মঞ্চ, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের গুণী অভিনেত্রী শার্মিলী আহমেদ সম্প্রতি ৮ জুলাই শুক্রবার সকালে প্রয়াত হয়েছেন জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে। জানা যায়, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তার পারিবারিক নাম মাজেদা মল্লিক। আরেক গুণী অভিনেত্রী ওয়াহিদা মল্লিক জলি তার ছোটো বোন। তার বাবা মো. তোফাজ্জল হোসেন মল্লিক ছিলেন উত্তর বঙ্গের নামকরা নাট্যাভিনেতা এবং নাট্যপরিচালক। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি নাটকে অভিনয় করার জন্য প্রথম মঞ্চে ওঠেন। তিনি নাটকের দলের পাশাপাশি স্কুল এবং কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে পড়াকালীন তিনি রাজশাহী বেতারে অডিশন দিয়ে পাশ করে অনুষ্ঠান ঘোষক হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীসময়ে তিনি নাটকের জন্য অডিশন দিয়েও পাশ করেন। এরপর রাজশাহী বেতার এবং ঢাকা বেতারে অনেক নাটকে অভিনয় করে মাজেদা মল্লিক নামে পরিচিতি এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তার বাবার এক বন্ধু বজলুর রহমান ‘ঠিকানা’ নামের একটি চলচ্চিত্রে তাকে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করার সুযোগ দেন। চলচ্চিত্রটির স্ক্রিপ্ট রাইটার এবং প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন আমজাদ হোসেন। তিনিই মাজেদা মল্লিক বাদ দিয়ে শর্মিলী নামটি রাখেন।
শর্মিলী আহমেদ বাংলাদেশ টেলিভিশনের প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘দম্পতি’তে অভিনয় করেন। শর্মিলী আহমেদের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে প্রায় ৪০০টি নাটক এবং ১৫০টির মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। মঞ্চ, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রের সাবলীল অভিনেত্রী শর্মিলী আহমেদ প্রথম দিকে নায়িকা এবং পরবর্তীসময়ে মা, দাদি কিংবা ভাবির চরিত্রে অভিনয় করে একটা শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেন।
শর্মিলী আহমেদ অভিনয়ের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রের মডেল হন। ‘দহন’ ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন। এর বাচাইরেও তিনি বিভিন্ন সংগঠন থেকে বহু পুরস্কারে ভূষিত হন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ঋত্বিক ঘটক স্মৃতি পুরস্কার, অনন্য পুরস্কার এবং আলোকিত নারী পুরস্কার।
তাঁর স্বামী প্রয়াত ইঞ্জিনিয়ার রাকিব উদ্দিন আহমেদ সৌখিন চিত্রগ্রাহক এবং পরিচালক ছিলেন। এই দম্পতির এক মেয়ে নাম তনিমা।
শর্মিলী আহমেদ ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮ মে মুর্শিদাবাদের বেলুর চাক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজশাহী পিএন গার্লস হাইস্কুল থেকে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ম্যাট্রিক এবং রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজে থেকে ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাসাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। শর্মিলী আহমেদ যখন অভিনয় জগতে আসেন তখন এদেশে ছিল উর্দু ছবির জোয়ার। তিনি ‘জগনু’, ‘পাঞ্জি’, ‘বাউরা’সহ বেশ কিছু উর্দু ছবিতে অভিনয় করেন। বাংলা চলচ্চিত্রে তার অভিষেক হয় সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আবির্ভাব’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। সেই সময় সিনেমাটি সুপার-ডুপার হিট হয়। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। চুক্তিবদ্ধ হতে থাকেন একের পর এক সিনেমায়। ব্যস্ত হয়ে পড়েন চলচ্চিত্রে অভিনয় নিয়ে। একে একে ‘আগুন’, ‘রূপালী সৈকতে’, ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনি’, ‘আকর্ষণ’, ‘আলিঙ্গন’, ‘দহন’, ‘গোয়েন্দা কাহিনী’, ‘বেয়াদব’, ‘বিক্ষোভ’সহ বহু ছবিতে অভিনয় করেন।
অভিনয়ে ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় পরিবারে সময় দিতে পারতেন না অভিনয় শিল্পীরা। কিন্তু শর্মিলী আহমেদ একেবারে আলাদা। অভিনয় এবং সংসার দুটোই সমানভাবে সামলেছেন। তার কাছে পরিবার আগে গুরুত্বপূর্ণ, তারপর কাজ। যার কারণে পরিবারের সদস্যরা সবসময় তাকে অভিনয়ে সহযোগিতা করেছেন। তার একমাত্র মেয়ে তনিমাকে সুশিক্ষায় বড়ো করতে হবে, এই চিন্তা সবসময় মাথায় ছিল শর্মিলী আহমেদের। তাই শুটিং-এ কখনো ঢাকার বাইরে যাননি। দূরে শুটিং-এ গেলে যত রাতই হোক বাসায় ফিরে আসতেন তিনি। যদি কখনো আগে থেকে জানতেন যে, ফিরতে দেরি হবে তাহলে বোনকে বাসায় এনে রাখতেন মেয়েকে দেখাশোনার জন্য।
আনন্দভুবন ডেস্ক