৪০ বছর ধরে বাংলার মানুষের চিত্তের খোরাক জুগিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ

19 Jul 2022, 03:23 PM শ্রদ্ধাঞ্জলি শেয়ার:
৪০ বছর ধরে বাংলার মানুষের চিত্তের খোরাক জুগিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ

তিনি কথাশিল্পী, তিনি নাট্যকার, তিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা, তিনি আরও বহু প্রতিভার অধিকারী- বলছি বাংলা কথাসাহিত্যের বরপুত্র হুমায়ূন আহমেদের কথা। কথার জাদু দিয়ে তিনি যেমন ঘণ্টা পর ঘণ্টা তরুণ পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখতেন, তেমনি অসাধারণ সব জাদু দেখিয়ে শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখতেন। তাঁর নির্মিত সিনেমা দেখার জন্য ছেলে-বুড়ো যেমন হলের সামনে লাইনে দাঁড়াতেন, তেমনি টেলিভিশনে প্রচারিত তাঁর নাটক দেখতে এক-কাতারে সকল পেশার, সকল শ্রেণির, সকল বয়সের মানুষ বসে পড়তেন টেলিভিশন সেটের সামনে। সৃষ্টিশীলতার নানামুখি ও বিচিত্র শাখা প্রশাখা বিস্তার করে দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে বাংলার মানুষের চিত্তের খোরাক জুগিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। হুমায়ূন আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই নভেম্বর। কর্কট রোগের সাথে দীর্ঘ লড়াই শেষে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১৯-এ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্রকার, গীতিকার, গল্পকার, চিত্রকর, নাট্যকার, জাদুশিল্পী। কলাম লেখক হিসেবেও তিনি নন্দিত আর কল্পবিজ্ঞান-সাহিত্যে তার খ্যাতি আকাশচুম্বী। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে তার প্রথম উপন্যাস, ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে পরিচিতি লাভ করেন। সেই ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি বাংলার পাঠক-সমাজকে কথার জাদুতে মোহাবিষ্ট করে রেখেছেন। সব বয়েসী মানুষই তার লেখার নিবিষ্ট পাঠক। গত শতকের আটের দশকে তিনি কলাম লেখক হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেন। সেই সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ঢাকা পত্রিকায় তিনি কলাম লিখতেন।
হুমায়ূন আহমেদ বিচিত্র বিষয়ে সহজ-সরল ভাষা আর রসবোধ দিয়ে পাঠককে আকৃষ্ট করেন। কী উপন্যাস, কী ছোটোগল্প, কী চলচ্চিত্র, কী নাটক- সব মাধ্যমই ছিল তার অসামান্য সাফল্য। তিনি তাঁর গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে অনেক কঠিন কথা খুব সহজভাবে তুলে ধরেছেন। তাঁর গল্প বলার কৌশল ছিল দারুণ হৃদয়গ্রাহী। বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার গল্প হুমায়ূন আহমেদ তুলে ধরেছেন সহজ ও সাবলীল ভাষায়। ব্যক্তি-মানুষের আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আবেগ-অভিমান, হতাশা-বঞ্চনা, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা আর অন্যদিকে সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত- সবকিছুই তাঁর রচনায় অসাধারণ নৈপুণ্যে প্রতিভাত। ব্যক্তিজীবনের নিতান্ত সাদামাটা ঘটনা থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবনের বহুমাত্রিক অনুষঙ্গ, মানুষের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন তুলির অসামান্য সব আঁচড়ে চিত্রিত হয়েছে তাঁর গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে ও চলচ্চিত্রে। ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্র অবলম্বনে উপন্যাস রচনায়ও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।

চরিত্র সৃষ্টিতে অতি দক্ষ শিল্পীর পরিচয় দিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর গল্প-উপন্যাস-নাটক-চলচ্চিত্রের চরিত্রগুলো এতই জীবন্ত যে, তারা পাঠক কিংবা দর্শকের সঙ্গে একান্তে কথা বলে, চলাফেরা করে, খায়, ঘুমায়, ভালোবাসা প্রকাশ করে। সমাজের অতি চেনা সাদামাটা মানুষ থেকে শুরু করে খেয়ালি, মনস্তাত্ত্বিক- সব ধরনের চরিত্রের সমাবেশ ঘটিয়েছেন তিনি। কিছু চরিত্র আছে প্রতীকী। এদের কেউ কেউ খ্যাপা, পাগলাটে। তাঁর কল্পনাশক্তি এক একটি চরিত্রকে পাঠকের অন্তরে ঠাঁই করে দিয়েছে। হিমু, মিসির আলী, বাকের ভাই, রূপা ও শুভ্র চরিত্রগুলো নির্মাণকুশলতায় অনন্য। কোনো যুক্তি ও বিচার-বুদ্ধির তোয়াক্কা না করে উদ্ভট সব কাজ করাই হলো ‘হিমু’ চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। অপরদিকে হিমুর বিপরীত চরিত্র ‘মিসির আলী’। যুক্তিবাদী ‘মিসির আলী’ যুক্তির বাইরে এক পাও হাঁটেন না। হিমু আর মিসির আলী যেন লেখকেরই দুই সত্তা। ‘শুভ্র’ চরিত্রটি বিবেকী মানুষের প্রতিভূ। হুমায়ূন আহমেদের অসম্ভব রূপবতী নারী চরিত্র ‘রূপা’। তরুণ পাঠকদের মানসে ‘রূপা’ স্থায়ী আসন লাভ করতে সমর্থ হয়েছে।টিভি নাটকেও হুমায়ূন আহমেদ আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় ছিলেন। ‘এইসব ‘দিনরাত্রি’, ‘আজ রবিবার’, ‘কোথাও কেউ নেই’ ও ‘বহুব্রীহি’ অসাধারণ দর্শকনন্দিত নাটক। হুমায়ূন আহমেদের নাটকের সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘বাকের ভাই’ চরিত্রটি। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন বাকের ভাইয়ের যেন ফাঁসি না হয়, সেই জন্য বাংলাদেশের মানুষ বাস্তবিক অর্থেই রাস্তায় মিছিল বের করেছিল।
চলচ্চিত্র নির্মাণেও মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। তিনি মোট আটটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। এসব চলচ্চিত্রের গল্প, চিত্রনাট্য, পরিচালনা ও প্রযোজনা তিনি নিজেই করেছেন। তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ মুক্তি পায় ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। তার আটটি চলচ্চিত্রই জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল। চলচ্চিত্রগুলোতে ব্যবহৃত বেশকিছু গানও তিনি নিজেই লিখেছেন। তাঁর লেখা জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘আমার ভাঙা ঘরে ভাঙা চালা’, ‘এক যে ছিল সোনার কন্যা’, ‘যদি মন কাঁদে’, ‘বরষার প্রথম দিনে’, ‘আমার আছে জল’ ইত্যাদি। হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলো বিশেষভাবে প্রশংসার দাবি রাখে। ‘আগুনের পরশমণি’ কিংবা ‘শ্যামল ছায়া’ সিনেমা দুটি বাংলার মানুষের মন থেকে সহজে মুছে যাবে না।
বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের অগ্রগতির ক্ষেত্রেও হুমায়ূন আহমেদের অবদান অতুলনীয়। এদেশের সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্পকে ম্রিয়মাণ অবস্থা থেকে গতিশীল পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন তিনি। তিনি এককভাবেই বইয়ের বাজার তৈরি এবং প্রকাশনা শিল্পে পুঁজির প্রবাহ সৃষ্টি করেছেন।
নিসর্গ-প্রেমিক হুমায়ূন আহমেদ নাগরিক জীবনের কোলাহল থেকে দূরে প্রকৃতির কোলে সময় কাটাতে ভালোবাসতেন। তাই গাজীপুরের পিরুজালি গ্রামে স্থাপন করেছেন ‘নুহাশ পল্লী’ আর সেন্ট মার্টিনস দ্বীপে ‘সমুদ্র বিলাস’ নামে বাড়ি। ‘নুহাশ পল্লী’কে সাজিয়েছেন নয়নাভিরাম বৃক্ষ, দিঘি আর ভাস্কর্য দিয়ে। প্রায় দু’শ প্রজাতির ঔষধি গাছ রোপণ করেছেন সেখানে। দুরারোগ্য কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়ার পর তাঁকে তাঁর প্রিয় ‘নুহাশ পল্লী’তেই সমাহিত করা হয়।

হুমায়ূন আহমেদের প্রয়াণদিবসে তাঁর স্মৃতির প্রতি আনন্দভুবন পরিবারের শ্রদ্ধা...
আনন্দভুবন ডেস্ক