দাদু যখন কাঁথা সেলাই করতেন কোনোদিন তার ধারে কাছেও বসিনি। কীভাবে দাদু কাপড় কেটে সেই কাপড়ে নানা রঙের নকশা এঁকে সূচ দিয়ে নানা রঙের সুতার কাজে চমৎকার নকশিকাঁথা গড়ে তুলতেন কোনোদিন তা শেখার চেষ্টা করিনি। বরং কখনো দাদু সুচে সুতা লাগিয়ে দিতে বললে ‘পারব না’ বলে দৌড়ে চলে যেতাম। আমি খুব দুরন্ত আর ডানপিটে ছিলাম কিনা।
মা বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর দাদুর আমি ছাড়া কেউ ছিল না। আর আমারও দাদু ছাড়া কেউ ছিল না। তাই তো দাদু আদর দিয়ে বাঁদর বানিয়েছে আমাকে- একথা পাড়া প্রতিবেশীদের কাছ থেকে নিত্য শুনে থাকি। তবে, তারা ভুল বলেনি। আমার নামে কত যে কমপ্লেইন শুনতে হতো দাদুর। একজন বলত, আপনার নাতনি আমার মটর ক্ষেতের মটরলতা নষ্ট করেছে। কেউ বলত, দেখে এসোগে তোমার আইবুড়ো নাতনি পাড়ার ছেলেদের সাথে ব্যাটমিন্টন খেলছে। আবার কেউ কেউ বলত, আপনার নাতনি ঘরের মধ্যে কম্পিউটারে কী দেখে তার খবর রেখেছেন ? দিনকাল কিন্তু ভালো না। কেউ বলত, আহারে এত ভালো পরিবারের মেয়ে এত ভালো মানুষের মেয়ে, ভালো মানুষের নাতনি! কী আর বলব একেবারে উচ্ছন্নে গেল।
আমার দাদু তাদের কথা শুনে নীরব থাকতেন। আমাকে কোনোদিন কিচ্ছু বলেননি। কারো কথার জবাবও দেননি।
একদিন একজন এসে বলল, তোমার বনলতা আমার গাছের কাঁঠাল চুরি করেছে।
সেদিন আন্টি আমার নামে দাদুর কাছে দুর্নাম করতে গিয়ে ভুল করে ফেলল। সারাগ্রামের সকলে জানে আমি কাঁঠাল একদম পছন্দ করি না। যাহোক, দাদু সেদিন একটু হাসলেন। তারপর বললেন, কাঁঠালের দাম কত ?
আন্টি কিছু না বলে চুপচাপ চলে গেলেন। আমি কাছেই ছিলাম। বললাম, দাদু, আমি খুব খারাপ তাই না! এই খারাপ একটা বনলতার জন্য তোমাকে কত কষ্ট করতে হয়। পরিশ্রম করে কাঁথা সেলাই কর। নিজের মান-সম্মানের কথা ভুলে গিয়ে সেই কাঁথা কত কষ্ট করে দোকানে দোকানে পৌঁছে দাও। আচ্ছা দাদু, আমার তো তেমন কোনো চাহিদা নেই। আমাদের যেটুকু আছে চলে যাবে কোনোরকমে। তুমি কাঁথা সেলাই করা বাদ দাও।
দাদু পরম আদরে আমায় কাছে টেনে নিলেন। বললেন, আমার খারাপই ভালো। খারাপ আছে আমার আছে তা মানুষ যে যাই বলুক। আর শুন, বেশি পাকা পাকা কথা একদম বলবি না। তুই যতই আইবুড়ো হোস-না-কেন বয়স তো তের বছর। আর কাজ করা ভালো সে যে কাজই হোক। নকশিকাঁথা সেলাই জানা একটা এক্সট্রা কারিকুলাম। তাই তো কলেজ থেকে রিটায়ার্ড করার পরপরই আমি এ কাজে মন দিয়েছি। আমার খুব শখের কাজ এটা। এটাও একধরনের সৃজনশীলতা। কতদিন পারব জানি না। জীবনে টাকা পয়সার গুরুত্ব কি কম ? ক’দিন আছি তার ঠিক নেই।
আমি চোখ বুঁজলে তুই যে বড়ো একা হয়ে যাবি। তোর জন্য আমি ছাড়া ভাবার যে কেউ নেই। টাকা পয়সার সমস্যাটা না থাকলে অনেকটা সমস্যা কমে যায়। তোর জন্য কিছু টাকা জমানোর চেষ্টা করছি। আচ্ছা কম্পিউটারের ক্লাসগুলো ঠিকমতো করছিস তো।
-হ্যাঁ করছি।
-দু’বছর পার হলে তুই এসএসসি পাস করবি আর ইনকামও শুরু করবি ইনশাআল্লাহ।
-ইনকাম ?
-হ্যাঁ রে, যতই টাকা থাকুক যেদিন থেকে তুই ইনকাম শুরু করবি। সেদিন আমি অনেকটা হালকা হব। নিশ্চিন্ত হব। এখন কম্পিউটারে ক্লাসগুলো করছিস তো! ইনকাম করতে কোনো অসুবিধা হবে না। একদিকে পড়াশোনা অন্যদিকে ঘরে বসে অনলাইনে ইনকাম। মজার ব্যাপার না ?
-তুমি তো সব সময় একই কথা বল। সাঁতার শিখতে গিয়ে, ড্রাইভিং শিখতে গিয়ে এমন কম কিছু তো শেখাওনি সবসময় তোমার ওই একই কথা- হালকা হব। শেষে তুমি হালকা হতে হতে একসময় যদি তুমি উড়ে যাও তখন আমি কী করব ?
-ওরে দুষ্টু !
-আচ্ছা দাদু তুমি তো আমাকে কখনো বলনি এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। কিন্তু তোমার ইচ্ছেটা বুঝতে পারলেই আমি সে কাজটা করি। কেন বল তো। তুমি কি ম্যাজিক জানো !
-ভালোবাসা ভালোবাসা। আমার সোনা আপুমণি আমাকে কতটা ভালোবাসে তাতো সে নিজেও জানে না।
-এত কিছুর পরও আমি তো বাঁদরই রয়ে গেলাম তার কী হবে ?
-আমার বাঁদরই ভালো।
-এই দাদু তুমি এত ভালো কেন ? তোমার মনটা ঐযে আকাশ, ওর মতো। তোমার মনটা আসলে আসমানি রঙের।
-মনের বুঝি আবার রং থাকে ?
-হ্যাঁ থাকে তো। যেমন তোমার মন আসমানি রঙের।
-আর তোর মন কি রঙের ?
-তা তো জানি না। আচ্ছা এবার অন্য কথা বলি। দাদু তুমি কি চাও আমি কাঁথা সেলাই শিখি।
-আমি কিছু চাই না। তোর যা ভালো লাগবে তাই করবি। তবে, তুই শিখলে আমার ভালো লাগবে।
-এবার কে দুষ্টুমি করছে ? মনে মনে চাও মুখে বলবে না।
-না। কোনো দুষ্টুমি করছি না। আমি শুধু তোর ভালো চাই।
সেদিন রাতে দাদুর গলা জড়িয়ে ঘুমালাম। মধ্যরাতে দাদুর বুকে ব্যথা। দাদু কষ্টে অস্থির। ঘেমে সারাশরীর ভেজা। আমি পরিচিত ড. আঙ্কেলকে ফোন করলাম। ফজরের আজান হলো। খুব কষ্ট করে নামাজ পড়লেন। বললেন নামাজ পড় বোন, আমার জন্য দোয়া কর। আমি তোকে একলা রেখে যেতে চাই না। দাদুর জন্য দোয়া করলাম। দাদুও জায়নামাজে। চোখের পানিতে দু’জনের বুক ভিজে গেল। দাদু আমার কোলের উপর মাথা রাখলেন। আমার হাত ধরে বললেন, আমার বনলতা সেন। আমার সোনা, মন শক্ত কর বোন। তোকে আত্মরক্ষার কৌশল শিখিয়েছিলাম, সেসব ভুলে যাস না। জীবনে কাজে লাগবে। যদি চাস আমি যা করতাম তাই করিস ঠকবি না। আমার ডায়েরির দু’নম্বর পাতায় আমার এক ছাত্রীর নম্বর আছে। তোর কাজে লাগবে। আমার জন্য দোয়া করিস বোন। আমার সময় নেই।
দাদু আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন।
আমার শুধু আফসোস, দাদু মনে কষ্ট নিয়ে চলে গেলেন। তার আদরের বনলতাকে একা রেখে চলে যেতে তার যে কতটা কষ্ট হয়েছে তা আমি একটু হলেও বুঝেছি। শুধু সেজন্যই কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। অনেক কষ্টে দাদুর ছাত্রীকে খবরটা জানালাম।
দাদুর ছাত্রী বকুল চৌধুরী। খুব ভালো মানুষ। তিনি চোখের পানি মুছে বললেন, ম্যাডাম আপনি সারাজীবন আমার উপকার করেছেন। আজও চলে যাওয়ার সময় আমার নিঃসঙ্গ জীবনে, আমার আঁধার ঘরে আলো জ্বালিয়ে গেলেন।
***
বকুল আন্টির সাথে কেটে গেল একযুগ। দাদুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমি অনেক পরিশ্রমী, নামাজি, পর্দানশীল এবং রোজগারি হয়েছি। দাদুর ইচ্ছে অনুযায়ী আমি এসএসসি পাস করেই আয় করতে শুরু করেছি।
পড়াশোনা করে এখন আমি চার্টারড সার্টিফাইড একাউন্টট্যান্ট। দাদুর নকশিকাঁথার সম্মান দিতে নিজে কাঁথা সেলাই করা, নকশা আঁকা সব কিছু শিখেছি। এখন আমার একটি বিশাল বড়ো নকশিকাঁথার কারখানা আছে। সেখানে হাজারো অসহায় নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। এই নকশিকাঁথা দেশ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। দুঃখ একটাই, আমার দাদু এসব কিছু দেখল না। সুখ পাই এই ভেবে যে, আমি দাদুর ইচ্ছে পূরণ করতে পেরেছি। তবে আল্লাকে বলেছি, জান্নাতে দাদু আর আমি একজায়গায় থাকতে চাই। তখন না হয় দাদুর কাছে সব গল্প করব।
এদিকে আমার বকুল আন্টি, তার মনও কিন্তু আসমানি রঙের, দাদুর মতো। আমার জীবনের সকল কাজের অনুপ্রেরণা, সাহায্য এই দুইজন মানুষের। আর এরা আমার জীবনের ভালোবাসা। সমস্যা হলো আন্টি এখন আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আমিও বলে দিয়েছি, তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। যদি যেতে হয় তোমাকে সাথে নিয়ে যাব। আর আমার এমন একজনকে চাই যার আসমানি রঙের মন আছে। হ
অলঙ্করণ : স্ব. সরকার