সংস্কৃতি ভালোবাসলে ভালো মানুষ হওয়া যায় - মাসুদুজ্জামান

03 Jan 2021, 02:55 PM আবৃত্তি শেয়ার:
সংস্কৃতি ভালোবাসলে ভালো মানুষ হওয়া যায় - মাসুদুজ্জামান

আবৃত্তিশিল্পী, গণমাধ্যমকর্মী মাসুদুজ্জামান প্রায় ৩০ বছর ধরে স্রোত আবৃত্তি সংসদের সঙ্গে কাজ করছেন। দলের বাইরে বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তিনি। তার আবৃত্তিভ্রমণ ও আবৃত্তিশিল্পের বর্তমান ও ভবিষ্যৎসহ নানা প্রসঙ্গে একান্তে কথা বলেছেন তিনি...


আনন্দভুবন : আবৃত্তিতে আপনার শুরুটা কেমন করে ?

মাসুদুজ্জামান : আমার শৈশব কৈশোর ও তারুণ্যের কিছুটা সময় কেটেছে বরিশালে। বরিশাল শহরে নারী আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী মনোরমা মাসিমা’র হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত মুকুল মিলন খেলাঘরের সঙ্গে যুক্ত হই চার-পাঁচ বছর বয়সে। তারপর বরিশাল শিশু একাডেমিতে আবৃত্তি শেখার কোর্স সম্পন্ন করি। আমার আবৃত্তির গুরু যদি বলি তিনি বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাংবাদিক মীর মুজতবা আলী।

আনন্দভুবন : ঢাকার সংস্কৃতি চর্চার সঙ্গে যুক্ত হলেন কীভাবে ?

মাসুদুজ্জামান : এইচএসসি শেষ করার পর অনেকেরই টার্গেট থাকে ঢাকায় চলে আসার। আমার মধ্যেও সেই প্রবণতা ছিল। তবে আমি ঢাকায় আসি লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে যুক্ত হতে, এবং ভালো থিয়েটারের দলে যুক্ত হতে। যদিও বরিশালে থাকাকালেই ঢাকায় এসে কাজ করতাম। আমি বরিশালেও নাট্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। বরিশালে গ্রাম থিয়েটারের সংগঠন বরিশাল থিয়েটারে যুক্ত ছিলাম। তখন বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে ঢাকা পদাতিকের একটা কর্মশালা করেছিলাম এসএম সোলায়মান এবং মাসুম আজিজের তত্ত¡াবধানে। সেটা ছিল ১৯৮৮-৮৯ সালের দিকে। সেখান থকেই নাটক করার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়।

আনন্দভুবন : ঢাকায় প্রথম কোন দলে যুক্ত হলেন ?

মাসুদুজ্জামান : ঢাকায় এসে নাট্যকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হই। এখন দলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয় না। তবে এখনো দলের সদস্য আছি। নাট্যকেন্দ্রে আমি সবসময় নেপথ্য কর্মী হিসেবেই কাজ করে আসছিলাম। তবে দুই একটা নাটকেও কাজ করেছি। ‘হয়বদন’ নাটকে অভিনয় করেছি, ‘তুঘলক’ নাটকে ছোটো ছোটো চরিত্রে কাজ করেছি। এছাড়া মঞ্চব্যবস্থাপনায় কাজ করেছি।

আনন্দভুবন : আবৃত্তি সংগঠন স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হলেন কবে থেকে ?

মাসুদুজ্জামান : স্রোত আবৃত্তি সংসদের সঙ্গে কাজ করছি ১৯৯১ সাল থেকে। আর স্রোতের জন্ম ১৯৮৮সালে। তখন সভাপতি ছিলেন মাহিদুল ইসলাম। তার আমন্ত্রণে স্রোতের সঙ্গে যুক্ত হই। মাহির সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ও যোগাযোগ ছিল। যখন গত শতকের শেষের দিকে ঢাকায় স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করলাম ; তখন মাহি আমাকে তাদের দলে কাজ করতে বলে।

আনন্দভুবন : স্রোতে আপনি যে যে কাজ করেছেন সেগুলো প্রসঙ্গে বলুন-

মাসুদুজ্জামান : স্রোতে যুক্ত হবার পর এই দলে যত কর্মযজ্ঞ হয়েছে সবগুলোর সঙ্গেই সম্পৃক্ত আছি। আর যদি নির্দেশনা বলেন ; কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে নিশাত আপা [ইশরাত নিশাত] একটি গ্রন্থনা করেছিলেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় মারা যাবার পরপরই সেটার নির্দেশনা দিয়েছিলাম। বুদ্ধদেব বসুর কাব্যনাটক ‘প্রথম পার্থ’ এর নির্দেশনা দিয়েছি। আর গত বছর ‘মানবের জয়গান’ নামে একটি প্রযোজনার নির্দেশনা দিই। পৃথিবীর সকল সরণার্থীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এই প্রযোজনাটি তৈরি। স্রোতের হয়ে আমার একক আবৃত্তি অনুষ্ঠান হয়েছিল ২০১৩ সালে জাতীয় নাট্যশালায়। এর শিরোনাম ছিল ‘পৃথিবীর জয়গান’। দ্রোহ বিদ্রোহ দেশপ্রেম ভালোবাসা সব ধরনের কবিতার সমন্বয়েই ছিল এই আয়োজনটি।

আনন্দভুবন : কোন ধরনের কবিতা আবৃত্তি করতে পছন্দ করেন ?

মাসুদুজ্জামান : সব ধরনের কবিতা আবৃত্তি করতেই আমার ভালো লাগে। যে কবিতার মধ্যে বক্তব্য থাকে সেই কবিতাই ভালো লাগে। একটা সময় দ্রোহের কবিতা আবৃত্তি করতাম, তার পরে আমি একটু রোমান্টিক কবিতার দিকে ঝুঁকে যাই। তবে বাজারকাটতি কবিতায় আমার আগ্রহ নেই। কিছু কবিতা আছে খুব প্রচলিত, সবাই আবৃত্তি করে সে-সব আবৃত্তি করতে আগ্রহ পাই না।

আনন্দভুবন : আপনার আবৃত্তির কোনো অডিও অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন ?

মাসুদুজ্জামান : অডিও অ্যালবাম করা হয়নি। কখনো মনে হয়নি যে, অডিও অ্যালবাম বের করতে হবে। সবসময় দলের সমষ্টিগত কাজের মধ্যেই যুক্ত থেকেছি।

আনন্দভুবন : এখন তো প্রক্রিয়াটা অনেক সহজ, ইউটিউব চ্যানেলে কাজ প্রকাশ করা যায়।

মাসুদুজ্জামান : ইউটিউব চ্যানেল আমারও আছে। তবে আমার ওভাবে কাজ প্রকাশের আগ্রহ নেই। আমি মঞ্চে পথে-ঘাটে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে সরাসরি দর্শকের সামনে কবিতা আবৃত্তি করতেই ভালোবাসি। অডিও বা রেকর্ডের কবিতা আবৃত্তিতে দর্শকের প্রতিক্রিয়াটা পাই না ; যেমন মঞ্চে আবৃত্তি করে পাই।

আনন্দভুবন : করোনার এই সময়ে আবৃত্তি সংগঠনগুলোর অবস্থা কেমন ?

মাসুদুজ্জামান : এখন প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে। তাই এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও আবৃত্তির দলগুলো বসে নেই। তারা সামাজিক এবং শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অনেক বেশি সক্রিয়। সবাই অনলাইনে কমবেশি অনুষ্ঠান করছে। ফলে সবার সঙ্গে সবার যোগাযোগও হচ্ছে।

আনন্দভুবন : নতুন প্রজন্মের আবৃত্তি শিল্পীরা অনেকে এখন ডাবিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে, ডাবিংয়ের সঙ্গে আবৃত্তির সম্পর্ক কতটুকু ?

মাসুদুজ্জামান : ডাবিং একটা ভিন্নতর কাজ এবং ভিন্নতর প্রক্রিয়া। আবৃত্তি ডাবিংয়ের পরিপূরক হতে পারে। যেহেতু আবৃত্তি শিল্পীরা কণ্ঠের চর্চা করে, শব্দ নিয়ে কাজ করে, ফলে তারা সেখানে গিয়ে কাজ করতে পারে বা অনেকে কাজ করছে। ডাবিংয়ের প্রসারে আবৃত্তিশিল্পীদের জন্য নতুন দিগন্ত তৈরি হচ্ছে। যারা আবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত, ভালো আবৃত্তি করতে পারে, সঠিক উচ্চারণ করতে পারে তাদের নিয়ে যদি কাজগুলো করা হয় ; তাহলে একদিকে ডাবিংয়ের মান বাড়বে আরেকদিকে আবৃত্তিশিল্পীদের রোজগারের জায়গা হবে। অনেক নাটকের শিল্পীরাও ডাবিং করছে। ডাবিং একটা ভালো মাধ্যম। কারণ, আমাদের দেশে ভাষাগত সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিদেশি ভাষার চর্চা আমাদের দেশে নেই বললেই চলে। শুধু শহরকেন্দ্রিক খুব অল্প কিছু মানুষ একাধিক ভাষার চর্চা করে। তাই ডাবিংয়ের মাধ্যমে আমাদের দেশের দর্শকেরা বিদেশি অনেক ভালো ভালো অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ পাচ্ছে। তবে ডাবিং একটা ব্যবসায়িক কাজ, ব্যবসায়িক কাজ আর সাংগঠনিক কাজ সাংস্কৃতিক আন্দোলন এক নয়।

আনন্দভুবন : আবৃত্তিকে পেশাদারিত্বের জায়গায় নেওয়া সম্ভব ?

মাসুদুজ্জামান : মঞ্চে যারা অভিনয় করছে তাদের সামনে টিভিতে কাজ করে টাকা রোজগারের একটা সুযোগ থাকে। সেই হিসেবে আবৃত্তির দলগুলো অনেকটাই পিছিয়ে। টিভি মিডিয়াতে আবৃত্তি নিয়ে তেমন কাজ হয় না। ‘আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ’ বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে কীভাবে আবৃত্তি শিল্পীদের আরো বেশি সংগঠিত করতে, কীভাবে আবৃত্তিকে পেশাদারিত্বের জায়গায় নেওয়া যায়। গণমাধ্যমে কীভাবে আবৃত্তির অনুষ্ঠান বাড়ানো যায় এবং অনুষ্ঠানগুলোতে আবৃত্তিশিল্পীদের কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায়। আগে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আবৃত্তি শিল্পীরা নিবন্ধিত ছিল না। শিল্পীদের কাজে ডাকলে একটা ছোটোখাটো সম্মানী ধরিয়ে দেওয়া হত। কিন্তু গত বছর থেকে এই নিয়মটা পাল্টেছে। এখন অডিশনের মাধ্যমে বিটিভিতে আবৃত্তিশিল্পীদের নিবন্ধন করা হচ্ছে।

আনন্দভুবন : আবৃত্তির প্রতি বর্তমান প্রজন্মের আগ্রহ কেমন ?

মাসুদুজ্জামান : সবাই যখন কর্মক্ষেত্রে, কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে ভাষাগত এবং উচ্চারণগত সমস্যায় ভোগে ; তখন উচ্চারণ এবং কথার আঞ্চলিকতা দূর করতে আবৃত্তির কর্মশালা করতে আসছে। যে কারণে আবৃত্তি কর্মশালাগুলোতে অনেক শিক্ষার্থী হয়। এদের সিংহভাগই আসলে আবৃত্তি শিখতে বা চর্চা করতে আসে না।

আনন্দভুবন : সহজলভ্য হওয়ায় এখন অনেকেই ইউটিউবে আবৃত্তি প্রকাশ করছে, এই বিষয়টাকে কোন দৃষ্টিতে দেখছেন ?

মাসুদুজ্জামান : এই সমস্যা আগেও ছিল এখনও আছে। অনেকে মনে করে গলা মোটা হলেই আবৃত্তি ভালো করা যায়। একসময় আনকোরা অনেকে ক্যাসেটও বের করত। একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, চর্চার মাধ্যমে শিখতে হয়। সময় দিতে হয়। তারপর এসব করতে হয়।

আনন্দভুবন : করোনার এই সময়ে কী করছেন ? সামনের পরিকল্পনা নিয়ে বলুন-

মাসুদুজ্জামান : যা হচ্ছে চারিদিকে তার সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত আছি। এবং নিজে এখনো ভাবি, আরো ভালো আবৃত্তি করব। তবে আমার দল থেকে সামনে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার ৫০ বছর নিয়ে একটা আবৃত্তির প্রযোজনা করব।

আনন্দভুবন : সাংস্কৃতির অঙ্গনে যুক্ত থাকতে পরিবারের সাপোর্ট কতটা পেয়েছেন বা পাচ্ছেন ?

মাসুদুজ্জামান : পেশাগত জীবনে আমি একজন গণমাধ্যম কর্মী। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে অনুষ্ঠান বিভাগের কাজ করেছি। স্রোত আবৃত্তি সংসদে আমি বর্তমানে কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে আছি। বিগত দিনে আমি এখানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি, আর বর্তমানে আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত থাকতে মা-বাবার সাপোর্ট শিশুবয়স থেকেই পেয়ে এসেছি। আমার পরিবারের সবাই সংস্কৃতিমনা মানুষ। সবাই অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে এসেছে। আমার স্ত্রীও সমর্থন করে। আমার সন্তান যদিও ইংরেজি মাধ্যমে পড়ালেখা করে, সেও আবৃত্তি করার চেষ্টা করে, সে ছায়ানটে গান শেখে।

আনন্দভুবন : আপনার নিজের কিছু বলার থাকলে বলুন-

মাসুদুজ্জামান : আবৃত্তি আসলে সহজ কোনো বিষয় নয়। বাঙালি সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী যদি হন আবৃত্তিতে আসুন। আবৃত্তি করতে এলে মানুষকে দেশকে ভালোবাসতে পারবেন, দেশকে ভালোবাসলে সংস্কৃতি ভালোবাসতে পারবেন, সংস্কৃতি ভালোবাসলে ভালো মানুষ হওয়া যায়। ভালো মানুষ হলে ভালো একজন শিল্পী হওয়া সম্ভব। আবৃত্তির কর্মশালা করলেই আবৃত্তি শিল্পী হওয়া যায় না। তার জন্য অধ্যবসায়, চর্চার দরকার আছে। 

সাক্ষাৎকার : নিথর মাহবুব