ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

19 Sep 2022, 12:38 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন  -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


আমরা প্রাগ ক্যাসেল চত্বরটি ঘুরে বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে দিলাম। এখানে আমরা কিছুটা দলছুট হয়ে নিজেদের মতো করে ঘুরে বেড়ালাম। চলতি পথে ছোট্ট একটা ব্রিজ অতিক্রম করলাম, এটা কি ভল্টাভা নদীর উপর কি না মনে করতে পারছি না। তবে, আমার কাছে মনে হলো কোনো একটা খাল পার হচ্ছি, ইউরোপের অন্য যেকোনো শহরের ব্রিজের মতো এর রেলিংয়ে বেশ কিছু তালা ঝুলতে দেখা গেল, তাদের ভাষায় এগুলো লাভ লক, প্রেমিক-প্রেমিকারা নিজেদের ভালোবাসার নিদর্শন এবং স্থায়িত্ব কামনায় এ লক-গুলো ঝুলিয়ে দিয়ে চাবিগুলো জলে ফেলে দেয়, কী অদ্ভুত, না! আইসক্রিম খাবো বলে একটা দোকানে থামলাম। আইসক্রিম দেখে ছোটো বেলার কথা মনে পড়ে গেল, যেগুলোকে আমরা গোল্লা বলতাম, নানান রঙের বরফকুচি দিয়ে বানানো আইসক্রিম, তফাৎ শুধু এটা বাহারি গ্লাসে পরিবেশন করা হয়। এরপর আবার পায়ে হেঁটে পথচলা। এরই মাঝে চোখে পড়ল আতি সুন্দর নান্দনিক এক দৃশ্য। সুবেশী এক তরণীর হাতে একটি চমৎকার বাদ্যযন্ত্র, যার থেকে ভেসে আসা সুরের মূর্ছনা আরো বেশি চমৎকার আর জাদুকরী। এর আগে এ বাদ্যযন্ত্রটির ছবি দেখে থাকলেও বাস্তবে এর দর্শন এই প্রথম। যন্ত্রটি মূলত হার্প [herp] নামেই বিশ্বজুড়ে পরিচিত, যদিও বাংলায় একে বীণা বলা হয়। তবে এর আদল আমাদের চিরচেনা বীণা থেকে ভিন্ন। কিছুক্ষণ সুরের যাদুর আবেশে কাটিয়ে পা বাড়ালাম পথে। এতক্ষণে আবার আমাদের দলটির দেখা পেলাম। সবাই একটা উঁচু টিলার মতো জায়গায় ভীড় করছে, পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম, ঘটনা কী জানতে। জানলাম এটি একটি ভিউ পয়েন্ট, যার নাম ববল পয়েন্ট ভিউ যেখান থেকে প্রাহার বা প্রাগ শহরটির বেশ খানিকটা দেখা যায়। ভিড় ঠেলে খুব একটা সুবিধা না করতে পেরে আমরা এদিক-সেদিক ঘুরেফিরে কিছু ছবি তুলে নিলাম। টানা অনেকক্ষণ হাঁটার পরে একটু ক্লান্তও লাগছিল এই ফুরসতে খানিক বিশ্রামও নেওয়া হলো। ইতোমধ্যে এখানটায় আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত সময় ফুরিয়ে আসায় আবার পথে নামালাম। এবারে আমাদের গন্তব্য ওল্ড টাউন প্লাজা যেখানে church of our lady before tyn- আমাদের অপেক্ষায় আছে।

church of our lady before tyn mother of god before tyn ও বলা হয়। গির্জাটি চৌদ্দ শতকের এবং ওল্ড টাউন প্লাজা এলাকাটি এ গির্জাটির জন্যই বেশ পরিচিত। গির্জাটির স্থাপত্য নিদর্শন বেশ নজরকাড়া, অবশ্য পুরো প্রাগ শহরটিই স্থাপত্য-শৈলির জন্য বিখ্যাত। যাদের প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শনের প্রতি ঝোঁক আছে তাদের ভ্রমণের জন্য প্রাগ একটি উপযুক্ত স্থান হতে পারে। বলছিলাম church of our lady before tyn-এর কথা, গির্জাটিতে বর্তমানে কৃত্রিম উপায়ে এর প্রতিদিনকার রুটিনের একটা অংশে জনসাধারণকে আকর্ষণ করার ব্যবস্থা রয়েছে। সাধারণত সন্ধ্যার মুখোমুখি সময়ে গির্জার সবচেয়ে উঁচু জানালাটি খুলে যায়, সেখানে গল্পের মতো করে কিছু চরিত্র তাদের দিন-যাপনের কিছু চিত্র ফুটিয়ে তোলে, শেষ হয় সন্ধ্যার প্রার্থনার আহবান জানানোর মধ্য দিয়ে। বলা বাহুল্য, চরিত্রগুলো কৃত্রিম যেমন হয়ে যাকে পাপেট শোতে। আর এই পুরো দৃশ্যটি দেখতে হলে গির্জার বেশ উঁচুতে থাকা এক জনালায় অপলক তাকিয়ে থাকতে হবে। এতে ঘাড়ে কিছু ব্যথা হলেও চোখের আর মনের আরাম হবে, এটা নিশ্চিত। সন্ধ্যার মুখোমুখি সময়ে শুধু গির্জার সেই নির্দিষ্ট জানালাটি খুলবে, আলো হাতে এক রমণীকে দেখা যাবে, গল্পের শুরু এখানেই তারপর একে একে অন্যান্য চরিত্রের আগমন, সেখানে রাজ দরবারের কিছু চিত্র ফুটে ওঠে, থাকে অন্দর মহলের কথাও। সবশেষে গির্জার ঘণ্টা বেজে ওঠা আর আলো নিভে যাওয়ার সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যাবে গির্জার জানালা, ঘড়িতে তখন ঠিক সন্ধে ৬টা বাজবে নিশ্চিত। আর এর মধ্যদিয়েই আমাদের সেদিনকার শহর ভ্রমণ শেষ হলো। এরপরও আমরা বেশ কিছু সময় এই ওল্ড টাউন প্লাজা-তেই কাটিয়ে দিলাম ; জায়গাটি কিন্তু বেশ জমজমাট, এখানে যেমন রয়েছে নানান রকম স্ট্রিট ফুডের পসরা, তেমনি রয়েছে নানানমুখী বিনোদনের ব্যবস্থা। এর মধ্যে সবচেয়ে মজার ছিল স্ট্রিট ম্যাজিক।

শহর পরিভ্রমণ শেষে ফিরে এলাম নিজেদের অস্থায়ী নীড়ে, সারাদিনের পথচলার ক্লান্তি ঘুচাতে গোসল সেরে নিলাম তারপর খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরিয়ে পরলাম- গন্তব্য আবার সেই ওল্ড টাউন প্লাজা আর উদ্দেশ্য কিছু কেনাকটা করা। সন্ধ্যায় সেখানটায় ঘোরাঘুরি করার সময় বেশ কিছু স্যুভেনিরের দোকান চোখ পড়েছিল, দু’একটায় ঢুঁ মেরে টুকটাক কিছু কিনলেও তা ছিল একেবারেই যৎসামান্য। এখন মূলত কেনাকাটার উদ্দেশ্যেই যাত্রা, এরপর একেবারে রাতের খাবার খেয়ে ঘরে ফিরব, এমনই পরিকল্পনা নিয়ে বের হলাম। ওল্ড টাউন প্লাজা-তে এসে বড়োরকমের ধাক্কা খেলাম। কেন ? পড়ন্ত বিকেলের সেই জমজমাট ওল্ড টাউন প্লাজা -তে এখন নিশুতি রাতের নীরবতা বিরাজ করছে অথচ ঘড়ির কাঁটা তখনো মাত্র সাতটার ঘরে।

 অবশ্য বরাবরই ইউরোপের শপিং মলগুলো বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যে ৭টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়, তবে আমার ধারণা ছিল যে পর্যটন স্পটের আশেপাশের শপিং সেন্টারগুলো হয়তো বেশ রাত পর্যন্তই খোলা থাকে ; যেমন ভুল ধারণা ছিল যে, ইউরোপের শহরমাত্রই রাতজাগা শহর। আদতে তাদের শহরের কিছু নির্দিষ্ট বা নির্ধারিত কিছু জায়গা যেমন- বার, পর্টিহাউজ বা নাইটক্লাব ছাড়া অন্যান্য যা কিছু আছে- শপিংমল, বিনোদন কেন্দ্র, ক্ষেত্র বিশেষে খাবারের দোকানগুলোও সন্ধ্যা লাগার কিছু সময়ের মধ্যে নিজেদের পসরা গুটায়। আমরাই বরং ব্যতিক্রম, রাতদিন সবসময় সব কিছু খোলা রাখা চাই, পেতে চাই সবকিছু হাতের নাগালে। যাই হোক, মনকে এই বলে সান্ত¡না দিলাম, ওই বেলায় চলতি পথে দু’-একটা স্যুভেনির কিনেছিলাম, না হয় একদম খালি হাতেই ফিরতে হতো। যেহেতু এখন আর কেনাকাটার বিষয় রাইল না আর রাতের খাবারের সময় আরো খানিকটা দেরি আছে তাই এই সময়টুকু প্রাগের শান্ত আর গম্ভীর পথে এলোমেলো হেঁটে কাটিয়ে দিলাম। রাতের খাওয়া শেষে একটু তাড়াতাড়িই ঘরে ফেরা হলো। তবে, বাকি সময়টা কিন্তুু আপাত মন্দ কাটেনি। গল্প-আড্ডায় প্রায় মাঝরাত পার করে ঘুমুতে গেলাম।

সকালে একটু বেলা করে ঘুম ভাঙলেও দেখি বাকিরা তখনও ঘুমে। সকাল থেকেই কেন যেন একটু অস্বস্তি হচ্ছিল, বুঝতে পারছিলাম কোথাও একটু ছন্দ-পতন হয়েছে। তবে, নিশ্চিত ছিলাম না তাই অস্বস্তি নিয়েই সবার ঘুম ভাঙালাম। এরপর আমি আর আবিসা নাশতা তৈরি করলাম, সুস্মা তখনও ঘুমে। আমরা তিনজন নাশতা করতে বসে গেলাম এর মধ্যে সুস্মা যোগ দিল। সকালে কারোই যেন কথা বলার মুড নেই। হয়ত দশদিনের এই ইউরোপ ভ্রমণের সমাপ্তি ঘটছে অথবা কারো জীবনে হয়ত কোনো বাঁক তৈরি হয়েছে। বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ আমাদের ফ্লাইট, আমরা ধীরেসুস্থে আমাদের ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে নিয়ে তৈরি হয়ে নিলাম, বশির উবার কল করলো। আমরা হাতে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। হোটেল থেকে এরারপোর্টে পৌছুতে সময় লেগেছে বড়জোড় আধঘন্টা। এরপর রুটিনমাফিক সকল নিয়ম মেনে ঠিক সময়েই আমরা আকাশে উড়লাম। ফেরার পথে সবাই একটু যেন বেশিই চুপচাপ, দশদিনের টানটান উত্তেজনা আর একেকটা নতুন দেশের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার যে আনন্দ সবকিছুর সমাপ্তিতে কিছুটা ক্লান্তি আর মন খারাপের মিশেলে এই নীরবতা খুব স্বাভাবিক। আমার ইউরোপ ভ্রমণের এই লেখার শুরুতেই বলে ছিলাম, সেটা ছিল আমার প্রথম বিমানে ওঠা, প্রথম দেশের বাইরে পা রাখা আর তারপর ইউরোপের বিখ্যাত পাঁচ-পাঁচটি শহর দেখা, এর অলিগলিতে হাঁটাহাঁটি করা, কালজয়ী অনেক ঘটনার সাক্ষী এমন কিছু স্থান/স্থাপনার সাথে পরিচিত হওয়া এটা জীবনের অনেক বড়ো প্রাপ্তি। এটা যেমন আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনি প্রযোজ্য আমার ভ্রমণসঙ্গীদের ক্ষেত্রেও। প্রাগ থেকে বারগেন পৌঁছুতে সময় লাগলো ঘণ্টা দুয়েকের কিছুটা বেশি; সম্ভবত সোয়া দুই ঘন্টা। আমরা বারগেনে পৌঁছি প্রায় বেলা পৌনে তিনটা নাগাদ।  [চলবে]