ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

03 Jan 2021, 03:41 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

রবীন্দ্রনাথের ‘ইউরোপ প্রবাসীর পত্র’ আমার পড়া হয়নি হয়ত ইউরোপ সম্পর্কে তেমন কোনো আকর্ষণ অনুভব করিনি। কেন করিনি ? সেও এক ছাপোষা ভাবনা থেকেই হয়ত। মধ্যবিত্ত সামাজিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠলে যা হয় আর কি। যদিও দেশের বাইরে পা রাখার সুযোগ হয় তবে তা বড়োজোর বাড়ির পাশে ভারত আর একটু বিলাসী হলে মালয়েশিয়া। এ যে এশিয়া ছাড়িয়ে সুদূর ইউরোপ, সে ভাবনা মনে অতজোর বাসা বাঁধতে পারেনি। কিন্তু সুযোগ বলে কথা- তা বৃহস্পতিতেই ধরা দিল। জীবনে প্রথম মাটি থেকে আতটা উপরে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে একেবারে নরওয়ে। টানা বাইশ ঘণ্টা পথেই কাটিয়ে দিলাম, এর মধ্যে তিন ঘণ্টা তুরস্কের এয়ারপোর্টে আর একঘণ্টা নরওয়ের অসলো এয়ারপোর্টে বাদবাকি সময় পুরোটাই আকাশে উড়ে চলা। ৫ আগস্ট ২০১৮ বাংলার ঋতুমেলায় তখন শরতের আগমনী ছন্দ, ইউরোপেও কিন্তু তখন অটাম। তবে এও জেনেছিলাম ইউরোপের শরৎ নরওয়েকে খুব এটা প্রভাবিত করতে পারে না। নরওয়ে বিশেষ করে বারগেন শহর বেশ ছিচকাঁদুনে। বলছিলাম নরওয়ের কথা হঠাৎ বারগেন এল কোথা থেকে... আমার প্রকৃত গন্তব্য নরওয়ের একটা ছোট্ট পাহাড়ি শহর বারগেন।

আমি বরাবর ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করি। তবে, আমর ঘোরাফেরা মূলত আমার জানাশোনা চৌহদ্দির মধ্যে অর্থাৎ দেশের এ জেলা ও জেলা এ পর্যন্ত। এবার প্রথম দেশের বাইরে যাওয়া তাও সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার। এখানে জনান্তিকে একটা কথা বলে রাখছি, এটা কিন্তু আমার প্রথম আকাশযানে যাত্রা। আমি যেন প্রথমে একটু হাবুডুবুই খাচ্ছিলাম- প্রথম বিদেশযাত্রা উপভোগ করব না অনেক দিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছি, মন কেমন করছে, তাই চুপিসারে একটু কেঁদে নেব ; না প্রথম আকাশযানে চেপে বাইশ ঘণ্টায় এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দেব তার জন্য টেনসন করব বুঝতে পারছিলাম না। আসলে সব মলিয়ে বেশ একটা অস্থিরতার মধ্য দিয়েই আমার ইউরোপ যাত্রা শুরু।

এতসব আস্থিরতার মধ্যেও স্বস্তি ছিলো এই যে আমি একা যাচ্ছি না আমার সহযাত্রী পরিচিত আরো ছয়জন, আমরা মোট সাতজন একসঙ্গে এক রথে ইউরোপ যাত্রী হয়ে উঠলাম। ঢাকা থেকে বেশ নির্বিঘ্নেই যাত্রা শুরু করলাম, তুরস্কে তিন ঘণ্টা ট্রানজিট। প্রথমে ভেবেছিলাম এতটা সময় কী করব ? কিন্তু এখনে এসে বুঝলাম সময় কম হলে বোধ হয় একটু অসুবিধাই হতো। তুর্কি বিমান বন্দরটা বেশ বড়ো, জীবনে প্রথম বিমানে ভ্রমণ অনেক কিছুই অজানা সহযাত্রীদের কল্যাণে জানলাম আমাদের করণীয় অর্থাৎ ফ্লাইট নাম্বার জেনে নিয়ে গেট খুঁজে সেখানে কিউ-তে দাঁড়ানো বোর্ডিং করা এরই মাঝে ছিলো তার্কিশ এয়ারের সিকিউরিটি চেকিং, এই ডাবল চেকিংয়ের নিয়মটা আমার কাছে বিধঘুটে লেগেছে। বিশাল এয়ারপোর্ট চেকিং শেষ করে প্রায় দৌড়োতে হলো কানেকটিং ফ্লাইট ধরতে। দৌড়োতে দৌড়োতে ভাবছিলাম একা এলে হয়ত আর কানেকটিং ফ্লাইট ধরা হতো না। যাই হোক, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সকল আনুষ্ঠানিকতা সমাধা করে একটু ফুসরত পেলাম কফি খাওয়ার কিন্তু এখানেও এক বিপত্তি ডলার বা ইউরো চলছে না কফির দোকান গুলোতে, ইউরো এক্স্রচেঞ্জ করতে হবে, হিসাব মিলল না তাই আপতত কফির চিন্তা বাদ। এখানে একটা কথা বলে রাখি প্লেনে ওঠার পর থেকেই সময়ের হিসাবটা আমি গুলিয়ে ফেললাম, তাই সময়ের এদিক সেদিক হলে ক্ষমা পাঠক নিশ্চয়ই ক্ষমা করবেন, এখন সময় কত তা বলতে পারছি না। তবে, ট্রানজিটের তিনটি ঘণ্টা প্রায় শেষ হতে যাচ্ছে। এদিকে সবার একটাই ভাবনা, বাড়িতে একটু যোগাযোগ করতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু তার্কিশ এয়ারপোর্টের ওয়াইফাই সিস্টেমের আসহযোগিতার কারণে তা আর হয়ে উঠলো না। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা-চরিত্রের পর নিরাশ হয়ে আমরা আমাদের পরবর্তী গন্তব্যের পথে যাত্রা করলাম।

ঠিক কতক্ষণ পর ফের ল্যান্ড করলাম বলতে পারলাম না, কিন্তু প্লেন থেকে নামতেই একটা শান্ত আর নিরিবিলি পরিবেশ দেখে বেশ ভালো লাগলো। নরওয়ের রাজধানী অসলো, অসলো এয়ারপোর্টটা বেশ গুছানো এবং নান্দনিক। ভালো লাগার আরেকটি কারণ ছিলো বৈকি, এখানে এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই মিটে গেল। যদিও ল্যাগেজ সংগ্রহ করে আবার সেটি কানেকটিং ফ্লাইটে তুলতে হবে, এ ব্যাপারটা বেশ ঝক্কির ছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ততক্ষণে আমরাও বোধকরি কিছুটা আভ্যস্ত হয়ে গেছি এই চেক ইন আর চেক আউটের বিষয়টিতে।

আমরা যখন আমাদের চ‚ড়ান্ত গন্তব্যে পৌঁছাই তখন রাত্রি প্রায় সাড়ে দশ কিন্তু বারগেনের আকাশ বলছে গোধূলির কথা। গোধূলিই বটে সূর্র্যি যদি পাটে যায় রাত দশটা নাগাদ তবে আর গোধূলি লগ্নের সাথে বিরোধ কী। বারগেন এয়ারপোর্টে নেমে আরেক সমস্যার কথা শোনা গেল, লোকাল কয়েন ছাড়া লাইট ট্রেনের টিকেট কাটা যাবে না আর আমাদের আবাসে পৌঁছনোর জন্য তখন লাইট ট্রেনই ভরসা। চলছে জল্পনাকল্পনা কীভাবে কী করা যায়। আমি আর আমার কলিগ ফারজানা এই জল্পনাকল্পনা থেকে একটু দূরেই রইলাম, আমি যদিও মনে মনে টেনশনে ছিলাম কিন্তু ফারজানা বোধহয় নিশ্চিন্ত মনেই অপেক্ষা করছিল তার প্রবাসী বন্ধুর জন্য যে কি না তাকে এয়ারপোর্টে স্বাগত জানাতে আসবে। খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি, এর মধ্যেই যুবায়ের চলে এলো, ফারজানার ইউনিভাসির্টির ব›ধু। এরপর আমাদের যাবতীয় দায়িত্ব যুবায়ের নিয়ে নিল। প্রথমে আমরা তার বাসায় গেলাম ফ্রেশ হয়ে রাতের খাবারটা সেখানেই সারলাম, যুবায়েরের সহধর্মিনী তানিয়া দিলখোলা একজন মানুষ, তাদের আতিথ্যে প্রবাস জীবনের শুভসূচনা হালো।

নরওয়ে সম্পর্কে ছেলেবেলা থেকে যে ধারণা ছিলো, তা ছিলো বেশ কৌত‚হল উদ্দীপক, একে একে বলি। যেমন : নিশীত সূর্যের দেশ, যে দেশে ছয়মাস দিন ছয়মাস রাত। বেশ বড়ো হয়েও কিন্তু বিষয়টা আমাকে ভাবাতো, এটা কী করে হয় ? যাই হোক নরওয়েতে এসে তার কিছুটা প্রত্যক্ষ করলাম। নরওয়েতে গ্রীষ্ম আর শরতে দিনের দৈর্ঘ্য অস্বাভাবিক বেড়ে যায় সূর্য উদয় হয় ভোর তিনটে নাগাদ আর অস্ত যাওয়ার নামই নেয় না। দিনের পাট গুছিয়ে নিয়ে অস্ত যেতেযেতে সেই রাত্রি দশটা সাড়ে দশটা বেজে যায়। এ যেন ঘুম চোর খোকা ঘুমুতেই চায় না আর শীতকালে ঠিক উল্টো একেবারে শীতকাতুুরে বুড়ি যেন লেপমুড়ি দিয়ে থাকতে পারলেই বাঁচে।

এবার বারগেনের কথায় আসি বারগেন যেন প্রকৃতির আদুরে কন্যা যে সবসময় বেশ যত্ন আত্তি¡তে অভস্ত্য একটু এদিক-সেদিক হলেই তার মুখ ভার। এ বিষয়ে অবশ্য বারগেনবাসী বেশ সজাগ। আসলেই বারগেন শহরের প্র্রতিটি পরতে যতেœর ছাপ। আমি বারগেনে এসে সর্বপ্রথম যে বিষয়টিতে মুগ্ধ হই, তা হলো এখানকার বাড়িগুলো, পাহাড়ি ঢাল বা সমতলে ছোট্ট ছোট্ট কাঠের বাড়ি যার অধিকাংশই সাদা, আমার কাছে মনে হলো যেন কোনো এক রূপকথার রাজ্যে এসে পড়েছি বোধহয়। মূলত পাহাড়ি ল্যান্ডস্কেপের কারণেই এখানকার বাড়িগুলো ছোটো ছোটো হয়ে থাকে আর প্রকৃতির অকৃত্রিম দানে এখানে প্রচুর কাঠগাছ থাকায় বাড়ি তৈরির প্রধান উপকরণ কাঠ। বড়ো বড়ো ইট কাঠের ইমারত যে এখানে নেই এমন নয়। তবে, সেগুলো অফিস-আদালত আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। বারগেনবাসীর দুটি বিষয় ছিল অতুলনীয় প্রথমত প্রকৃতির প্রতি তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসা আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে সৌন্দর্র্র্র্যবোধ। আমরা মানে এশিয়ানরা যখন বারগেনের ছিচকাঁদুনে আবহাওয়া নিয়ে বিরক্ত তখন তাদের বক্তব্য হচ্ছে ঃযবৎব রং হড় নধফ বিধঃযবৎ ড়হষু নধফ পষড়ঃযরহম অর্থাৎ সময়োপযোগী পোশাক যেকোনো আবহাওয়াকে উপভোগ্য করে তোলে। কি আর করা, আমরাও চেষ্টা করে গেলাম আমাদের দৃষ্টিতে আপাত বৈরি আবহাওয়ার সঙ্গে সমঝোতা করে নিতে।

যদিও সময়টা ক্যালেন্ডারের পাতায় শরৎ, কিন্তু আমার মনে হলো যেন মাঘে হিমশীতে অসময়ে বর্ষণ। বারগেনে আমাদের প্রথম সকালে আকশের ঝলমলে সূর্য আমাদের অভ্যর্থনা না জানালেও কিন্তু মেঘের আনাগোনা তেমন একটা ছিল না। আমরা মাঝারি শীতে উপযোগী এমন পোশাকেই বের হলাম। বিশ^বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাতের পূর্বনির্ধারিত সময়ে আমরা পৌছে গেলাম আমাদের গন্তব্যে। ও আচ্ছা, বলাই হয়নি, আমাদের এ-যাত্রার উদ্দেশ্য হচ্ছে বারগেন বিশ^বিদ্যালয়ের এক্সচেঞ্জ এডুকেশনে অংশ নেওয়া। আমরা যে-কয়জন ঢাকা থেকে একইসঙ্গে বারগেনে এলাম সবাই বাংলাদেশের নর্থসাউথ ও নরওয়ের বারগেন বিশ^বিদ্যালয়ের এক যৌথ উদ্যোগের উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমের অংশগ্রহণার্থী। যাই হোক, বিশ^বিদ্যালয় পৌঁছানো পর্যন্ত ঠিকই ছিল, গোল বাঁধলো দুপুরের পর থেকে। আমরা লাঞ্চ করে বের হলাম বাস/মেট্টোর মান্থলি টিকেট কাটব আর টুুকটাক কাঁচা বাজার সেরে নেব এই উদ্দেশ্যে। কেননা, এখানে নিজের খাবারের যোগাড় নিজেকেই করতে হবে। পথে নামতেই প্রথমে ঝিরিঝিরি তারপর অনেকটা মুশলধারে বৃষ্টি। পূর্বপ্রস্তুতি না-থাকায় প্রত্যেকেই অল্প-বিস্তর ভিজলাম যার ফল- জ¦র, সর্দিকাশি। বিদেশ-বিভূঁইয়ে এসে যারা অসুখ-বিসুখে পড়েছেন তারাই জানেন এর ভোগান্তি কেমন।  [চলবে]