ইউরোপের ১৫০ দিন -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

05 Oct 2022, 02:25 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন  -সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


বার্গেনের দিনগুলো আমার কাছে খুব একঘেয়েমি লাগে। চারিদিকে প্রকৃতির এত রূপসুধা, মনকে প্রশান্ত করার এত আয়োজন তবু যেন মন কেমন করা অনুভূতিটা থেকেই যায়। দশদিনের ইউরোপ ভ্রমণ শেষে এই মন খারাপের অনুভূতিটা যেন আরো জাকিয়ে বসেছে। হয়ত হুলস্থূল করে কাটানো সময় শেষে একেবারে শান্ত সময়টা খুববেশি নিস্তরঙ্গ হয়ে ধরা দিল বলে। এদিকে ঋতু পরিক্রমায় শরৎ বিদায় নিল বলে, পাতাঝরার দিনের যে চিরাচরিত হাহাকার তা তো আছেই। কেন চিরাচরিত হাহাকার বলছি, আমার দেশের বসন্ত ঋতু আমার কখনই পছন্দের না, আবার সেই পাতাঝরা সময়ের সাথে থাকে কোকিলের মন উদাস করা কুহুতান। এখানে অবশ্য কোকিল নেই আর তার কুহুতানও নাই ; তাই কিছুটা বাঁচোয়া। আবার ক্লাস অ্যাসাইনমেন্ট সবকিছু মিলিয়ে একটা গন্ডির মধ্যে ঢুকে যাওয়া। অক্টোবরের এই সময়টাতে বৃষ্টি খুববেশি না হলেও রৌদ্রজ্জ্বল দিনের দেখা কিন্তু খুব একটা মিলছে না। সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস, বাকি দিনগুলোতে তেমন কোনো কাজই নেই বললেই চলে। কেননা, দিনের বেলা পড়াশোনার অভ্যাস আমার কখনোই ছিল না, তাই দীর্ঘ বিকেলগুলোতে থাকছে অফুরন্ত অবসর, এর মধ্যে আবার মাঝেমাঝে সকালের ক্লাস মিস করছি, আসলে ইচ্ছে করেই মিস করছি। ক্লাসগুলোও একঘেয়ে লাগছে। তবে, অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়া পর্যন্ত তেমন কোনো টেনশন কাজ না করলেও যখন তা ক্লাস রুমে প্রেজেন্টশনের সময় হলো তার দু’দিন আগে থেকে ঘুম হারাম হওয়ার জোগাড়। একে তো এই বিষয়টি আমাকে সবসময়ই নার্ভাস করে, তার ওপর পড়াশোনার ক্ষেত্রে কিছুটা ফাঁকিবাজি তো ছিলই। যাই হোক, সেই সময় কোনো রকমে উৎরালাম। ভালোমন্দ হিসাব না কষে শেষ করতে পারলাম, তাতেই খুশি আর সেই খুশিতে এক বিকালে আমি আর ফারজানা (বার্গেন প্রবাসী বাঙালি) ঘুরতে বের হলাম। পাতাঝরার সময়টা আমার খুব একটা পছন্দ না হলেও এর সৌন্দর্য কিন্তু অবহেলা করা সম্ভব নয়, বিশেষ করে ইউরোপে এ সময় গাছপালা সব রঙিন পাতায় সেজে ওঠে, আর ঝরাপাতায় সেজে ওঠে পথঘাট, যেন রঙিন গালিচায় মোড়ানো। আমরা যে পথে হাঁটছিলাম সেটা খুব অপরিচিত পথ নয়, আমাদের স্টুডেন্ট হাউজ থেকে খুব কাছেই এ পথে আগেও বহুবার হেঁেটছি, তবে তা একটা নিদিষ্টি গণ্ডি পর্যন্ত ; আজ আমরা হাতে সময় নিয়ে বের হয়েছি, আজ আমরা আমাদের সেই নির্দিষ্ট গণ্ডি ছাড়িয়ে যাবো। না ধনুর্ভাঙা কোনো পণ নয়, আমরা বেশ আয়েশেই হেঁটে বেড়াচ্ছিলাম, যেহেতু ফারজানা বেশ কয়েক বছর ধরে এখানকার বাসিন্দা তাই আশপাশ সম্পর্কে তার জানার পরিধিও বেশ। আমরা হাঁটছিলাম আর এটা-সেটা অর্থাৎ আশপাশের স্থাপনা, মানুষ তাদের আচরণ এসব নিয়েই আলাপ চলছিল। যেতে যেতে পথে একটা গির্জা দেখতে পেয়ে থমকালাম, একটু যেন অন্যরকম লাগল, সচরাচর গির্জাগুলো যেমন ঠিক যেন তেমন নয়। আর এর চৌহদ্দিটা এমন বেশি নিস্তব্ধ যে আমি প্রশ্ন না করে থাকতে পারলাম না, মনে হচ্ছিল যেন কোথাও অলিখিত নিয়ম রয়েছে- এখানে প্রবেশ নিষেধ। আসলেই তাই, ফারজানার কাছ থেকে জানলাম এটাকে বলে mormon church বা the church of jesus christ of latter-day saints , এদের ধর্ম বিশ্বাস ভিন্ন, যদিও এরা খ্রিষ্টান তবু এ সমাজে তারা অনেকটা জাত বা ধর্মচ্যুত, সাধারণ জনগণ এদের সাথে মেলামেশা ভালো চোখে দেখে না। তবে এরা তাদের বিশ্বাস ছড়িয়ে দিতে বেশ পরিশ্রম করে চলেছে, এদের টার্গেট গ্রুপে বার্গেনে নতুন আসা শিক্ষার্থীরা। এরা নানান রকম উপঢৌকন এবং খাবারদাবারসহ প্রায়ই ফ্যান্টপে আসে তাদের মতবাদ প্রচার করে, খাবার ও উপহারসামগ্রী বিলি করে। কেউ কেউ হয়ত তাদের আদর্শে কনভিন্স হয়। এটাও শুনেছি কেউ এই গির্জায় গেলে তারা রেড ওয়াইন দিয়ে আপ্যায়ন করে কিন্তু সম্ভাষণ থাকে এসো আমরা রক্তপান করি। তবে আমরা ফ্যান্টপে থাকাকালীন তারা এসেছিল কি না আমার জানা নেই। কেননা, আমি এরকম কোনো কিছু টের পাইনি। সে যাই হোক, গল্প বা সত্যি শুনেই কেমন একটা গা ছমছমে ব্যাপার মনে হয়। আমি আর এখানে সময় কাটাতে নারাজ। তাই আমরা পথে পথে আরো এগুলাম। বিস্তীর্ণ পথ, আগেই বলছি প্রকৃতি এখন শীতের প্রস্তুতি নিচ্ছে, গাছেরা তাদের পাতাদের ঝরিয়ে নিয়ে নির্ভার হচ্ছে আর পথে পথে সেই ঝরাপাতা পথকে করে তুলেছে রঙিন গালিচা। এমনি বর্ণিল পথে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম অন্য একটি গির্জার সামনে যার নাম st. mary's church, এটা অবশ্য ক্যাথলিক গির্জা আর আজ রবিবার হওয়ায় এখানে পূণ্যার্থীদের বেশ আনাগোনাও ছিল, বলাবাহুল্য এদের অধিকাংশের বয়সই পড়ন্ত সময়ের পথে। তবে, এদের আবার অনেকের সাথেই তাদের উত্তরসূরিরা রয়েছে, অর্থাৎ গ্রান্ড মা অথবা গ্রান্ড প্যারেন্টস তাদের গ্রান্ড সন বা ডটারদের নিয়ে এসেছেন। এটাই আসলে এখানকার স্বাভাবিক দৃশ্য, যেখানে বাবা-মা প্রচন্ড ব্যস্ত থাকেন নিজেদের জীবিকা আর জীবন নিয়ে তখন তাদের সন্তানেরা নিজেদের শৈশব আর ছুটির সময়টা গ্রান্ড প্যারেন্টসদের সাথেই কাটায়। এতে অবশ্য উভয়পক্ষই লাভবান হয়, পরস্পরের সঙ্গী আর নির্ভরতার জায়গা তৈরি হয়। নবীন আর প্রবীণেরা মুক্ত থাকে একাকিত্বের ভার থেকে।

পাতা ঝরার পথে লেখক


mormon church

গির্জাটা খুবই সাদামাটা কিন্তু বেশ একটা প্রশান্তভাব নিয়ে যেন পথিককে আহবান করছে, যা উপেক্ষা করা পথিকের জন্য কঠিনই বটে। গির্জা লাগোয়া সিমেট্রিতে প্রিয়জনের আন্তরিক নিবেদন একইসাথে ভালোলাগা আর কষ্টের অনুভূতি তৈরি করে। আমরা কিছুটা সময় গির্জা চত্বরে কাটিয়ে আবার পথে নেমে এলাম। আমার ইউরোপে কাটনো সময়ে পথই আমাকে বেশি টেনেছে, কখনো রৌদ্রোজ্জ্বল পথের চঞ্চলতা, কখনো বৃষ্টিভেজা পথের স্নিগ্ধতা আবার কখনো ঝরাপাতা বিছানো পথের বর্ণিলতা সবটাই আমাকে মুগ্ধ করেছে। সুযোগ পেলেই আমি এই পথ ধরেই ঘণ্টার পর ঘন্টা হেঁটে চলেছি, কখনো ক্লান্ত হলে পথের ধারে বাঁধানো কোনো বেঞ্চে বসে একটু জিরিয়ে নিয়েছি অথবা বসেই থেকেছি খানিকটা সময়। উপভোগ করেছি পথের চঞ্চলতা অথবা নির্জনতা, যেমন এখন করছি নির্জন আর বিজন পথের ধারে বসে একটু দূরের সবুজ থেকে ধুসর হতে যাওয়া বিস্তীর্ণ চরাচরকে দেখছি আর ভাবছি যে, এমন বিজন পথে কখনো কোনো পথিক একটু জিরোবে বলে এত আয়োজন, সবটা কিন্তু প্রকৃতির অবদান নয়, আছে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের আন্তরিকতা আর দূরদর্শিতা। এরকমটা সবসময়ই আমার মনকে বিষণ্ন করে, অজান্তেই নিজ দেশের নীতি নির্ধারকদের আন্তরিকতা আর অদুরদর্শিতার কথা মনে পড়ে যায়।

st. mary's church,

সময়টা যেহেতু শরতের শেষ, প্রকৃতিতে কিন্তু তখনই দিনের সময় অনেকটা রাত্রির হাতে সোপার্দ করেছে, কমিয়ে নিয়েছে নিজের পরিধি। আমি যখন বাগের্নে পৌঁছি, অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে বার্গেনে আসি তখন রাত্রি দশটা সাড়ে দশটা নাগাদও সূর্য ঠায় তার তেজ দেখিয়ে যেত, এখন অবশ্য সন্ধে নামে সাতটা-সাড়ে সাতটা নাগাদ, আমরা পথের ধারে বসে এই সন্ধের প্রতীক্ষায়ই আছি। দিনের এই সময়টা সব সময়ই অদ্ভূত সুন্দর, সমস্ত দিনের হিসাব নিকাশের পাঠ চুকিয়ে ঘরে ফেরার যে আয়োজন সেটা বেশ উপভোগ্য, সে হোক মানুষ বা প্রকৃতির অথবা হোক সেটা নগর বা গ্রাম ; আবারও জীবনানন্দ দাশের কবিতা মনে পড়ে- “সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন” আমরা শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যার পদধ্বনি শুনছি, সূর্যের সোনালি আভার আত্মসমর্পণ দেখছি, এখানে সন্ধ্যার নির্জতার সঙ্গে জোনাকির কোনো আলপন চলে না। তবে, এই নির্জনতারও একটা অদ্ভুদ ছন্দ আছে। দিনের সব আলো নিভে গেলে আমরা আবার পথ চলতে শুরু করলাম। কবিতার পৃথিবী থেকে বাস্তবতায় ফিরতেই একটু শীত শীত অনুভুত হলো, চলতে চলতে মনে হচ্ছিল পথের ধারে বসে একটু চা খেতে পারলে মন্দ হতো না। তবে এই মনে হওয়াটাই সার, এখানে বোধ করি মাইল পাঁচ-সাতের মধ্যেও চা তো দূর, কফিরও দেখা মিলবে না, অগত্যা নিজ আবাসে গিয়ে চা বা কফি পানের তেষ্টা মেটাতে হবে।