গণচেতনার কবি বাউলসম্রাট শাহ্ আবদুল করিম -ইকবাল খোরশেদ

12 Sep 2022, 12:38 PM বাউল ভুবন শেয়ার:
গণচেতনার কবি বাউলসম্রাট শাহ্ আবদুল করিম  -ইকবাল খোরশেদ

যারা চায় স্বাধীনতা

জাগলো আজ সেই জনতা

সবার মুখে একই কথা সামনে চল রে


কৃষক মজুর ভাই ভাই

হিন্দু মুসলিম প্রভেদ নাই

বাঁচার মতো বাঁচতে চাই- সবাই বল রে।

উচ্চারিত কথামালা দ্রোহী বাউলসাধক শাহ্ আবদুল করিম রচিত একটি গণচেতনামূলক গানের কয়েকটি পঙক্তি । ভাটিবাংলার চারণকবি শাহ্ আবদুল করিম ১৯১৬ খ্রিষ্টব্দের ১৫ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজানধর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গ্রামবাংলার সহজসরল ও অনাড়ম্বর পরিবেশে তিনি বেড়ে উঠেছেন। একদিকে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ, অপরদিকে সুবিশাল হাওরের জলরাশি শৈশবেই তাঁকে উদাসী করে তুলেছিল। ভাটি জনপদের সমাজ-সংস্কৃতি, লোকাচার ও লোক-অভিজ্ঞতাকে আত্মস্থ করে তিনি হয়ে উঠেছেন এক স্থিতধী ঋষিপুরুষ। দ্রারিদ্র্য, মানুষের প্রতি মানুষের অবহেলা আর অবজ্ঞার দুঃসহ শৈশবস্মৃতি অন্তরে লালন করে বড়ো হয়েছেন শাহ্ আবদুল করিম। মানুষের বিপন্ন অবস্থা তিনি নানা অভিজ্ঞতায় প্রত্যক্ষ করেছেন। আর সে-সব বেদনা উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়, তাঁর গানে।


শাহ্ আবদুল করিম ছিলেন সম্পূর্ণভাবে একজন স্বশিক্ষিত মানুষ। কোনো অন্ধতা, কোনো গোঁড়ামি কখনও তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। কোনো ধমক-ধামক হুমকির কাছেও তিনি কখনও মাথা নত করেননি। গান গাওয়া প্রসঙ্গে গ্রামের মসজিদের ইমামকে তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন : ‘সত্য বলি গান আমি ছাড়ব না।’ ফলে ঈদের জামাতে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন। আর এভাবেই গ্রামীণজীবনে অনেকবার ধর্মীয় ও সামাজিক আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছেন শাহ্ আবদুল করিম। এসব বাস্তবতা একদিকে যেমন তাঁকে উদাসীন করে তুলেছে অন্যদিকে করে তুলেছে দারুণ প্রতিবাদী।


শাহ্ আবদুল করিম কৈশোরেই সংগীতের প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলেন। যৌবনে নেত্রকোণার বাউলশিল্পী ওস্তাদ রশিদউদ্দিনের সহচার্য তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। সে-সময় তিনি ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিভিন্ন গানের আসরে তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, আবদুস সাত্তার, খেলু মিয়া, দুলু মিয়া, মজিদ তালুকদার, নীলগঞ্জের ফজলুর রহমান, আবেদ, আলাল, উকিল মুনশি প্রমুখ সাধকশিল্পীর সান্নিধ্য লাভ করেন। আর এভাবে শাহ্ আবদুল করিম ধীরে ধীরে গোটা ময়মনসিংহ তথা ভাটিঅঞ্চলে একজন বাউল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।


ভাটি বাংলার জনপদে গান গাইতে গাইতে একসময় আবদুল করিমের মনে প্রশ্ন জাগে, ‘আমার মুর্শিদ কোথায়’ ? সমাধানও পেয়ে যান তাড়াতাড়ি। বাবা ইব্রাহিম আলী এবং মা নাইওরজান বিবি’র আদেশে আবদুল করিম মাওলাবক্স মুনশিকে তাঁর মুর্শিদ হিসেবে গ্রহণ করেন। বাউল করিমের বাড়ি থেকে ১৫ মাইল দূরে তাঁর মুর্শিদের বাড়ি। আর তাঁর মুর্শিদের মাধ্যমেই তিনি সন্ধান পান দেহতত্ত্বের। একবার এক সাক্ষাৎকারে শাহ্ আবদুল করিম বলেছিলেন, ‘রাধারমণের গানের সঙ্গে আমার গানের বেশ মিল আছে। ছোটবেলা থেকে তার গান শুনে আসছি। তাঁর অনেক তত্ত্বগান আছে, যা হিন্দু-মুসলমান সবাই পছন্দ করে। তাঁর গানের মধ্যে রাধা-কৃষ্ণের ভাবধারার গান বেশি। আর আমি দেহতত্ত্বকে বেশি ভালোবেসেছি। দেহের মাঝেই সব কিছু আছে।’


বাউলসম্রাট শাহ্ আবদুল করিম ভাটিবাংলার জনপদে ঘুরে ঘুরে গান বান্ধেন, আসরে আসরে গান করেন। একদিন আবদুল করিমের মুর্শিদ মাওলাবক্স তাঁকে আদেশ দেন, তিনি যেন সংসারী হন। পিতা-মাতার একমাত্র ছেলে হিসেবে তাঁর সংসারী হওয়া অপরিহার্য। মুর্শিদের আদেশে এক কৃষককন্যাকে বিয়ে করেন। বাউল করিম তো পথের মানুষ। সংসারী হতে মন যে চায় না। স্ত্রী সরলা তাঁকে সংসারী হতে সাহায্য করেন। স্ত্রীকেও খুব ভালোবাসতেন করিম। নিজের স্ত্রী সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য স্মরণযোগ্য : সরল শান্ত শুদ্ধমতি সে হলো সুজন।/অশান্ত চঞ্চল আমি হলেম অভাজন ॥/সৎচরিত্র মন পবিত্র ছিল তাঁর গুণ।/সরল বলেই নাম হলো তার সরলা খাতুন ॥


গ্রামবাংলার পথেপ্রান্তরে, নদীজলে, সবুজপ্রান্তরে কত পরিবর্তনই না এসেছে কালক্রমে। নিস্তরঙ্গ গ্রামীণ জীবনে এসে লেগেছে রাজনীতির ঢেউ। পাকিস্তানি শাসনামলে মুসলিম লীগের লুটপাটের দৃশ্য, শোষণ-নিপীড়ন দেখে মানুষ আওয়ামী লীগের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে। বাউল করিম একসময় সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলেন। এই অবস্থানে থেকে মেহনতি মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষিায়, তাঁদের বাঁচার লড়াইয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। একজন রাজনীতিসচেতন মানুষ হিসেবে শাহ্ আবদুল করিম অনেক গণচেতনার গানও রচনা করেছেন। শাহ আবদুল করিমের সাতটি গানের বই প্রকাশিত হয়েছে : তাঁর প্রকাশিত অন্যান্য গানের সঙ্কলন হলো আফতাব সঙ্গীত, কালনীর ঢেউ, ভাটির চিঠি, ধলমেলা, কালনীর কূলে, শাহ আবদুল করিম রচনাসমগ্র। তাঁর প্রায় প্রতিটি গ্রন্থেই তত্ত্বগানের পাশাপাশি গণচেতনার গান মুদ্রিত হয়েছে। বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে ; আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম, গাড়ি চলে না চলে না চলে না রে ; রঙের দুনিয়া তোরে চায় না ; ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে ময়ূরপঙ্খী নাও ; আমি মিনতি করিরে সোনা বন্ধু ভুইলো না আমারে ; আমি বাংলা মায়ের ছেলে, আমি কূলহারা কলঙ্কিনী ; বসন্ত বাতাসে সই গো ; সখি কুঞ্জ সাজাও গো আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে। শাহ আবদুল করিমের এই গানগুলো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।


বাংলার লোকসংস্কৃতি ও গণচেতনার সংগীত পরিমণ্ডলে শাহ্ আবদুল করিম এক অপরিহার্য নাম। ভাটিবাংলার জীবনচর্যায় তাঁর সংগীতরাশি আমাদের দেয় অপার্থিব আনন্দ আর শোষণমুক্তির মন্ত্রণা। লোকজীবনের নানা অনুষঙ্গ তাঁর বিভিন্ন গানে যেভাবে ফুটে উঠেছে তা প্রকারান্তরে ভাটিবাংলারই জীবনচিত্র। লোকমানুষের আকুতি, প্রেম-ভালোবাসা, অধ্যাত্ম‏চেতনা, গণসংগ্রাম তাঁর গানের মূল উপজীব্য। ভাটিবাংলার জীবন-জীবিকা, মানুষের ভাবনা-অনুভাবনা, সংগ্রামশীলজীবন, মারি-মড়ক-বন্যার সঙ্গে নিরন্তর সংগ্রামের কথা অত্যন্ত হার্দিক চেতনায় চিত্ররূপময় হয়ে উঠেছে আবদুল করিমের গানে। বাংলা গানের ধারায় শাহ্ আব্দুল করিম সংযোজন করেছেন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার অপূর্ব সংমিশ্রণ। তাঁর অনেক গানের বাণীর ঝঙ্কারে এবং সুরের মূর্ছনায় একমোহনায় মিশেছে তার সমকাল ও সহস্র বছরের লালিত প্রাণের ধারা।


শাহ্ আবদুল করিম বাংলাদেশ সরকারের একুশে পদকসহ অনেক পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে ১২ সেপ্টেম্বর সিলেটে তাঁর মৃত্যু হয়।