ইউরোপের ১৫০ দিন-সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

09 Feb 2023, 02:29 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন-সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


বন্ধু বাবুর সাথে সেবার আর দেখা হলো না, অবশ্য তখন থেকেই মনে মনে সুযোগ খুঁজছিলাম। এই জন্য অবশ্য আমাকে টানা চার থেকে পাঁচ দিনের একটা ছুটি পেতে হবে, যদিও আমাদের ক্লাস ছিল সপ্তাহে তিন দিন, তবে তা এক দিন পরপর যে-কারণে টানা চার-পাঁচদিনের ছুটি সহজে মেলানো সম্ভব হচ্ছিল না। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে ঠিক মাঝামাঝি না সম্ভবত ১০/১১ তারিখে কোনো একটা ছুটি ছিল এখন একদম ঠিক করে বলতে পারব না কীসের ছুটি ; যাই হোক, ছুটি মিলতেই আমি টিকিট করে ফেললাম, মোট চার দিনের সফর। বারগেন থেকে সকাল ১০ টার ফ্লাইটে সরাসরি কোপেনহেগেন। একঘণ্টা বিশ মিনিটের যাত্রা, বাবুকে মেসেজ দেওয়া ছিল সে আগে থেকেই এয়ারপোর্টে ছিল। এখানে চুপিচুপি বলে নেই আমি কিন্তু বেশ চিন্তায় ছিলাম যে প্রায় ১৬/১৭ বছর হলো বাবুর সাথে আমার দেখা নেই, সত্যি বলতে এর মাঝে তার সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগই ছিল না এমন কি ফেসবুকেও সে আমার বন্ধু ছিল না। এত র্দীঘ সময়ের ব্যবধানে নিশ্চয়ই অনেক পরিবর্তন ঘটেছে যেমনটা আমারও, তাই তাকে চট করে চিনতে পারব কি না তা নিয়ে আমার মাঝে বেশ সংশয় ছিল। কিন্তু না, এয়ারপোর্টের আনুষ্ঠানিকতা সেরে বের হয়ে একটু এদিক-সেদিক তাকাতেই দেখি একদম শাহরুখ খান স্টাইলে বন্ধু বাবু দাঁড়িয়ে।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে বেশ খানিকটা পথ হেঁটে গাড়িতে উঠতে হয়। গাড়ির কাছাকাছি এসে আমি সারপ্রাইজড, বাবু যে তার পুরো পরিবার নিয়েই আমাকে রিসিভ করতে এসেছে এতক্ষণ পর্যন্ত কিন্তু সে আমাকে এটা বলেইনি। তার কন্যা আদিবা আর স্ত্রী অ্যানি গাড়ির কাছে আমাদের অপেক্ষায় ছিল। এতে আমি নিঃসন্দেহে অনার্ড ফিল করেছি, ওদের সাথে এটাই আমার প্রথম দেখা যার শুরুটাই ছিল বেশ আন্তরিকতার। এয়ারপোর্ট থেকে বাবুর বাসায় যেতে সম্ভবত মিনিট পঞ্চাশের মতো সময় লাগে। বলে রাখা ভালো নভেম্বরের এ সময়টাতে এসে ইউরোপে দিনের স্থিতি ছয় ঘন্টায় এসে দাড়িয়েছে। সকাল সাড়ে ন’টায় র্সূয ওঠে আর বিকেল তিনটা না বজাতেই সূর্য তার পাট গুছিয়ে বিশ্রামে চলে যায়। এ যেন সূর্যের একদম অলস দিন-যাপন। বাড়ি পৌঁছে ফ্রেস হয়ে নিয়েই বাবু আর অ্যানি লাঞ্চ তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, এই ফাঁকে আমি আদিবার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করলাম। স্বভাবতই শিশুরা নতুন কারো সাথে চট কলে ভাব করে না , তারা একটু সময় নেয় আর আদিবার ক্ষেত্রে ভাষাটাও একটু বাধা ছিল আমি তার সাথে বাংলায় কথা বলছিলাম সে বাংলা সবটা বুঝতে পারলেও বলতে অতটা সাবলীল ছিল না। সে বাংলা, ডাচ আর ইংরেজি মিশিয়েই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছিল, আমি যদিও সবটা বুঝতে পারছিলাম না তবে শুনতে বেশ মিষ্টি লাগছিল। এর মধ্যে লাঞ্চ তৈরি হয়ে যাওয়ায় আমরা সবাই খেতে বসে গেলাম, উদ্দেশ্য তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে যদি দিনের আলো থাকতে থাকতে বের হওয়া যায় তবে কোপেনহেগেনের কিছুটা দেখা হবে।

খুব তোড়জোড় করে সাত তাড়াতাড়ি বের হওয়ার চেষ্টা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। আমরা বোধকরি আড়াইটার মধ্যে বের হতে পেরেছিলাম কিন্তু পথে নামতেই মনে হলো আঁধার যেন টুপ করে নেমে এল, মনে হলো যেন আমাদের বের হওয়ার অপেক্ষাই করছিল, তাই আমরা পথে নামতেই আর দেরি করল না। যেহেতু আমাদের গন্তব্য নির্ধারিত ছিল তাই আমরা আর পথ বদলালাম না। সাড়ে তিনটার কাছাকাছি সময়ে আমরা আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম, ঘড়ির কাঁটায় সময় তখন বিকেল সাড়ে তিনটা হলেও মনে হচ্ছিল যেন রাত্রি ন’টা সাড়ে ন’টা বাজে। শীতের রাত, এমনিতেই ইউরোপে তাপমাত্রা এ সময় দুই সংখ্যার ঘরে পৌঁছুয় না তার-উপর ঝিরঝির বৃষ্টি। এটি মূলত একটি লক, যেটাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে পার্ক, যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই প্রাধান্য পেয়েছে, রয়েছে ক্লাব আর রেস্টুরেন্ট। যেহেতেু আমরা খাবার খেয়েই বের হয়েছি তাই পার্কের সৌন্দর্যই আমাদের এখনকার মতো মূল আকর্ষণ। যদিও সূর্য অস্তাচলে গেছে, কিন্তু পার্কের কৃত্রিম আলোয় আমরা বেশ সাচ্ছন্দেই ঘুরে বেড়াতে পারছি। লেক ঘিরে রয়েছে ফুল আর লতাপাতা ঘেরা ছাউনি, রয়েছে কাঠের বেঞ্চ, কিন্তু কিছুক্ষণ আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টির কারণে বসার সুযোগ নেই সবটাই ভেজা। অবশ্য এরই মাঝে বৃষ্টির ছাট ঝিরঝির থেকে বেশ গতি পেয়েছে, সুতরাং আলো-আধারির এই মায়বী সৌন্দর্যের মাঝে আর থাকা সম্ভব হলো না। আমরা অনেকটা দৌঁড়েই গাড়িতে উঠে বসলাম।

সে রাতে ঘোরাঘুরি এখানেই মূলতবি করতে হলো। এমনিতেই ইউরোপের অধিকাংশ শহরে রাতে গুটিকয় শপিংমল আর রেস্টুরেন্ট ছাড়া যাওয়ার মতো তেমন কোনো জায়গা থাকে না। আর শপিংমল গুলোও সব প্রায় বিকেল ৫.০০টা থেকে সন্ধ্যে ৭.০০টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। আর আমাদের যেহেতু শপিংমলে যাওয়ার কোনো প্লান নেই তাই বাড়ির রাস্তাই এখন লক্ষ্য, তবে ফেরার পথে সুপার শপে থামা হলো, বাবু আর অ্যানি তাদের সংসারের টুকিটাকি কিছু জিনিস এবং আনাজ-পাতি কিনে নিল। বাসায় ফিরে গরম-গরম চা-য়ের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা চলল, তারপর ডিনার। ডিনার শেষে আবার কিছুক্ষণ আড্ডা, এরপর ঘুম।

পরদিন সকাল সকাল উঠব ভেবেই ঘুমুতে গেলাম, এমনিতেই নতুন জায়গায় আমার খুব একটা ভালো ঘুম হয় না তারপরও যেন ঠিক সকাল সকাল ওঠা হলো না। আমার যখন ঘুম ভাঙল ততক্ষণে বাবু তার মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি চলে এসেছে আর অ্যানি তার ইনস্টিটিউশনে চলে গেছে। বলা হয়নি অ্যানি কোপেনহেগেনে একটি কোর্স করছে, যেটি হাসপাতালের সেবা এবং যতœ ব্যবস্থাপনা সচেতনার সাথে সম্পৃক্ত। যদিও কোর্সটির প্রকৃত নাম, এখন আমি মনে করতে পারছি না। বাবু আর আমি নাশতা সেরে মোটামুটি সারাদিনের পরিকল্পনা নিয়ে বের হয়ে গেলাম। আজ আমরা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করে বেড়াবো, সেইমতো বাবুর বাড়ির সব থেকে কাছে যে মেট্রো স্ট্যান্ড সেখানে যাব বলেই বের হলাম, হঠাৎই বাবু বলল, তার মেয়ে আগে যে প্রি-প্রাইমারি স্কুলে পড়ত সেখানে যাবো কি না ? প্রতিষ্ঠানটি বেশ অন্যরকম, শিক্ষা কার্যক্রম যে কত বর্ণময় এবং আনন্দের হতে পারে তার এক চমৎকার আয়োজন। এখানে বলে নেই আমরা যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে রেগুলার গ্রেজুয়েশন করেছি তারা শিক্ষা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত যেকোন ইনোভেটিভ আইডিয়া তাদের কাছে সব সময়ের জন্য আগ্রহের বিষয়। সুতরাং বাবুর প্রস্তাবে সানন্দে রাজী হয়ে গেলাম। বিদ্যালয় চত্বরে ঢুকতেই আমি বেশ চমৎকৃত, প্রথমত পুরো বিদ্যালয়টিই উন্মুক্ত। তথাকথিত কোনো বাউন্ডারি নেই, ছোটো ছোটো পাতাবাহারের ঝাড় দিয়ে এর সীমানা ঘেরা। এর প্রবেশের গেটটি কাটা-কম্পাস আর পেনসিলের আদলে তৈরি। এই গেট দিয়ে ঢুকে বেশ খানিকটা পথ, তারপর ছোট্ট একটা কাঠের দরজা, যা দিয়ে বিদ্যালয়ের মূল চত্বরে ঢুকতে হয়, রিসিপশনটাও এখানেই। স্বাভাবিকভাবেই এখানে এন্ট্রি রেসট্রিকটেড, কিছু অফিসিয়াল ফর্মালিটিস মেনে আমরা ভেতরে ঢোকার সুযোগ পেলাম। ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো এটাকে স্কুল না বলে প্লে-গ্রাউন্ড বলাই ভালো। শিশুদের বিকাশের সকল আয়োজন এখানে রয়েছে সবটা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হলেও এখানে কৃত্রিমতাটা যে প্রকৃতির সাথে মিলে-মিশে একাকার। শিশুদের জন্য রান্না-বান্নার সুযোগ থেকে শুরু করে আকাশের বিশালতা দেখার সুযোগ সবই এখানে বর্তমান। তাই বলে যে পড়াশোনা হচ্ছে না তা কিন্তু নয়, রয়েছে বর্ণপরিচয়ের আয়োজন, খেলার ছলে অঙ্ক শেখা, তবে সবচেয়ে বেশি আয়োজন রয়েছে জীবন দক্ষতার (ষরভব ংশরষষ) প্রয়োজনীয় বিষয় শেখার। এ যেন জার্মান শিক্ষাবিদ ফ্রেডরিক ফ্রোয়েবেল ‘কিন্ডারগার্ডেন’ কনসেপ্টের এর প্রকৃত বাস্তবায়ন। বিশাল উন্মুক্ত চত্বরের একপাশে রয়েছে দোতলা একটি ভবন যেখানে প্রত্যেক শিশু-শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে একটি নির্দিষ্ট ক্যাবিনেট (ড্রয়ার), যেখানে তাদের ড্রেস-জুতো এবং আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিস মজুদ থাকে। এর ব্যবস্থাপনা শিশুরাই করে থাকে। স্কুলে এসে শিশুরা নিজেদের পছন্দমতো চেঞ্জ করে খেলতে নামে। অর্থাৎ এখান থেকেই শিশু নিজের প্রয়োজনীয় কাজ যেমন নিজেই করতে শেখে, তেমনি নিজে নিজে সিদ্ধান্তও নিতে শিখে যায়। কাদা-জলে হুটোপুটি থেকে শুরু করে বালি দিয়ে প্রাসাদ তৈরি কোনো কিছুই এখানে বারণ নেই। তারা মনের আনন্দে প্রাতিষ্ঠানিক প্রাথমিক পাঠ শেখে, শেখে পরিবেশ-প্রকৃতির প্রতি যতœ আর ভালোবাসা, শেখে সামাজিকতার চর্চা, অন্যের প্রয়োজনে এগিয়ে যাওয়া আর ভালো-মন্দের বিভেদ।

বিদ্যালয় চত্বরটি বেশ বড়ো, কর্তৃপক্ষ এটি ঘুরে দেখানোর জন্য আমাদের একজন গাইড দিয়ে ছিলেন। যিনি একজন রাশান, যার বয়স ছয় কি সাত হবে নাম মাশা। সে একদম প্রফেশনাল গাইডের মতো আমাদের বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম ঘুরিয়ে দেখালো, তার জানার পরিধির মধ্যে থেকে প্রতিটা বিষয়ের ব্যাখ্যাও দিল। আমি অন্য কিছু দেখবো কি পুরোটা সময় আমি শুধু তাকেই দেখে গেলাম। এতটুকু একটা মেয়ে শিশু কিন্তু তার ম্যাচুরিটি দেখার মতো। বিস্ময়ের ঘোরে থেকে ঘণ্টা পার করে ফেললাম, এরপর বিদায়ের পালা। বিদায়ের আগে মাশার সাথে ছবি তুলতে ভুললাম না। [চলবে]