গাদ্দাফির দেশে তার সুবর্ণ দিনে -শেখ নেছারুদ্দীন আহমদ

04 Jan 2021, 02:28 PM ভ্রমন শেয়ার:
গাদ্দাফির দেশে তার সুবর্ণ দিনে -শেখ নেছারুদ্দীন আহমদ

গাদ্দাফির কথা

১৯৭৫ সাল। তখন আমি মসুল ইউনিভার্সিটির মেডিকেল ফ্যাকাল্টিতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। হঠাৎ মোয়াম্মার গাদ্দাফির একটা জীবনীগ্রন্থ হাতে এল। ইংরেজিতে লেখা। অরিজিনাল না অনুবাদ সেকথা আজ আর মনে নেই। তরুণ সৈনিক, উনসত্তরের অভ্যুত্থানের নায়ক, আরব দেশগুলোর মধ্যে প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান যিনি তৈলসম্পদ জাতীয়করণ করেন তার সম্পর্কে কৌতূহল ছিল অনেক দিনের। অতিশয় আগ্রহ নিয়ে পড়তে বসলাম। তার জীবন এবং উত্থান রূপকথার মতো। পশ্চিম লিবিয়ার [তখন এই অঞ্চলকে ত্রিপোলিয়া বলা হতো] এক ক্ষয়িষ্ণু ছোটো শহর সিরতে (ঝওজঞঊ)। এখান থেকে প্রায় কুড়ি মাইল দক্ষিণে মরুভ‚মির গ্রাম্য এলাকা কাছ্র আবু হাদির এক তাঁবুতে মুয়াম্মার গাদ্দাফির জন্ম ১৯৪২ সালে। ১৯৪০ সালও হতে পারে। মেশপালকের পুত্রের কোনো জন্মসনদ নেই। পিতা আবদুস সালাম আবু মুনিয়ার এবং মা আয়েশার একমাত্র জীবিত পুত্র তিনি। তারা গাদ্দাদিফা আরবীয় বারবার উপজাতির অংশবিশেষ। কথিত আছে তার দাদা (পিতামহ) দখলদার ইটালি সৈন্যের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন ১৯১১ সালে এবং তার নানি (মাতামহী) ইহুদি থেকে ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন।

শৈশবে মৌলবির কাছে ধর্মশিক্ষা দিয়ে তার শিক্ষাজীবনের শুরু। সিরটে শহরে এসে প্রাইমারি বিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। এখানে রাতে মসজিদে ঘুমাতেন এবং সপ্তাহান্তে কুড়ি মাইল হেঁটে বাড়িতে আসতেন। এই কৃচ্ছ্র সত্তে¡ও মুয়াম্মার ছয় গ্রেডের পাঠ চার বছরে শেষ করেন। সন্তানের অধ্যয়নে উৎসাহ ও কৃতিত্ব দেখে অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্তে¡ও নিরক্ষর পিতা তার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সপরিবারে তিনি দক্ষিণের মরুদ্যানশহর সাবহা (ঝঅইঐঅ)-তে গমন করে তাকে সেখানকার মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি করেন। স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষক মিশরীয়। যাদের দু’-একজনের সংস্পর্শে এসে তিনি প্রথম রাজনীতির ব্যাপারে উৎসাহী হন। জীবনে প্রথম খবরের কাগজ পড়া এবং বেতার বার্তা বিশেষ করে মিশরের বৈপ্লবিক ‘আরবের কণ্ঠস্বর’ (ঠঙওঈঊ ঙঋ অজঅইঝ) শোনার শুরু এখানে। মিশরের বৈপ্লবিক নেতা নাসের (এঅগঅখ অইউঊখ ঘঅঝঝঊজ) হয়ে ওঠেন তার অনুপ্রেরণার উৎস এবং হিরো। সমমনা বেশ কিছু সঙ্গীও পেয়ে যান। যার মধ্যে আবদুস সালাম জাল্লুদ পরবর্তীকালে তার পরম আস্থাভাজন সহকর্মী ছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেন পশ্চিমা আধিপত্যবাদীরা কোনোদিন আমাদের মঙ্গল চায়নি। এই নীতি থেকে তারা কোনোদিন মুক্ত হবে না। আমাদের স¤্রাট ওদের হাতের ক্রীড়নক। এই পর্যায়ে মোয়াম্মার একটা দল গঠন করে রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শন করলেন এবং পোস্টার বিতরণ করলেন। তার এই রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপের জন্য তাকে স্কুল থেকে এবং পরিবারকে সাবাহ শহর থেকে বহিষ্কার করা হল। ভাগ্যের কি অপূর্ব আশীর্বাদ ! তার বিরুদ্ধে বিরূপ পুলিশরিপোর্ট থাকা সত্তে¡ও তিনি বিনা বাধায় মিসরাতায় (গওঝজঅঞঅ) মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলেন। এবার আর বিপ্লব, বিদ্রোহ বা আন্দোলন নয়। শুধু পড়াশোনা। স্কুল-পাঠ্যবই ছাড়াও তার পাঠ্যবিষয় মহাপুরুষদের, বিপ্লবীদের, সংগঠকদের জীবনী ও বিপ্লবের ইতিহাস। পাঠ্যসূচিতে ছিল ফ্রান্সের বিপ্লবের ইতিহাস, আব্রাহাম লিংকন, সান-ইয়েত-সেন, গামাল আবদেল নাসের, মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক, লেলিন ও মাও-সে-তুংয়ের জীবনী। নাসেরের বিবর্তনের দর্শন। (ঢ়যরষড়ংড়ঢ়যু ড়ভ ৎবাড়ষঁঃরড়হ) তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে।

মাধ্যমিক পাশ করে তিনি ইউনিভার্সিটি অব লিবিয়াতে ভর্তি হন এবং কিছুদিন ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেন। তারপর এটা ছেড়ে দিয়ে রয়াল মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন। এখানে অধ্যয়নকালে সমমনা ছাত্রদের নিয়ে ‘ফ্রি অফিসার্স মুভমেন্টের’ (ঋজঊঊ ঙঋঋওঈঊজঝ’ গঙঠঊঘঞ) কেন্দ্রীর কমিটি গঠন করেন। ১৯৬৫ সালে গ্রাজুয়েশন প্রাপ্তির পর সিগনাল কর্পস্এ চাকরি পান, ১৯৬৬ সালে উচ্চতর ট্রেনিং-এর জন্য তাকে বিলাতে পাঠানো হয়। তিনি স্যান্ডহার্স্ট-এর মিলিটারি অ্যাকাডোিমতে (ংধহফযঁৎংঃ সরষরঃধৎু ধপধফবসু) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন। বইয়ের লেখকের এই তথ্যটি সঠিক ছিল না। পরবর্তীকালে জানা যায় তিনি কখনো স্যান্ডহার্স্টের কোর্সে অংশ গ্রহণ করেননি। বস্তুত তিনি অন্য তিন প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন, বেকনফিল্ডে ‘ইংলিশ কোর্স’; বোভিংটন ক্যাম্পে ‘আর্মি এয়ারকর্পস সিগনাল’ কোর্স  এবং হিথে ‘ইনফ্যান্ট্রি সিগনাল ইনসট্রাকশন’। বোভিংটনে তার পরিচালকের মন্তব্য ছিল ‘মোয়াম্মার কঠোর প্ররিশ্রমী, নীতিবান এবং কৌতুকপ্রবণ অফিসার।’

মধ্য উনসত্তরে সম্রাট ইদ্রিস চিকিৎসার জন্য তুরস্কে ছিলেন। ফ্রি অফিসার্স গ্রæপ এই সুযোগ গ্রহণ করে পয়লা সেপ্টেম্বর গাদ্দাফির নেতৃত্বে অভ্যুত্থান ঘটান। অধিকার করে নিলেন এয়ারপোর্ট, বেনগাজি ও ত্রিপোলির আর্মি ব্যারাক, রেডিও স্টেশন এবং পুলিশ হেড কোয়ার্টার। অভ্যুত্থানের সময়ে বেনগাজিতে অবস্থানরত গাদ্দাফি ওখানকার ব্যারাক দখলের নেতৃত্ব দেন। এদিকে ত্রিপোলি দখলের পর সাথিরা অধীর আগ্রহে গাদ্দাফির কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দেরি হওয়ায় তারা অস্থির হয়ে পড়েন। কেন আমরা এখনও গাদ্দাফির কোনো কথা শুনতে পাচ্ছি না ! অবশেষে নেতার কণ্ঠস্বর ভেসে এল বেতর তরঙ্গে। সবার মধ্যে স্বস্তি ফিরে এল। অভ্যুত্থান ঘটলো একদম কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই। তাই একে বলা হলো  ‘শুভ্র অভ্যুত্থান’ (ডঐওঞঊ জঊঠঙখটঞওঙঘ)। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি ঘোষণা করলেন ‘আমাদের মূলমন্ত্র স্বাধীনতা, একতা এবং সমাজতন্ত্র।’ তার সেদিনের বক্তৃতা বাবা শুনলেন রেডিওতে, মরুভূমিতে বসে। রেডিওটি পুত্র তাকে দিয়েছিলেন কিছুকাল আগে। গুরুত্বপূর্ণ যে-কাজটি তিনি করলেন তা হলো ‘তৈলসম্পদ জাতীয়করণ’। এতদিন তৈল সম্পদের লভ্যাংশের সিংহভাগ যেত বিদেশিদের পকেটে; এখন থেকে আসবে জাতীয় অর্থভাÐারে। অর্থ ব্যবহৃত হবে প্রতিটি লিবিয়াবাসীর কল্যাণে। মধ্য এশিয়ার তৈল সমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে তিনিই প্রথম জাতীয়করণের পন্থা অবলম্বন করেন। অনুসরণে ইরানসহ অন্যান্য আরবদেশগুলোও জাতীয়করণ করতে শুরু করে। সর্বশেষ করে সৌদি আরব। সঙ্গে সঙ্গে গাদ্দাফি আমেরিকান ও ব্রিটিশ ঘাঁটিগুলো বন্ধ করে দিলেন। ফলাফল বোধগম্য। ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং আমেরিকাসহ অন্যান্য পশ্চিমারা তার শত্রæতে পরিণত হল যা তার আমৃত্যু বহাল ছিল। 

ইরাকে থাকাকালীন গাদ্দাফির পরিকল্পিত নানারকম দেশ পুনর্গঠনের কথা শুনতে পেতাম। একবার তিনি কোনো এক আরব দেশ পরিভ্রমণে আসেন। তখন তাকে রাজকীয় সম্মান প্রদর্শন করা হয়। আমার ছাত্রদের কাছে জানতে পারলাম আরব দেশের জনসাধারণ তাকে মহাপুরুষ গণ্য করে। গাদ্দাফি সম্পর্কে আরো অনেক কথা প্রত্যক্ষভাবে জানা যাবে পরে।



লিবিয়ায় চাকরি প্রাপ্তি

ইরাকের বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন অন্যান্য আরবদেশের তুলনায় অনেক কম। একথা আমাদের মধ্যে প্রায়ই আলোচিত হতো। অন্যদিকে এখানে জীবন ধারনের (ঈঙঝঞ ঙঋ খওঠওঘএ) ব্যয়ও কম। একদিন একথা নিয়ে অ্যানাটমির অধ্যাপক সিদ্দিকের (পাকিস্তান থেকে আগত) সাথে আলাপ করছিলাম। তিনি বললেন,‘তুমি অন্যান্য দেশেও প্রচেষ্টা করতে পারো।’ আমি বললাম,‘কোথাও অ্যাড (অউঠঊজঞওঝঊগঊঘঞ) তো দেখি না।’তিনি বললেন, ‘অ্যাডের কোনো দরকার নেই। এখন আরব দেশগুলোতে ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ এবং বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপকের বিশাল শূন্যতা। তুমি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা বিশ^বিদ্যালয়ে দরখাস্ত পাঠাতে পার। সাড়া ইতিবাচক হলে ওরা আরো অনেক ডকুমেন্টস চেয়ে পাঠাবে।’

১৯৭৯ সালের মার্চ-এপ্রিলে দরখাস্ত পাঠালাম। সৌদির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং ত্রিপোলির আল ফাতেহ বিশ^বিদ্যালয় থেকে ইতিবাচক সাড়া পেলাম। আল ফাতেহ বিশ^বিদ্যালয়ে চাহিদামতো ডকুমেন্টস পাঠিয়ে দিলাম। তারপর অনেকদিন পার হয়ে গেল। কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমাদের এখানে গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হয়ে গেল। দুমাসের ছুটি। ঘোরাফেরা করে, বন্ধুদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে, স্ক্রবল খেলে নিরুদ্বেগ সময় পার করছি। একদিন মধ্যহ্নভোজের পর আমরা এটা-সেটা নিয়ে কথা বলছি। হঠাৎ আল ফাতেহ ইউনিভার্সিটির কথা উঠল। আমি বললাম, ‘ওরা আর যোগাযোগ করছে না ! আমাদের বোধহয় একবার খবর নেওয়া দরকার। কিন্তু চিঠি লিখলে উত্তর পেতে অনেক সময় লাগবে। এত সময় নেই। এখন যোগাযোগ করতে হলে টেলিগ্রাম করতে হবে।’ স্ত্রী বললেন, ‘এসো আমরা একটা লটারি করি।’ লটারি করা হলো। উঠল, ‘টেলিগ্রাম করা উচিত’। অনেক কথা লিখতে হবে। বেশ খরচ হবে। ভাগ্য পরীক্ষাই যখন উদ্দেশ্য, যা লাগে লাগুক। টেলিগ্রামের ড্রাফট করে ফেললাম এবং অবিলম্বে পোস্ট অফিসে যেয়ে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিলাম। বিল (ইওখখ) দেখে বিস্মিত হলাম ! অপ্রত্যাশিতভাবে কম ! পরে জেনেছি। আরব দেশগুলোর মধ্যে একরকম। বাইরে পাঠালে চার-পাঁচ গুণ বেশি হতো।

দুদিন পরেই উত্তর পেলাম। দুটি ইংক্রিমেন্টসহ এসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে  নিয়োগ দেওয়া হলো। দ্রæত ভিসা নিয়ে চলে এসে যোগদান কর। আমিও হতিবাচক উত্তর দিয়ে ফিরতি টেলিগ্রাম পাঠালাম।

মসুল বিশ^বিদ্যালয়ের চাকরি তো আছেই। পদত্যাগ করতে হবে। অন্য কোনো আরবদেশে চাকরি নিয়ে যাচ্ছি বললে অনেক সমস্যা হবে। দেশে ফেরার জন্য সরকার চাপ দিচ্ছে বলে বিভাগীয় প্রধানের সম্মতি পাওয়া গেল। ভাগ্যিস তিনি মুখের কথাই বিশ^াস করলেন, কোনো অফিসিয়াল কাগজ দেখতে চাননি। অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সারতে বেশি বেগ পেতে হলো না। 


ভিসা বিড়ম্বনা

বাগদাদে এলাম ভিসার জন্য। লিবিয়ার দূতাবাসে যেয়ে দেখি এক হ-য-ব-র-ল কাÐ। একগুচ্ছ তরুণ। কেউ চেয়ারে বসে, কেউ হাঁটাহাঁটি করছে। আমি বললাম, ‘আমি কনসুলার অফিসারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।’ ওরা বললো, ‘আমরাই কনসুলার অফিসার।’ আমি বললাম, ‘তা কেমন করে হয়, কনসুলার তো একজন।’ একজন বললো, ‘আমাদের ভাই গাদ্দাফি “জামাহিরিয়া” ঘোষণা করেছে। মৌলিক নাগরিক সমিতি (ইঅঝওঈ চঊঙচখঊ ঈঙঘএজঊঝঝ) গঠিত হয়েছে। আমরা সেই নাগরিক সমিতির সদস্য। এখানে এসেছি দূতাবাস চালাতে।’ আমি বললাম, ‘তোমাদের বিশ^বিদ্যালয়ে আমার চাকরি হয়েছে, আমাকে ভিসা দিতে হবে। ওরা বললো, ‘এখন ভিসা দেওয়া বন্ধ।’ আমি গলা চড়িয়ে বললাম, ‘এটা তো হতে পারে না।’ আমাদের চ্যাঁচামেচি শুনে দূর থেকে একজন এগিয়ে এলেন। তিনিও তরুণ। তবে দেখে মনে হলো স্থিতধী, শিক্ষিত। তিনি বললেন, ‘তুমি আমার সাথে এস।’ তার অফিসে যেয়ে সবকথা বললাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার দেশ কোথায় এবং তুমি কি এখান থেকেই লিবিয়ায় যেতে চাও।’ আমি বললাম, ‘আমি বাংলাদেশের অধিবাসী, লিবিয়ায় যাওয়ার আগে একবার দেশে যেতে চাই।’ তিনি বললেন, ‘এখান থেকে ভিসা প্রদান সাময়িকভাবে বন্ধ। তুমি দেশে যেয়ে ঢাকা থেকে ভিসা নিয়ে নাও। তাতে তোমার একটা সুবিধা হবে। তুমি ঢাকা-টু -লিবিয়ার টিকেট পাবে, এখান থেকে ভিসা দিলে এই সুবিধাটা পাবে না।’

দেশে ফিরে আশ্রয় পেলাম খালা শাশুড়ির বাসায়, পল্লবীতে। এখান থেকে শহরকেন্দ্রে এবং অ্যামব্যাসিপাড়া গুলশানের দূরত্ব অনেক। তৎকালে রোকেয়া সরণি ছিল না। মিরপুর এক  নম্বর দিয়ে যাতায়াত করতে হতো। লিবিয়ার দুতাবাসে এসে প্রথমেই বাধা পেলাম। দরজা বন্ধ। ধাক্কাধাক্কি করায় দারোয়ান পকেট দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী চাই ?’ আমি বললাম,‘ভিতরে যাব। কনসুলারের সাথে দেখা করব।’ দারোয়ান জিজ্ঞাসা করল,‘কেন দেখা করবেন ?’ আমি বললাম, ‘আমি গল্প করতে আসিনি। ভিসার জন্য দেখা করবো। সে আবার বললো, ‘ঢুকতে দেওয়া নিষেধ, ভিসাও দেওয়া হবে না।’ আমি বললাম,‘তোমার মালিকের দেশ লিবিয়ার বিশ^বিদ্যালয় আমাকে চাকরি দিয়ে অবিলম্বে যোগদান করতে বলেছে। অতএব ভিসা দিতেই হবে।’ তার সঙ্গে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে অসাবধানে বলে ফেলেছি, ‘আমি ইরাকে থাকতে চাকরি পেয়েছি।’ আর যায় কোথায় ! ‘গাদ্দাফির ছোটো ভাই’ বাংলাদেশি দারোয়ান আবদুল কুদ্দুস বললো, ‘যান যান, ইরাকে যেয়ে ভিসা নেন।’  বলেই দরজা বন্ধ করে দিল। দারুণ মুষ্কিলে পড়া গেল। কিছু তো একটা করতে হবে। হঠাৎ মনে পড়ল ডেপুটি সেক্রেটারি মামাশ^শুরের কথা। তাঁকে বিস্তারিত সব জানিয়ে বললাম, ‘আপনার অফিসিয়াল পজিশন ব্যবহার করে শুধু কনসুলারের সাথে একটা এপয়েন্টমেন্ট করে দেন। বাকিটা আমি সামলাতে পারব।’ এপয়েন্টমেন্ট হয়ে গেল। দুদিন পর নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছাতেই দারোয়ান দরজা খুলে দিয়ে সালাম দিল এবং ভেতরে কোনদিকে যেতে হবে বলে দিল। কনসুলার রুমে পৌঁছে সালাম দিলাম। তিনি বসতে বলে আমার কাগজপত্র চাইলেন। আল ফাতেহ ইউনিভার্সিটির টেলিগ্রাম দেখে পাসপোর্ট চাইলেন এবং বললেন,‘তুমি বাইরে অপেক্ষা কর, আমি ভিসা দিয়ে দিচ্ছি। শুধু তোমাকেই ভিসা দেওয়া হবে, পরিবারের হবে না। তোমাকে ওখানে যেয়ে সেটল করার পর চিঠি পাঠাবে। তখন ওদের ভিসা দিয়ে দেব।’


যাত্রাপথে

জিয়াউর রহমানের শাসনকাল। বন্ধু-বান্ধবের কাছে শুনলাম ডাক্তারদের বিদেশে চাকরি নিয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। শুধু নতুন চাকরির জন্য বিধিনিষেধ। যারা বিদেশে চাকরিতে আছেন তাদের বেলায় কোনো অসুবিধা নেই। একদিন নিউমার্কেটে বাসুদেবের (পরবর্তীকালে খুলনা মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল হয়ে অবসর গ্রহণ করেন) সাথে দেখা হলো। বাসুদেব বললো, ‘নেছার ভাই, শুনলাম লিবিয়ায় যাচ্ছেন। এয়ারপোর্ট থেকে ফেরৎ পাঠাতে পারে ! শুনেছি, অনেকের ভাগ্যে এরকম ঘটনা ঘটেছে।’ আবার মামাশ্বশুরকে বললাম, ‘কিছু করা যাবে কিনা।’ তিনি বললেন, ‘এসব ব্যাপারে বেশি ঘাটাঘাটি না করাই ভালো। করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।’ তার কথা যে ঠিক ছিল তা পরবর্তীসময়ে প্রমাণ হয়। 

যাত্রার প্রস্তুতি নিয়ে তেজগাঁও বিমান বন্দরে পৌঁছলাম। সঙ্গে স্ত্রী এবং তিনকন্যা। তাদের খুব মন খারাপ। মেয়েদের চোখ ছলছল করছে, মুখভার। পিতাকে ছেড়ে তারা কোনোদিন থাকেনি। কনিষ্ঠ কন্যা পল্লবী অনেক কান্নাকাটি করলো। আমার মনে কিছু উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। বাসুদেবের বলা আশঙ্কার কথা ভুলিনি। চেক-ইন-ডেস্কে (ঈঐঊঈঐ-ওঘ-উঊঝক) পাসপোর্ট জমা দিলাম। ওরা সব দেখে বোর্ডিং কার্ড দিয়ে দিল। এবার ইমিগ্রেশন! ইমিগ্রেশন অফিসার জিজ্ঞাসা করলো,‘কোথায় যাচ্ছেন ?’ বললাম, ‘লিবিয়ায়।’ আবার জিজ্ঞাসা করলো, ‘ওখানে কাজ করেন ?’ বললাম, ‘জি!’ পাসপোর্টের পাতা উল্টিয়ে আরবি-ফার্সি সিল (ঝঊঅখ) ছাপ্পড়ের জঙ্গলে ওদের বিদ্যায় বোঝার উপায় নেই আমি কোথা থেকে এসে কোথায় যাচ্ছি। ইডিমগ্রেশন পার হওয়ার পর নিশ্চিত হলাম, লিবিয়ায় যাচ্ছি।

দুবাই এয়ারপোর্টে নামার পর জানানো হলো, ত্রিপোলিগামী বিমানযাত্রা বিলম্ব হবে প্রায় কুড়ি ঘণ্টা। যাত্রীদের জন্য হোটেলের ব্যবস্থা হয়েছে এবং হোটেলে যাওয়োর বাস বিমান বন্দরের বাইরে অপেক্ষা করছে। হোটেলে ডবল রুমে আমার সঙ্গী ডা. বারি। তার সাথে প্রথম পরিচয়। তিনি তার লিবিয়া যাওয়ার গল্প শুরু করলেন। এর আগে তিনি লিবিয়ায় চাকরি করেছেন। সে চাকরি শেষ হওয়ায় দেশে ফিরে এসেছিলেন। এবার তার নতুন চাকরি। ঢাকা বিমান বন্দর থেকে ফেরত যাওয়ার সম্ভাবনা তারও ছিল। প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলেন। পাঁচ হাজার টাকাও সঙ্গে এনেছিলেন। যদি কোনো কাজে লাগে! বোর্ডিং কার্ড পাওয়ার পর টাকাটা শ্যালকের হাতে দিয়েছিলেন। যখন ইমিগ্রেশন পার হয়ে ভিতরে যাচ্ছিলেন তখন তার শ্যালক দূর থেকে টাকাটা দেখিয়ে ইঙ্গিতে বোঝালেন, ‘টাকাটা এখন আমার।’ তার ক্ষেত্রেও পাসপোর্টে অনেক আরবি সিল দেখে ইমিগ্রেশন অফিসার ধরতে পারেননি তিনি এবার নতুন চাকরিতে যাচ্ছেন। আমিও তাকে আমার অভিজ্ঞতার কথা শোনালাম। অনেক হাসাহাসি হলো, দুজনের অভিজ্ঞতার কিছু সামঞ্জস্যের কথা বলে।

পরদিন যাত্রা করে মধ্যরাতে ত্রিপোলি বিমান বন্দরে পৌঁছলাম। বারি বললেন, ‘শহরের পরিস্থিতি ভালো না। এখন ট্যাক্সি নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।’ দুজনে এয়ারপোর্টে গল্পস্বল্প করে, চা নাস্তা খেয়ে রাত পার করলাম। ভোরে ট্যাক্সি নিয়ে শহরের সারগিয়ায় সোহরাবউদ্দীনের বাসায় পৌঁছলাম। সোহরাব সম্পর্কে ভায়রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্কের অধ্যাপক। শ্যালিকা জোছনার নাস্তার আয়োজনে মুগ্ধ হলাম। দীর্ঘ বিমানযাত্রা এবং নিদ্রাহীন রাত কাটানোয় ভীষণ ক্লান্ত। কিন্তু সোহরাব বললেন, প্রস্তুত হয়ে নেন। আপনাকে ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যাব। [চলবে] 

প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মেডিসিন বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ