ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

03 Jul 2022, 02:41 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

পরদিন নাশতা সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম, প্রথম গন্তব্য ট্রেন স্টেশন, সেখান থেকে রাইন ফলস্। আমরা যে এলাকাটায় রয়েছি সেখান থেকে মেট্রোতে রেল স্টেশন মিনিট বিশেকের পথ। রেল স্টেশন, সেন্ট্রাল বাস স্টপ সব প্রায় কাছাকাছি। রাইন ফলস্-এ বাসেও যাওয়া যায়, তবে সময় একটু বেশি লাগে প্রায় ঘণ্টাদেড়েক। অন্যদিকে ট্রেনে যেতে সময় লাগে ৪০ থেকে ৫০ মিনিট। আর বলা বাহুল্য ইউরোপের ট্রেন জার্নি নিঃসন্দেহে অসাধারণ। রেল স্টেশনটির নাম স্টাডেল হোফেন, যথারীতি ইউরোপের অন্যান্য রেল স্টেশনগুলোর মতোই ছিমছাম সুন্দর, তফাৎ এটাই একটু বেশি নিরিবিলি, এখানটায় কিছুক্ষণ থাকার পর কেমন যেন একটা নিঃসঙ্গতা পেয়ে বসে। আমরা সম্ভবত সকাল সাড়ে দশটার ট্রেন ধরতে পেরেছিলাম। এই প্রথম দ্বিতল ট্রেনে ওঠা। এটা আমাদের জন্য সারপ্রাইজিং ছিল। কেননা, ট্রেনে ওঠার আগ-অবধি আমরা জানতাম না যে ট্রেনটি দ্বিতল। উঠে যার পর নাই এক্সাইটেড, আর সিন্ধান্ত নিতেও দেরি হলো না আমরা সরাসরি দোতলায় উঠে গেলাম। আগেই বলেছি বোধহয় ইউরোপে ট্রেনে আগেভাগে কোন সিট নাম্বার দেয়া হয় না। যাত্রীরা তাদের পছন্দ মতো সিট বেছে নিয়ে বসতে পারে। হয়ত আসনের তুলনায় যাত্রী বরাবরই কম থাকে বলে এ নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। আমরা মুখোমুখি আর পাশাপাশি চারটি সিট নিয়ে বেশ গুছিয়েই বসলাম, আসলে চারটি আটজনের সিটে আমরা যাত্রী চারজন। ট্রেনে যাত্রী সংখ্যা কম থাকায় আমাদের কাউকেই জানালার পাশের সিটটি সেক্রিফাইস করতে হয়নি।

ট্রেনে ওঠার আগ পর্যন্ত আমাদের যে উত্তেজনা ট্রেন চলার সাথে সাথে তা যেন ভাষাহীন গভীর নীরবতায় রূপ নিল। সৌন্দর্যের আতিশয্য বোধকরি নীরবতা দিয়েই উপভোগ করতে হয়, তা না হলে সুন্দরকে পুরোপুরি উপলব্ধি করা যায় না। এরপর টানা ঘণ্টাখানেকের মতো সময় বাইরের ছবির মতো চলমান দৃশ্যপট যেন মর্ত্যরে পৃথিবী ছেড়ে আমাদের কোন স্বপ্নরাজ্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ি উপতক্যায় যেমন রয়েছে সবুজ ঘাসের দেশ, তেমনি রয়েছে রংধনুর নানান রঙের দিগন্ত বিস্তৃত ফুলের বাগান। কেমন করে সম্ভব বিজনে এমন আয়োজন, আমাদের কল্পনার আতীত। যেভাবেই বলি না কেন, পথের সে রূপের প্রকৃত বর্ণনা লেখনিতে তুলে আনা সম্ভব নয়, তাই আর বৃথা চেষ্টা না করি, তবে রাইন ফলস্ নিয়ে কিছু কথা না বললেই না। এও যে প্রকৃতির খেয়াল, না কোনো সৌন্দর্য পিপাসু কারিগর তার মনের মাধুরী দিয়ে কল্পনার সব আয়োজন দৃশ্যপটে তুলে এনেছে তা নিয়ে ধন্দে পড়তে হয়। ট্রেন থেকে নেমে কিছুটা হাঁটা পথ, তারপর রয়েছে লিফট্ ; পাশাপাশি সিড়িও রয়েছে, অর্থাৎ আমাদের এখন উপরে উঠতে হবে। আমরা অন্যদের দেখাদেখি লিফটেই উঠলাম। কেননা, কোথায় গিয়ে থামতে হবে যেহেতু জানা নেই তাই দলের সঙ্গে থাকাই ঠিক মনে হলো। অবশ্য অচেনা জায়গায় আমি প্রায়ই এমনটা করি, সে ক্ষেত্রে ভুল পথে যাওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। আর যেখানে পথনির্দেশ থাকে বা ভাষাজনিত কোনো সমস্যা না থাকে সে ক্ষেত্রে অন্য বিষয়। যাই হোক, আমরা উপরে উঠে এলাম যেখান থেকে পুরো রাইন ফলস্ দৃশ্যমান। এরই মাঝে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ভিউ পয়েন্ট, তাছাড়া দৃষ্টিনন্দন সেতু দিয়ে ফলস্-এর এপার-ওপার সংযুক্ত। আমরা চিহ্নিত ভিউ পয়েন্ট-গুলো এড়িয়ে গেলাম প্রচণ্ড ভীড় বলে, তারচে নিরিবিলি হেঁটে চলে নিজের মতো করে এখানে সেখানে ঘুরে-ফিরে দেখাটাই উত্তম মনে হলো। এতে করে প্রকৃতির নিজস্ব ছন্দকে উপলব্ধি করা যায়। রাইন ফলস্-এ অবশ্য বোটিং এর সুযোগও আছে কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে আমরা সে পথে গেলাম না ; অন্যদের বোটিং দেখেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হলো।রাইন ফলস্-কে ঘিরে পুরো এলাকাটি সেজে উঠেছে মায়াবী প্রকৃতির নিবিড় ছোঁয়ায়। রয়েছে ফুলের বাগান, ক্যাফে এমনকি হলিডে হাউজও আছে। বাচ্চাদের জন্য অ্যামিউজমেন্ট এর ব্যবস্থাও রয়েছে, তবে কোনো আয়োজনই কিন্তু রাইন ফলস্-এর নিজস্বতাকে ম্লান করে করা নয়। আমরা মাত্র ঘণ্টাখানেক এখানে কাটানোর সুযোগ পেয়েছি। ওই যে বললাম সময়ের স্বল্পতাÑ ও আচ্ছা, বলা হয়নি, আমরা আজই জুরিখ ছেড়ে যাচ্ছি আমাদের পরবর্তী গন্তব্য প্রাগে। জুরিখ ছেড়ে যাচ্ছি এটা না যত দুঃখের বিষয় তারচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো এখানে কাটানো সময়ের অনেকটা আমাদের পথেই খরচ করতে হলো। যেমন এসেছি বাসে স্বাভাবিকভাবেই সময় বেশি লেগেছে, যদিও প্লেনে করেই প্রাগে যাব কিন্তু ভুলটা হলো প্যারিস থেকে রোমে যাবার ক্ষেত্রে যে ভুল হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি অর্থাৎ অভিজ্ঞতার অভাবে প্লেনের ভাড়া বাঁচাতে গিয়ে তিনগুণ ট্যাক্সি ভাড়া গুনতে হয়েছে। আচ্ছা খুলেই বলি, আমরা যখন জুরিখ থেকে প্রাগে যাওয়ার টিকেট কাটলাম তখন সবচেয়ে কম খরচে যে টিকেটটি পাওয়া গেল আমরা তাই কেটে নিলাম ; যে কাজটা করে ছিলাম প্যারিস থেকে রোমে যাওয়ার ক্ষেত্রে তখন অবশ্য টেক্সি খরচ লাগেনি কারণ আমার ভাই [কাজিন] আমাদের বিমানবন্দরে পৌছে দিয়েছিল, তবে সেও ছিল এক রুদ্ধশ্বাস ঘটনা যারা সে পর্বটি পড়েছেন তারা জানেন। আমরা ব্রাসেল অ্যায়ারপোর্ট (পুরো নাম- ইউরো এয়ারপোর্ট ব্রাসেল মূলহাউজ প্যেইবার্গ) থেকে প্রাগে যাব বলে টিকেট কেটেছিলাম বলাবাহুল্য সস্তায় কেটে ছিলাম, টের পেলাম পরে। আমরা জুরিখের যে অঞ্চলটাতে ছিলাম সেটা জুরিখের পশ্চিমাঞ্চল বলা যায়, সেখান থেকে ব্রাসেল এয়ারপোর্টে যাওয়ার কোনো পাবলিক পরিবহন তো নাই-ই তার উপর এতটা দূরত্বে টেক্সিতে যেতে সময় লাগে ঘন্টাখানেকের উপর, ইউরোপে এতটা দূরত্বে ট্যাক্সি করে যাওয়া রীতিমতো বিলাসিতা। আর এই বিলাসিতাটাই আমাদের করতে হয়েছে না জেনে।

কথা ছিল রাইন ফলস্ ঘুরে এসে আমরা সরাসরি আমাদের ব্যাগেজ নিয়ে এয়ারপোর্টে চলে যাব, কিন্তু ট্রেন স্টেশন থেকে বের হয়ে আবিশা, সুষমা একটা সুপারশপে ঢুকলো কিছু শুকনো খাবার কিনবে বলে, আধঘণ্টা সময় এখানেই শেষ। তারপর হোটেলে ফিরে এসে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে রিসিপশন থেকে একটু ধারণা নিতে গিয়ে দেখলাম বড্ড দেরি হয়ে গেছে। কেননা, আমাদের প্রথমে ট্রেনে যেতে হবে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত তারপর সেখান থেকে বাস বা ট্যাক্সি করে এয়ারপোর্ট। নেটে সার্চ দিয়ে দেখলাম ট্রেন জার্নি ৪৫ মিনিট তারপর সেখান থেকে বাসে যেতে সময় লাগবে আরও প্রায় চল্লিশ মিনিট এবং ততক্ষণে আমাদের জন্য উপযোগী ট্রেনটি স্টেশন ছেড়ে গেছে। পরের ট্রেন আরও ৩০/৪০ মিনিট পরে অথচ আমাদের হাতে সব মিলিয়ে সময় আছে ঘণ্টাদেড়েকের কিছু বেশি। সব বাদ দিয়ে ট্যাক্সি নেব বলেই সিদ্ধান্ত নিলাম, সেখানেও বিপত্তি উবার ছাড়া ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না এবং কার্ড ছাড়া উবারের পেমেন্টও হবে না আর কোনোভাবেই আমাদের সাথে থাকা কার্ড [ক্রেডিট/ডেবিট] দিয়ে উবার পেমেন্ট নিচ্ছে না। এ যেন হঠাৎ জলে পড়ে হাবুডুবু খাওয়া। প্লেন মিস করা ছাড়া আর কোনো অপশনই যেন রইল না। বশির তো হতাশ হয়ে সব চেষ্টা বাদ দিয়ে বসে পড়ল। আমিও কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তখনই মনে হলো সেন্ট্রাল স্টেশন পর্যন্ত যাই তারপর দেখা যাক, কী হয়।

 এই ভাবনা থেকেই মেট্রোতে কসেন্টাল স্টেশনে পৌঁছলাম। সেখানে গিয়ে সম্ভব্য সব অপশন ট্রাই করলাম অবশেষে এক পাকিস্তানি ট্যাক্সি ড্রাইভার আমদের অ্যায়রপোর্টে পৌছে দিতে রাজি হলো।লম্বা মসৃণ এক পথ দু’পাশের দৃশ্যপটও খুব গোছানো সুন্দর অথচ আমরা তখন বর্তমান এবং নিকট ভবিষ্যতের অনিশ্চিত যাত্রার উদ্বেগে নিশ্চুপ। প্রায় বাকহীন একটা ঘণ্টার যাত্রা শেষে আমরা আমাদের গন্তব্যে, ট্যাক্সি ভাড়া দেখে হার্ট যে ফেল হয়ে যায়নি তাই অনেক। মিটারে ভাড়া ৪৫০ ইউরো, ড্রাইভার বোধকরি আমাদের বিপদ ও বিড়ম্বনা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন, তিনি আমাদের কাছ থেকে ৩৫০ ইউরো নিয়েছেন। জানলাম উবার ছাড়াও কিছু প্রাইভেট ট্যাক্সি সার্ভিস রয়েছে। জুরিখে যারা নিজেরাই নিজেদের ট্যাক্সি চালান, এটা সে রকমই একটা ট্যাক্সি যে কারণে তিনি ভাড়া কম করতে পেরেছেন। আসলে জীবনে চলার পথে কখন কার কাছে কী ঋণ রয়ে যায় তা আগেভাগে কল্পনাও করা সম্ভব নয়। তাড়াহুড়া করে এয়ারপোর্টে পৌঁছেই আমরা সিকিউরিটি চেকিং এর কিউ-তে দাঁড়িয়ে গেলাম, বোডিং আগেই অনলাইনে করা ছিল। এখানেও নেহায়েত সময় কম লাগল না, ব্রাসেল আসলে খুব ব্যস্ত এয়ারপোর্ট, বিশাল তার পরিসর আর হবে না-ই বা কেন ? ফ্রান্স, জার্মানি আর সুইজারল্যান্ড এই তিন দেশের সীমান্তে এর অবস্থান, যেটি তিন দেশের কাছেই বাণিজ্যিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ আর এর নিয়ন্ত্রণও কিন্তু এককভাবে সুইজারল্যান্ডের হাতে নয়। এখানে ফ্রান্সেরও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। আসলে ভুল থেকেই কিছু জানা যায়, যদি ভুল করে ব্রাসেল থেকে টিকেট না কাটতাম আর এতোগুলো ইউরো গচ্চা না যেত, তাহলে এত কিছু হয়ত জানাও হতো না। কেননা, ইতিহাস কখনই আমার পছন্দের বিষয় না।  [চলবে]