ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

20 Jun 2022, 02:26 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

বলছিলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের কথা, পরদিন ভোরে আলো ফোটার আগেই আমরা পথে ; অবশ্য আগের রাতে হোটেলের রিসিপশনে কথা বলা ছিল তারাই গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছিল। আমরা প্রথমে ভেনিসের সেন্ট্রাল বাস স্টপে গেলাম, এখান থেকেই মিলানের বাস ছাড়ে। আমাদের প্রাথমিক যাত্রা ইটালির মিলানকে সামনে রেখে, তবে সেটা মূল গন্তব্য নয়। মূল গন্তব্যের আলোচনায় পরে আসছি এখন এই বাস স্টপ এলাকা সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়। ভেনিস মূলত একটি সমুদ্র নগরী যদিও এর মূল আকর্ষণ শত শত খালের আঁকিবুকি যার বিস্তার বিস্তির্ণ তাই বলে সে কিন্তু তার মূল পরিচয় হারিয়ে ফেলেনি। কবির ভাষায় বলি “এক গৌরবময় সমুদ্র-নগরী রয়েছে। উঁচু-নীচু ঢেউয়ের সঙ্গে সমুদ্রটা চওড়া ও সরু রাস্তায় বয়ে যায় ; আর লবণাক্ত সমুদ্র-শৈবাল প্রাসাদগুলোর মর্মরপ্রস্তরে লেপটে থাকে।” (স্যামুয়েল রজার্স, ইংরেজ কবি)। আমরা এখন সমুদ্রনগরীর সেই সমুদ্র পারে অথবা বলা যায়, জেটিতে, যেখানটায় বিশ্বের নাম করা সব বিলাসবহুল জাহাজের আড্ডা। ও হ্যাঁ সমুদ্রুরের নামটিই বলা হয়নি এখনো। আমি অবশ্য এ নামটির সাথে আগে কখনোই পরিচিত ছিলাম না, আ্যাড্রিয়েটিক সাগর। ভেনিস যে সমুদ্রনগরী তা যেন হঠাৎ করেই আমাদের জানা হলো, যদি আমরা মিলানের বাসে না যেয়ে অন্য কোনো বাহনে যেতাম তবে হয়ত তা অজানাই থেকে যেত।

সতর্কতা স্বরূপ আমরা অনেকটা আগেভাগেই বাস স্টপে চলে এসেছি, এত ভোরে নাস্তা করা সম্ভব হয়নি তাই ফুরসত পেয়ে কাছাকাছি কফিশপে কিছু হালকা খাওয়া হলো সাথে অবশ্যই কফি। জেটির ধারে খোলা চত্বরে পাগলা হাওয়ার সাথে কফি সত্যিই অসাধারণ। সম্ভবত সকাল সোয়া আটটা নাগাদ বাস ছেড়েছে। এক শহর থেকে অন্য শহরে বেশ লম্বা একটা পথ, একটু সংশয় ছিল যাত্রা কেমন হবে। না যাত্রা পথ বেশ আরামদায়কই ছিল, তফাৎ এই যে, সময় একটু বেশি লাগল। আমরা মিলানে পৌঁছালাম বেলা এগারোটার কাছাকাছি সময়ে। এখানে মিনিট ত্রিশের যাত্রা বিরতি, তারপর অন্য বাসে অন্য দেশে যাওয়া। সেখান থেকে বেশ কঠোর ইমিগ্রেশন ফেস করে তবেই পরবর্তী বাসে উঠতে হলো, হ্যাঁ এখন যাচ্ছি মূল গন্তব্যের পথে পৃথিবীর স্বর্গ অথবা যবধাবহ ড়ভ earth নামে খ্যাত স্বপ্নের সুইজারল্যান্ড।স্বপ্নের সুইজারল্যান্ড, আমার কাছে তো তাই আর এ নিয়ে আমার মধ্যে বেশ অবসেশনও কাজ করত। একটা গল্প বলি, একসময় আমরা বেশ কয়েকজন কলিগ মিলে বেশ চেষ্টা চরিত্র করছিলাম strengthening project-এর আওতায় ইংল্যান্ডে মার্স্টাস করতে যাবো, বিষয়টি নিয়ে সবাই বেশ এক্সাইটেট, আমিও তাই। তবে, আমার এক্সাইটমেন্ট অবশ্য অন্য বিষয়ে, সেটা হচ্ছে ইংল্যান্ড থেকে সুইজারল্যান্ড যাব। অন্যদের সাথে বিষয়টি শেয়ার করতেই তারা বলল, এটা বেশ খরচের ব্যাপার। আমি তখনই ভেবে নিয়েছিলাম হোক খরুচে ব্যাপার একদিনের জন্য হলেও যাব। এখন ভাবি কেন যে একদিনের কথা ভেবেছিলাম ? যাই হোক strengthening project-এর আওতায় আমার আর মাস্টার্স করা হয়নি কিন্তু পরবর্তী নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির এক্সেঞ্জ কোর্সের আওতায় নরওয়ের বার্গেন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসে সুযোগ হলো সুইজারল্যান্ড যাবার। তবে দিন শেষে এই একরাত দুই দিনের ভ্রমণ নিয়ে আমার আক্ষেপের শেষ নেই, সীমাহীন এই সৌন্দর্যের কিছুই তো দেখা হলো না।

ফিরে আসি পথে, মিলান থেকে জুরিখ প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার পথ। পাহাড়ি উপত্যকার মাঝ দিয়ে পথ দু’ধারে প্রকৃতির অপার্থিব রূপ। চলন্ত পথের এ সৌন্দর্য আসলে শব্দকথায় তুলে ধরা অসম্ভব, বিস্তীর্ণ সবুজের মাঝে কখনো গাঢ় নীল অথবা সবুজ লেক যার তীর ঘেঁষে রয়েছে বর্ণিল তৃণজাতীয় গাছের ঝোপ, ছোটো ছোটো লতাগুল্ম। মনে হতে পারে এ আর এমন কি ? আসলে এটা যে বিজন পথের কোনো ছবি বা দৃশ্য তা বিশ্বাস করতে মন চায় না। কেউ যেন অতি যত্নে তার শখের বাগান গড়ে তুলেছে। এই সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে তুলতে কখনো কখনো চোখে পড়ছে দুধসাদা ভেড়ার পাল। জুরিখের সেন্ট্রাল বাস স্টপে পৌঁছানো পর্যন্ত এই সাড়ে চার ঘণ্টার দৃশ্যপট ক্ষণিকের জন্যও দৃষ্টিকে ক্লান্ত করেনি, বরং সারাক্ষণই একটা ভয় করেছে এইবুঝি পথ ফুরালো।আমরা যখন জুরিখে পৌঁছলাম তখন বেলা বোধকরি সাড়ে চার বা পাঁচের কাছাকাছি, বাস থেকে নেমে হোটেলে যাবার আগে খেয়ে নিব বলে ঠিক করলাম, এতক্ষণ সুন্দরের মোহে ক্ষুধা-তৃষ্ণার অনুভূতি উহ্য ছিল এখন টের পাচ্ছি যা আর অবহেলা করা যাবে না। আসলেই এমনিতেই তো অনেক দেরি হয়ে গেল। হোটেল খুঁজে নিয়ে রুম বুঝে পেয়ে তারপর আবার ফ্রেশ হয়ে বের হতে হতে ডিনার টাইম হয়ে যাবে তাই এ বেলা খেয়ে নিয়ে ম্যাপ দেখে তারপর নির্ধারিত মেট্রো স্টেশন খুঁজে পেতে বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল। আমাদের হোটেলটা মেট্রোর স্টেশনের শেষ মাথায়। অর্থাৎ সেখান থেকেই মেট্রোগুলো আবার ইউটার্ন নেয়। আমরা যখন হোটেলে পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের পর্ব শুরু। হোটেলের আনুষ্ঠানিকতা শেষে রুম বুঝে নিতে প্রায় আধ ঘণ্টা সময় লেগে গেল। হোটেল রুমগুলো খুব আহামরি না হলেও মন্দ না। তবে, দুঃখের বিষয় হচ্ছে বাথরুম এটাচ্ট না। একধারে সারি সারি রুম, মাঝামাঝি জায়গায় কিচেন, ডাইনিং আর কর্নারের দিকে সারি করে বাথরুম, অনেকটা হোস্টেল টাইপ লুক। সারাদিনের বাস জার্নির ধকল এতক্ষণে টের পাওয়া যাচ্ছে, তাই গোসল করে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে তারপর রাতের খাবারের জন্য বের হলাম। রাত তখন খুব বেশি না, ঘড়ির কাঁটায় নয়টা কি সাড়ে নয়টা কিন্তু বের হয়ে মনে হলো যেন নিশুতি রাত।
ইউরোপে যাওয়ার আগে আমার যেমন ধারণা ছিল যে, ইউরোপে রাত-দিনের তেমন কোনো তফাৎ নেই, আদতে কিন্তু তা নয়, ইউরোপের অধিকাংশ শহরই কিন্তু রাত নামতেই ঘুমিয়ে পড়ে, কিছু নির্ধারিত স্থান ছাড়া। আমরা যখন রাতের খাবারের জন্য বের হলাম তখন পথ পথিকশূন্য আর দোকানপাট প্রায় সবই বন্ধ, এমনকি খাবারের দোকানও। যেহেতু খেতেই হবে তাই হাল না ছেড়ে আমরা বেশ খানিকটা পথ হেঁটে অবশেষে একটি ইন্ডিয়ান রেস্তোরা যদিও খুঁজে পেলাম কিন্তু ততক্ষণে তারা পাততাড়ি গুটাতে ব্যস্ত। তবে আমাদের ক্ষুধার্থ চেহারা দেখে বোধকরি তাদের মায়া হলো। যাই হোক, শেষমেশ যা অবশিষ্ট ছিল তাই দিয়ে রাতের খাবার খাওয়া হলো, তবে তা কোনোভাবেই মন্দ ছিল না পালংপনির, সাদাভাত, সবজি আর ডাল। রান্নাটা নিঃসন্দেহে বেশ ভালো ছিল, শেষ বেলার কাস্টমার বলে তাদের অতিরিক্ত মনোযোগ আর আন্তরিকতাও বেশ উপভোগ্য ছিল।

রাতের খাওয়া শেষে আমরা কিছুক্ষণ জুরিখের পথে নৈশ-ভ্রমণ করলাম, নিঝুম পথ নিয়ন আলোর মায়াবী রূপ পথ-ঘাটকে যেন রূপকথার স্বপ্নপুরী করে তুলেছে। শীতের বাতাস জোরালো। তবে, অতটা দাপুটে নয়। হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে, পথে আমরা চার পথিক ছাড়া হাতে গোনা দু’একজন পথচারীর দেখা মিলছে। আমরা যে পথে হাঁটছি এটা কিন্তু কোনো গলি পথ নয়, দিনের বেলা এ পথেই বাস, মেট্রো চলে তবে এখন শুনশান নীরবতা। এই নীরবতার মাঝে আমরাও বাকহীন পথ হাঁটছি, একসময় পথ এসে আমাদের হোটেলে পৌঁছে গেল, আমরাও ফিরলাম আমাদের অস্থায়ী নীড়ে। রাতে সবাই মিলে কিছুক্ষণ গল্প-গুজব শেষে আগামী দিনের পরিকল্পনা ঠিক করে নিয়ে ঘুমুতে গেলাম। [চলবে]