ভালো মানুষ হতে চান লায়লা

05 Oct 2022, 02:45 PM সারেগারে শেয়ার:
ভালো মানুষ হতে চান লায়লা

বর্তমান প্রজন্মের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী সুলতানা ইয়াসমিন লায়লা। প্রায় একযুগ ধরে তার কণ্ঠের মাধুর্য দিয়ে গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রেখেছেন। আশি-নব্বইটির মতো মৌলিক গান গেয়েছেন। প্লেব্যাক করেছেন বেশ কয়েকটি ছবিতে। তার প্রথম মৌলিক গান ‘আমি তোমার হাতের ঘুড়ি হব’। এরপর ‘সখি গো আমার মন ভালা না’, ‘অন্তরেতে দাগ লাগাইয়া’-এর মতো অসংখ্য জনপ্রিয় গান তাকে পরিচিতি এনে দিয়েছে। সংগীতশিল্পী লায়লাকে নিয়ে বিস্তারিত থাকছে এবারের সারেগারে আয়োজনে। লিখেছেন শহিদুল ইসলাম এমেল...


সংগীত রিয়েলিটি শো ‘ক্লোজআপ ওয়ান ২০১২’ চ্যাম্পিয়ন সুলতানা ইয়াসমিন লায়লা বর্তমানে খুব ব্যস্ত সময় পার করছেন। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের শো, ওপেন কনসার্ট, সিনেমার প্লেব্যাক, মৌলিক গান এবং গানের মিউজিক ভিডিও নিয়ে বেশ ব্যস্ত তিনি। প্রতিদিনই স্টুডিওতে নতুন নতুন গানের রেকর্ডিং হচ্ছে। প্রায় পনেরটির মতো নতুন গানের কাজ চলছে। সম্প্রতি ২১ সেপ্টেম্বর সাউন্ডটেকের ব্যানারে রিলিজ হয়েছে ‘বাঁশি ওই শোনা যায়’ নামের একটি গান। এটা পন্ডিত রামকানাই দাসের স্ত্রী সুবর্ণা দাসের লেখা একটি গান। ২০ তারিখ বিটুবি মিউজিক স্টেশন থেকে ‘বন্ধু তোমায় আলবিদা জানাই’ নামের আরেকটি মৌলিক গান রিলিজ হয়েছে।

বাকি গানগুলো রিলিজের অপেক্ষায় আছে। এছাড়া মাস তিনেক আগে ‘অন্তরেতে দাগ লাগাইয়া’ নামে একটি গান রিলিজ হয়েছে স্টার টি মিউজিক ইউটিউব চ্যানেল থেকে। চ্যানেলটি নতুন এবং খুবই কম সংখ্যক সাবস্ক্রাইবার ছিল। তারপরও রিলিজের পরপরই সাড়া ফেলেছে গানটি। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই গানটি সাদরে গ্রহণ করে শ্রোতারা। ছোট্ট একটি চ্যানেলে মাত্র তিন মাসে সাতাশ মিলিয়ন ভিউ হয় গানটির। এটি লায়লার কাছে বিশাল একটি ব্যাপার। এ প্রসঙ্গে লায়লা বলেন, ‘গানটি রিলিজের আগে টিকটকে গানটির দুটি লাইন প্রচার করা হয়। টিকটকে দেওয়ার পরপরই প্রচুর মানুষ সার্চ করতে থাকে। গানটি বেশি সার্চ করার ফলে ইউটিউবে ঢুকলেই অটো আসতে থাকে। গানটি দুদিন পর রিলিজ দেওয়ার কথা ছিল। টিকটকে সাড়া পাওয়ায় আমরা সিদ্ধান্ত নিই দুদিন পর না আজই এই মুহূর্তে গানটি ছাড়তে হবে। তখন আমরা হাতে একঘণ্টা সময় নিই। এই একঘণ্টা সময়ের মধ্যে গানটি রিলিজ করতে সক্ষম হই। এটা শুধু শ্রোতাদের কাছ থেকে সাড়া পাওয়ার কারণে।’

লায়লার সংগীতের শুরু তার বাবার হাত ধরেই। তার বাবা শফিকুল মৃধা ছিলেন বাউল শিল্পী। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তার বাবাকে দোতারা হাতে নিয়ে বের হতে দেখেছেন। যেদিন গিয়েছেন সেদিন হয়ত আসেননি। বাউল প্রোগ্রাম শেষ করে হয়ত পরদিন বাড়িতে এসেছেন। সেগুলো দেখে দেখেই লায়লার বেড়ে ওঠা। একদিন সন্ধ্যার পর তার রুমে শুয়ে শুয়ে বাবার গাওয়া একটি গান ‘ভুল বুঝে চলে যাও’ গাচ্ছিলেন। তার গানের কথা মুখস্থ ছিল আর সুর কীভাবে যেন হয়ে গেল। ওই সময় তার বাবা বাড়িতে চলে আসেন। লায়লা জনতো না। বাবা এসে তার মাকে বলে কথা বলো না। কী গাইছে একটু শুনি। আড়াল থেকে বাবা তার গান শোনে। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বাবা লায়লাকে ডাকেন। মাঝে মাঝেই তার বাবা তাকে ডাকেন দোতারা নিয়ে যাওয়ার জন্য। প্রতিদিনের মতো ওইদিনও দোতারা নিয়ে যায় বাবার কাছে। দোতারা দেওয়ার পর বাবা লায়লাকে বলেন পাটি পাড়। পাটি পাড়ার পর লায়লা ঘুমাতে যাবে এমন সময় বাবা তাকে বলেন তুই এখানে বস। লায়লা একটু অবাক হয়, তাকে কেন বসতে বলছেন। এমন সময় বাবা তাকে বলেন, তুই পাশের রুমে কী গাইছিলি মা, ওই গানটা একটু গা তো। বাবা তাকে বকবে কি না এই ভেবে লায়লা তখন একটু ভয় পেয়ে যায়। গান গেয়ে তিনি কোনো অপরাধ করে ফেলেছেন কি না এসব ভাবতে থাকেন। তারপর বাবা বলেন, ‘গা আমি একটু শুনি কেমন গাইতে পারিস।’ লায়লা ভয়ে ভয়ে ওইদিনই প্রথম দোতারার সঙ্গে গলার সুর মিলিয়ে গাওয়ার চেষ্টা করেন। প্রথম দিন লায়লা কোনোভাবেই দোতারার স্কেলের সঙ্গে গলাটা মেলাতে পারছিলেন না। তখন তার স্কেল সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। থাকবেই বা কেন ? তখন তার বয়স ছিল মাত্র সাত-আট বছর। তারপরও দোতারা যে স্কেলে বাঁধা ওই স্কেলে গাওয়ানোর জন্য তার বাবা খুব চেষ্টা করেন। ওইদিন পারেননি লায়লা। যার কারণে তার বাবা একটু মন খারাপ করে বলেন, ‘আমি কী ভেবেছিলাম আর কী হলো। তোর দ্বারা হবে না। এই বলে তার বাবা দোতারা রেখে দেন।’ সেদিন রাতে তার বাবা ঘুমাতে পারেননি। লায়লার কোনো ভাই নেই। দুই বোন। বড়ো বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। এজন্য তার বাবা হয়ত ভাবছেন তিনি যদি দেহ ত্যাগ করেন তাহলে তার উত্তরসূরি কে হবে ? তার বাবা হয়ত সেটা ভেবেই ঠিক পরের দিন একই সময়ে রাতে বাজার থেকে এসে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আবার লায়লাকে নিয়ে বসেন। ওইদিন অনেক চেষ্টার পর দোতারার স্কেলের সঙ্গে গলাটা মেলাতে পারেন। তারপর থেকেই লায়লার গান শেখা শুরু। এরপর থেকে বাবার সঙ্গে প্রত্যেকদিন রেওয়াজে বসতেন।

লায়লা বলেন, ‘ওই সময় গান গাওয়ার সময় আমার গলায় কোনো দরদ থাকত না। বুঝতেই পারছেন ছোটো মানুষ। তখন আর কী-বা বুঝি আমি। আব্বা আমাকে বোঝাতেন আরো দরদ দিয়ে গাও, আরো ভিতর থেকে গাও। এর মানে তো তখন আমি বুঝিনি। আব্বা প্রায় একঘণ্টা সময় নিয়ে আমাকে বোঝালেন যে, বাউল গান অনেক দরদ দিয়ে গাইতে হয়। অনেক আবেগ দিয়ে গাইতে হয়। কিন্তু আমি সেটা কোনোভাবেই বুঝতে পারছিলাম না। বাবা আমাকে এতক্ষণ ধরে বোঝাচ্ছেন কিন্তু আমি বুঝতে না পারায় উনি আমার ওপর রেগে যান এবং বকুনি দেন। আমি আব্বার বকুনি খেয়ে কাঁদতে থাকি।’ তখন আব্বা বলেন, ‘এখন গা। কাঁদবি না। এই যে কাঁদতেছিস এই অবস্থায় গানটা গা।’ আমার মনে আছে ওই গানটার কথা ছিল ‘আমার এতটুকু জ্ঞান হাইল না ওই লোকটা যে বৈদেশি, আমি কোন সে ভুলে তারে ভালোবাসি’। তখন আমি কান্নার কারণে ঠিকমতো গানটি গাইতে পারছিলাম না। কান্নারত অবস্থায় ওই গানটিই নাকি আব্বার ভালো লেগেছিল। গানটি গাওয়ার সময় এক পর্যায়ে আমাকে আব্বা বলেন, ‘এখন যেভাবে কাঁদতে কাঁদতে গানটি গাইছো ঠিক এভাবেই তুমি গাইবে।’ আবেগের এমন প্রয়োগ আমি আব্বার কাছ থেকে শিখেছি। তারপর সারগামের তালিম, হারমোনিয়াম, এগুলো আমারই গ্রামের একজন কাকাবাবু ছিলেন তার কাছ থেকে শিখি। উনার নাম অমল বিশ্বাস। উনাকে একদিন আব্বা ডেকে বললেন, ‘আমি তোমার মতো সারগাম কীভাবে তুলতে হয় জানি না। আমার মেয়েটাকে তোমার হাতে দিলাম। তুমি একটু সন্ধ্যার পর এসে মেয়েটাকে সারগামের তালিম দাও।’ তখন থেকেই ওই কাকাবাবুর কাছে সারগামের তালিম নিই। আর গান আমার আব্বার কাছ থেকেই শেখা। গানের হাতেখড়িও আব্বার কাছেই। আমার পড়াশোনাও সংগীতের ওপর। কিছুদিন আগে মাস্টার্স কমপ্লিট করেছি।

লায়লা প্রায় আশি-নব্বইটির মতো মৌলিক গান গেয়েছেন। বেশ কয়েকটি সিনেমায় প্লেব্যাক করেছেন। লায়লার প্রথম মৌলিক গান ‘আমি তোমার হাতের ঘুড়ি হব’। এরপর ‘আখ ক্ষেতে ছাগল বন্দি, জলে বন্দি মাছ... সখি গো আমার মন ভালা না’, ‘অন্তরেতে দাগ লাগাইয়া’-এর মতো অনেক জনপ্রিয় গান তাকে পরিচিতি এনে দিয়েছে।

ক্লোজআপ ওয়ান চ্যাম্পিয়নের অনুভূতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘তখনকার অনুভূতি বলে বোঝাতে পারবো না। এত বড়ো বড়ো গুণী মানুষদের সান্নিধ্যে আসতে পারা আমার কাছে বিশাল ব্যাপার। পার্থ বড়–য়া, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল স্যারকে কাছ থেকে দেখা, আমার প্রতি তাদের স্নেহ উপলব্ধি করা। তারপর ফাহমিদা নবী ম্যাডাম ছিলেন, এই গুণী ব্যক্তিদের কাছ থেকে দেখবো এটাই তো জীবনে কল্পনা করতে পারিনি। পুরো সিজনটা আমার ঘোরের মধ্যে কেটেছে। এক পর্ব থেকে আরেক পর্বে যেতে যেতে কেমন করে যেন ফাইনালে চলে এলাম। এখান থেকেই মিডিয়ায় আমার পরিচিতি। আমি মনে করি ক্লোজআপ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন হয়েছি সকলের দোয়া, ভালোবাসা আর এসএমএস-এর কারণে। আমার এলাকার মানুষ আমাকে এসএমএস করে যেভাবে সাহায্য করেছে এটা আমি চিন্তাও করিনি। একজন ভ্যান চালক ভ্যান চালিয়ে এসে পঞ্চাশ টাকা জমা দেন এসএমএস করার জন্য। একজন স্কুলের টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে এসে বলে এটা দিয়ে আমাকে এসএমএস করে দেন আপুকে। এরকমও আছে, আমি বাড়িতে গিয়ে শুনেছি একজন ভিক্ষুক এসে টাকা দিয়ে বলছে মেয়েটাকে একটু এসএমএস করে দাও তো। এগুলো মনে হলে এখনো চোখে জল আসে। আমার এলাকার মানুষের একটাই লক্ষ্য ছিল কীভাবে আমি এগিয়ে থাকব। দেশের বাইরে থেকেও আমাকে প্রচুর এসএমএস করে সাহায্য করেছে। সবার প্রতিই আমি কৃতজ্ঞ।’

সংগীত নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাইলে বলেন, “আসলে তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে আমার আব্বা একটা কথা সব সময় বলেন, যে গানগুলো অপ্রচলিত, অবহেলিত, যে গানগুলো মানুষ কখনো শোনেনি সেই গানগুলো তোমার কণ্ঠের দ্বারা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দেবে। আব্বার সেই কথা মাথায় রেখেই টেলিভিশন লাইভে এবং স্টেজ শোগুলোতে গাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আর পরিকল্পনা হচ্ছে আরো বেশি বেশি গান করতে চাই। লোকগান ধারণ করে বেঁচে থাকতে চাই। গান গেয়েই আমি যেন দেহ ত্যাগ করতে পারি। লোকসংগীতশিল্পী হওয়ার পাশাপাশি একজন ভালো মানুষ হতে চাই।