ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

29 May 2022, 02:44 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার


[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


বলছিলাম মোরানোর কথা, বাংলার দুর্ধর্ষ নায়ক মাসুদ রানার এক দুর্ধর্ষ কাহিনির প্লট যে শহরকে ঘিরে সেখানে গিয়ে আমরাও কিছুটা রোমাঞ্চিত কিছুটা নস্টালজিকও বটে ; তবে বাস্তবিক মোরানো যে কারণে বিখ্যাত সেই গ্ল্যাস ফ্যাক্টরির একটিতে ঢুকার সুযোগ পেয়ে আমরা বর্তে গেলাম। এগুলো আসলে তেমন কোনো রেসটিকটেট এরিয়া না, যে কেউ চাইলেই যেতে পারে। ফ্যাক্টরিগুলোর একপাশে কিছুটা অংশ জুড়ে রয়েছে ডিসপ্লে কর্নার যেখান থেকে চাইলে পর্যটকেরা পছন্দমাফিক পণ্য কিনে নিতে পারে। অন্যধারটিতে কারখানা, যেখানে কাঁচ গলিয়ে অসাধারণ সব পণ্য তৈরি হয়। গয়না থেকে শুরু করে ঘর সাজানো নানান পণ্য তৈরি হয় ছোট্ট খুপরির মতো এই কারখানাগুলোতে, গনগনে আগুনে সরাক্ষণ কাঁচ গলছে তাতে মেশানো হচ্ছে বাহারি রং, ফেলা হচ্ছে নানান ছাঁচে। ডিসপ্লে কর্নারটাতে ঢুঁ মারলাম টুকটাক কিছু কিনব বলে। কাচ দিয়ে তৈরি গয়না যে এত সুন্দর হতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা একটু কঠিন। আর তাদের দাম শুনে মনেই হতে পারে এতো কাচ হীরে তো নয় ! আসলেই হীরের চেয়ে যেন বেশি দাম কিছু কিছু গয়নার, তবে তা যে খুব অস্বাভাবিক ঠেকেছে তা কিন্তু নয়। বাজে ফ্রেন্ডলি পণ্যও আছে, খোঁজ করে আমরা টুকটাক কিছু কিনেও নিলাম। একটা ফরমাইশি অর্ডার ছিল সহপাঠী নাসরিনের জন্য ফুলদানি কিনতে হবে, সেটাও হলো। মোরানো জায়গা আসলে পুরোটাই পানির উপর, এ বাড়ি ও বাড়ি বা এ পাড়া ও পাড়া যেতে নৌকা বা ব্রিজ ছাড়া গতি নেই- পুরো এলাকা জুড়ে মাটির দেখা পাওয়া ভার। তবে, এই ব্রিজগুলো কিন্তু বেশ দৃষ্টিনন্দন। অনেকটা এন্টিক ছোঁয়া, সঙ্গে প্রাত্যহিক যত্নের ছাপও বিদ্যমান। ইউরোপের অধিকাংশ শহরের যে জিনিসটি আমাকে খুব আপ্লুত করেছে তা হচ্ছে শহরবাসীর সৌন্দর্য বোধ, প্রতিটি বাড়ির বেলকনি বা জানালার সেডে কোনো না কোনো এক বা একাধিক ফুলের টব থাকবেই। আর বসন্ত, গ্রীষ্ম বা শরতে বাহারি ফুলের নজরকাড়া রূপ আর রং মনকে এমনিতেই প্রশান্তি দেয়, তা সে ফুলের মালি বা পথ চলতি পথিক কেউ এর থেকে বঞ্চিত নয়। ছিলাম কোথায় চলে এলাম কোথায়, বলছিলাম মোরানো শহরের ছোটো ছোটো ব্রিজের কথা, যার নির্মাণের নান্দনিকতার সঙ্গে বাড়তি রূপ যোগ হয়েছে বাহারি ফুলের ঝাড়ে। প্রতিটা ব্রিজ যেন এক একটি ঝুলন্ত বাগান। 

মোরানোতে আমরা যে দিকটায় নেমে ছিলাম, জায়গাটার পরিসর খুব একটা বড়ো নয়, ঘন্টাখানেকের মধ্যেই এখানকার সকল আয়োজন দেখা শেষ, এরপর নতুন গন্তব্য সেন্ট মার্কস স্কয়ার, যাত্রার বাহন যথারীতি নৌকা। মোরানো গ্ল্যাস কোম্পানি থেকে সেন্ট মার্কস স্কয়ারের দূরত্ব খুব বেশি না, যেতে মাত্র মিনিট বিশেক সময় লাগে। সেন্ট মার্কস স্কয়ার মূলত ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। কথিত আছে সেন্ট মার্ক নামে কোনো যাজকের নামে এই এলাকাটির নামকরণ, যার দেহাবশেষ এই এলাকায় সংরক্ষিত। সম্ভবত ৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ভেনিসে সংঘটিত ধর্ম যুদ্ধে ভেনিসের বিজয় এই অঞ্চলটিকে বেশ সমৃদ্ধ করে তোলে, যার নিদর্শন এখনো বর্তমান। ব্যাসিলিকা ডি সান মারাকো নামের চার্চটির বিভিন্ন থাম বা গম্বুজ সোনায় মোড়ানো বলে জানা যায়, যদিও তা লোকচক্ষুর আড়ালেই থাকছে, কেননা, চার্চের ভেতরে সাধারণের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। যাক, ইতিহাসের কচকচানি থেকে ফেরত আসি, এটা কখনোই আমার প্রিয় বিষয় নয়। আমি প্রকৃতিপ্রেমী, যদিও প্রত্মতাত্ত্বিক সৌন্দর্য উপভোগে আমার অনিহা নেই, তবে ইতিহাসের আদি-অন্ততে আমার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। 

সেন্ট মার্কস স্কয়ার- এটি আসলে বিচ্ছিন্ন কোনো স্থাপনা নয়। বলা যায়, দ্বীপ-মতো পুরো জায়গাটা জুড়ে রয়েছে চার্চ, প্রাসাদতুল্য অট্টালিকা, রয়েছে মার্কেট, রেস্তোরাঁ আর বেশ খানিকটা প্রশস্ত পাথুরে খোলা চত্বর। স্থাপনা বেশ প্রাচীন হলেও ব্যবহারের দিক থেকে নতুন পুরাতন দু’ধরনের ভাবনা বা প্রয়োজনের মিশ্রণ রয়েছে। ছোটোখাটো একটি মিউজিয়ামও রয়েছে এখানে। খোলা চত্বরটিতেই আসলে পর্যটকদের অবাধ বিচরণ। এটা অনেকটা মেলার মতো ভ্যান গাড়ি বা বিভিন্ন বক্সমতো গাড়িতে অস্থায়ী সব দোকান সাজানো। কি নেই সেখানে ? মোবাইলের চার্জার থেকে শুরু করে বাহারি ক্যাপ অথবা কোট এমনকি গায়ের চাদর- সবই এখানে পাওয়া যায়। তবে সেন্ট মার্কস স্কয়ারের যে জিনিসটি আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে, তা হচ্ছে লক্ষ লক্ষ কবুতর। কবুতরের জন্য খাবারও এখানে কিনতে পাওয়া যায়, একমুঠো খাবার মুঠো খুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর এসে হাজির। শুধু এখানে নয়, পুরো ইউরোপজুড়ে এটা একটা মজার ব্যাপার, কবুতর অথবা বালি হাঁস এমনকি সিগার্লও, এরা মানুষকে মোটেই এড়িয়ে চলে না। খাবার নিয়ে ডাকলেই কাছে চলে আসে। আসলে তাদের মনে ভয় তৈরি হতে পারে এমন কোনো ঘটনা মানুষ ঘটায়নি বলেই হয়ত। প্রকৃতি আর পশুপাখির প্রতি তাদের ভালোবাসাই তাদের জন্য প্রকৃতিকে অবাধ আর পশু-পাখিকে নির্ভয় করেছে।

আমাদের মধ্যে কেউ কেউ কেনাকাটায় ব্যস্ত ছিল, কেউ-বা আপন মনে পুরো দ্বীপটি ঘুরে বেড়িয়েছে, কেউ-বা আবার কবুতরের সাথে সখ্য গড়ে তুলতে ব্যস্ত ছিল। ঘণ্টাদু’য়েক সময়ের হয়েত কিছু বেশি আমরা এখানে কাটিয়ে দিলাম। দুপুর গড়াচ্ছে, আমরা ফেরার তাগিদ বোধ করছি। কারণ, সেই যে ক্ষুধা, তাকে তো খুব বেশি অবহেলা করা যায় না। আমরা ফিরতি ফেরি ধরার জন্য ঘাটে এলাম, ফেরিতে ওঠার জন্য কিউও দিলাম, তখনই বশিরের খুব শখ হলো স্পিডবোটে ফিরবে। শখের দাম লাখ টাকা, তাই আমরাও ফেরি ভাড়ার প্রায় পাঁচগুণ টাকা খরচ করে স্পিডবোট ভাড়া করে আমাদের গন্তব্যে ফিরে এলাম।

তবে যাই বলি, টাকাটা কিন্তু জলে যায়নি। খালের অলিগলি ধরে স্পিডবোটের দ্রুত চলনে আমার যেন বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছিলাম। এরই মাঝে শুরু হলো গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি- সেটাও বেশ উপভোগ্য, আসলে মানুষ সবসময়ই গতি পছন্দ করে, গতি আনন্দকেও গতিশীল করে। আমরা যতক্ষণে মাটিতে পা রাখলাম, ততক্ষণে বিকেলের ক্ষণগোনা শুরু হয়ে গেছে, রাতে বশিরের এক খালা, যিনি ভেনিসের বাসিন্দা তার বাসায় আমাদের দাওয়াত, খাল সন্ধেনাগাদ আমাদের ক্যাম্প হাউজ থেকে পিক করবেন। আমরা সান পলো থেকে বাসে আমাদের ক্যাম্প হাউজের কাছাকাছি স্টপে পৌছলাম, তখন ঘড়ির কাঁটা চারটা পেরিয়ে পাঁচটার দিকে দৌড়–চ্ছে। তখনো পর্যন্ত আমাদের দুপুরের খাওয়া হয়নি। কাছাকাছি একটি ঘরোয়া টাইপ রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকে পড়লাম কিছু খেয়ে নেব বলে। যেহেতু হাতে সময় কম, তাই অত বাছবিচারে না গিয়ে ডিমের ফ্রাইড রাইস অর্ডার করে বসলাম। না এরা আসলে আতটা প্রফেশনাল নয়। এই সাদামাটা ডিমভাত সার্ভ করতে আধ ঘন্টা পার করে দিলো। কোনোমতে নাকে-মুখে গুঁজে আমরা আক্ষরিক অর্থেই দৌড়ে ক্যাম্প হাউজে পৌছলাম। কেননা, ছয়টার মধ্যে আমাদের আবার বেরিয়ে পড়তে হবে। যেহেতু সারাদিন নোনা জলে ভেসে বেড়ালাম তাই গোসল না করলেই চলছিল না। সবকিছুতেই তাড়াহুড়া করেও শেষ রক্ষা হলো না, বশিরের খালুকে প্রায় আধ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হলো।

ইউরোপের ছিচ্কাঁদুনে বৃষ্টি সেই বিকেলে শুরু হয়েছে তখনো থামার নাম নেই। তবে বৃষ্টিভেজা পথ আর রাতের নরম আলো এক অপার্থিব সৌন্দর্যের সূচনা করেছে। আমাদের আবাসস্থল থেকে বশিরের খালার বাড়ির দূরুত্ব বেশ, প্রায় ঘন্টাদেড়েক সময় লাগলো পৌঁছুতে। বশিরের খালার বাড়ি ভেনিসের মূল শহর থেকে বেশ দূরে, জায়গাটার নাম মিনি ভেনিস, কেন এমন নাম তা আর জানা হয়নি। আমরা যখন খালার বাড়ি পৌছলাম এত উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম যে, এই অতিরিক্ত তাড়াহুড়া করে তৈরি হয়ে আসতে হলো বলে মনের কোণে যে খানিকটা বিরুক্তি জমা ছিল তা নিমিষেই উধাও তো হলোই বরং মনে মনে একটু লজ্জাও পেলাম। এ যাবত ইউরোপে যত বাড়িতে গিয়েছি সব বাড়িই বেশ ছোটো ছোটো ছিল, এই প্রথম এমন একটি বাড়িতে এলাম যা দেখে আমাদের দেশের পুরোনো আমলের বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। আর বাড়ির ভেতরের সাজসজ্জা একেবারে আমাদের বাড়িঘরের মতো সাদাসিধে। যতক্ষণ খালার বাড়িতে ছিলাম, মনে হচ্ছিল যেন বাংলাদেশেই আছি, দেশের মধ্যেই কারো বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছি। বশিরের খালা, খালাতো বোন-ভাই আর খালু সবাই এত অল্প সময়ে আমদের এত আপন করে নিয়েছিল যে, মনেই হয়নি সেদিনই প্রথম তাদের সঙ্গে আমাদের দেখা। গল্প-আড্ডা আর ভুড়িভোজের পর্ব শেষে ফেরার কথা বলেতেই যেন খালার মন খারাপ হয়ে গেল, খুব চাচ্ছিলেন তাদের সাথে রাতটা কাটিয়ে দিই। কিন্তু আমাদের উপায় ছিল না। কেননা, পরদিন আমাদের যাত্রা ছিল নতুন কোনো গন্তব্যে... [চলবে]