পাগলাটে এক পরিচালকের গল্প ফুরালো!

10 Oct 2022, 12:14 PM হলিউড শেয়ার:
পাগলাটে এক পরিচালকের গল্প ফুরালো!

যারা নতুন নিয়ম গড়েন তাদেরই পুরনো নিয়মটাকে ভাঙার দায়িত্ব নিতে হয়। কাজটা মোটেও সহজ নয়। আর সবার সেই সাহসও থাকে না। যাদের এই দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয় তারাই নতুন ইতিহাস গড়েন, তারাই অমর হন। তার এই অমরত্বের শুরু মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই। এমনই এক মানুষ জ্যঁ লুক গদার। সিনেমাপ্রেমীদের মাঝে তিনি দারুণ জনপ্রিয়। ফ্রান্সের যে-কয়জন পরিচালক ফ্রান্সের চলচ্চিত্রকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন জ্যঁ লুক গদার তাদের মধ্যে অন্যতম। কিছুদিন আগে তিনি দীর্ঘ অসুস্থতার পর স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে তার বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান করেন। তার অমরত্বে জীবনের শুরু এখন থেকেই। জ্যঁ লুক গদারের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি এবারের হলিউড আয়োজনে...


জ্যঁ লুক গদার তার সময়ের সেরা একজন নির্মাতা। তার ক্যারিয়ারের প্রথম সিনেমা ‘ব্রেথলেস’ নির্মাণ করে বিশ্বজুড়ে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন জ্যঁ লুক গদার। প্রচলিত সিনেমার ভাষার রীতি ভেঙে নতুন ভাষা নির্মাণে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর প্যারিসে জন্ম নেন জ্যঁ লুক গদার। তার শৈশব কাটে প্যারিস ও সুইজারল্যান্ডে। শৈশবে কিছুদিন সুইজারল্যান্ডে কাটিয়ে পরবর্তীসময়ে প্যারিসে ফিরে আসে তার পরিবার। স্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন। শিল্পী হওয়ার আকাক্সক্ষা ছিল তার ছেলেবেলা থেকেই। তবে পরবর্তীসময়ে নানা ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তিনি। দেশে ফিরে এসে তিনি সিনে ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হন। ফ্রান্সের এ ক্লাবের সদস্যরা তখন নতুন এক ধারার সিনেমার কথা ভাবছিলেন। এ সময় সমালোচক আঁদ্রে ব্যাজে, ফ্রান্সিস ত্রæফো, ক্লড ক্যাবল ও জ্যাক রিভের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। সিনেমায় নতুন ধারা নিয়ে এই দলের সদ্যস্যরা বেশ সক্রিয় ছিলেন। ‘কায়ে দ্যু সিনেমা’ নামে তাদের গ্রæপটি পরিচিত। এদের সঙ্গে গদার ম্যাগাজিনে সিনেমার সমালোচনা লিখতে শুরু করেন। এভাবেই তিনি সিনেমা নিয়ে মতবাদ ও ভাবনার প্রকাশ ঘটান। আর সিনেমা নির্মাণে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

সমালোচক থেকে নির্মাতা হওয়ার পথটি যে খুব সহজেই করে ফেলেছেন তা কিন্তু নয়। তিনি একটা মোটামুটি প্রস্তুতির মধ্য দিয়েই গেছেন। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রেথলেস নির্মাণের আগে তিনি বেশকিছু শর্টফিল্ম নির্মাণ করেন। সিনেমা নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি ত্রæফোর আইডিয়া ব্যবহার করেছিলেন এক অপরাধী ও তার প্রেমিকাকে নিয়ে। ত্রæফো একটা গল্প ভেবেছিলেন কিন্তু সেটি নিয়ে আর আগাননি। ত্রæফোর অনুমতি নিয়েই গদার এ সিনেমায় হাত দেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিসের পটভূমিতে এ সিনেমায় গদার কৃত্রিম কোনো আলো ব্যবহার করেননি। আরেকটি বিষয় ছিল প্রতিদিনের চিত্রনাট্য সেদিনই লেখা হতো। বাস্তববাদী চলচ্চিত্র হিসেবে সিনেমাটি দারুণ জনপ্রিয় হয়। এ সিনেমা দিয়েই অভিনেতা জ্যঁ পল বেলমন্দো একজন স্টার হয়ে ওঠেন আর বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এই সিনেমার জন্য গদার জিতেছিলেন সিনেমা পরিচালকের পুরস্কার।

তিনি সিনেমাকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নেননি। তার সিনেমার উদ্দেশ্য ছিল সমাজকে তুলে ধরা। গদারের ‘লা পেতি সোলদা’ সিনেমাটি ফরাসি সরকারের সমস্যার কারণ হয়। সিনেমায় তিনি ফরাসি সরকারের নানা দমনমূলক নীতি থেকে সরে আসতে উপদেশ দিয়েছিলেন। ফরাসি সরকার সিনেমাটি ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। ষাটের দশক ছিল গদারের সফলতার দশক। তার ক্যারিয়ারের ঝুলিতে রয়েছে একের পর এক এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা। এর মাধ্যমেই সময়কে ছাপিয়ে যান তিনি, পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নেন চলচ্চিত্র দুনিয়ার অসীমতায়। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি একের পর এক তৈরি করে গেছেন একান্ত নিজস্ব তরিকায় এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা। যার মধ্যে আছে ‘আ উম্যান ইজ দ্য উম্যান’, ‘আলফাভিল’, ‘উইকেন্ড’, ‘অলস্ ওয়েল’, ‘হেইল মেরি’, ‘কিং লিয়ার’। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে, ৮০ বছর বয়সে মুক্তি দেন নিরীক্ষাধর্মী থ্রিডি সিনেমা ‘গুডবাই টু ল্যাংগুয়েজ’। এই সিনেমায় তার কুকুর রক্সি ছিল মূল ভূমিকায়। পেশাগত ও ব্যক্তিজীবনে গদার ছিলেন বরাবরই সমালোচিত। আন্না কারিনা এবং আনে ভিয়াসেমস্কির সঙ্গে গদারের দাম্পত্যজীবন খুব একটা সুখকর ছিল না, যার বহিঃপ্রকাশ আমরা তার সিনেমাগুলোতে দেখতে পাই।

২০০২ খ্রিষ্টাব্দে সাইট অ্যান্ড সাউন্ড ম্যাগাজিনের আয়োজিত ভোটে সমালোচকদের প্রদত্ত ভোটে তিনি সর্বকালের সেরা দশ পরিচালকের তালিকায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। ভারতীয় কালজয়ী পরিচালক মৃণাল সেন ও সত্যজিৎ রায় তার সিনেমা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন।

লেখা : ফাতেমা ইয়াসমিন