ তাঁর নানা শারীরিক জটিলতা বাড়তে থাকে। পরিবারের সদস্য বিশিষ্টজন-সহ সারাদেশের সংস্কৃতিকর্মীরা তাঁর সুস্থতা কামনা করতে থাকেন ; চিকিৎসা সহযোগিতার জন্য পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। হাসপাতালে পরিবারের সদস্য এবং যারা তাঁকে দেখতে যেতেন তাদের কাছে অন্য সবার খোঁজ নিতেন হাসান আরিফ। কবিতা শুনতে চাইতেন। আবৃত্তি নিয়ে স্বপ্নের কথা বলতেন। এর মাঝেই তাঁর অবস্থার অবনতি হতে থাকে এবং একপর্যায়ে কোমায় চলে যান তিনি। সবার উদ্বেগ বেড়ে যায়।  


পয়লা এপ্রিল ২০২২, শুক্রবার। চিকিৎসকেরা জানান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি বরেণ্য আবৃত্তিশিল্পী হাসান আরিফ দুপুর ১টা ৫০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। কারণ হিসেবে তাঁরা জানান, মাল্টি অর্গান ফেইলইওর বা বহুবিধ শারীরিক জটিলতা।  শোকে ভেঙে পড়েন পরিবারের সদস্য, স্বজন, শুভাকাক্সক্ষী-সহ সারা দেশের সংস্কৃতিকর্মীরা। শোক প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিশিষ্টজনেরা। 


পরদিন দোসরা এপ্রিল কেন্দ্রীয় শহিদমিনারে হাসান আরিফের প্রতি শ্রদ্ধা জানান সরকারের মন্ত্রিবর্গ ও বিশিষ্টজন-সহ সবস্তরের মানুষ। দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে তাঁর জানাজার নামাজ হয়। পরে হাসান আরিফের ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁর মরদেহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল [বিএসএমএমইউ]-তে চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণার জন্য দান করা হয়। বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ তাঁর এই মহৎ ইচ্ছের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মরদেহ গ্রহণ করেন। 


সবাই বলেন, সারাজীবন মানুষের কথা বলে যাওয়া আর মানুষের জন্য কাজ করে যাওয়া হাসান আরিফ মৃত্যুর পরও মানুষের জন্যই রয়ে গেলেন। কবি তারিক সুজাত ‘হাসান আরিফ’ কবিতায় লেখেন-

‘ফের আমাদের দেখা হবে

শিল্পের যাত্রায় কোনো যতিচিহ্ন নেই

দেখা হবে দেখা হবে ...’