“জীর্ণ-পুরাতন যাক ভেসে যাক
আমরা শুনেছি ঐ, মাভৈ মাভৈ মাভৈ ...
কোন নূতনেরই ডাক।”
নতুনের আবাহনকে আলিঙ্গন করা, একঘেঁয়ে প্রথা, কুসংস্কারকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার বাসনায় রবীন্দ্রনাথ ভরসা রাখতেন নবীনদের ওপর। তাই ‘তাসের দেশে’র এই নবীনেরা নিজদের পরিচয় দেয় এভাবে : “আমরা চঞ্চল, আমরা অদ্ভুত/আমরা নূতন যৌবনেরই দূত।” এই সেদিন স্কলাসটিকার শিক্ষার্থীরাও মঞ্চে উঠে সেই উদ্দমের কথাই সুরে সুরে বলে গেল : “তুমি কষে ধরো হাল, আমি তুলে বাঁধি পাল/ হাই মারো, মারো টান হাঁইয়ো, হাঁইয়ো, হাঁইয়ো।”
স্কলাসটিকা স্কুলের মিরপুর শাখার শিক্ষার্থীরা নতুনরূপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তাসের দেশ’ মঞ্চায়ন করল তাদের বার্ষিক নাট্যোৎসবের আয়োজনে। ৩দিনব্যাপী এই নাটকের প্রদর্শনী হয় ৫ ও ৬ অক্টোবর স্কলাসটিকার নিজস্ব এসটিএম মিলনায়তনে। এছাড়া বিশ্ব শিশুদিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ ২০২৩ উপলক্ষে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আয়োজিত শিশু নাট্যোৎসবের পঞ্চম দিনে স্কলাসটিকা ‘তাসের দেশে’র তৃতীয় মঞ্চায়নটি করে ৭ অক্টোবর শিশু একাডেমি মিলনায়তনে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত নাটক ‘তাসের দেশ’-এ নতুনের প্রতিনিধিত্ব করে রাজপুত্র। রাজবাড়ির জৌলুস, প্রাচুর্য, বাধা ধরা নিয়ম, নিশ্চয়তা সব কিছু বড়ো মেকি লাগে রাজপুত্রের। প্রাণের বিকাশ যেন সেথায় বন্ধ। তাই সে মুক্তির আশায় পাড়ি জমায় নতুন রাজ্যেÑ দেখা মেলে আরো এক আজব দেশের আজব প্রাণীদের সঙ্গে যাদের নাম : ছক্কা, পঞ্জা, ইস্কাবনী, টেক্কানী এইসব। আর সেই দেশের নাম তাসের দেশ। রাজপুত্র এসে তাদের মুক্তির বাণী শোনায়, শৃঙ্খল ভেঙে নতুন কিছু সৃষ্টি করার সাহস জোগায়।
রবীন্দ্রনাথের তাসের দেশ মূলত একটি রূপকধর্মী নাটক। ছোটোদের নাটক হিসেবে জনপ্রিয় হলেও এর মর্মার্থ মোটেও ছোটোখাটো নয়। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষ যখ ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচারে পদদলিত, তখন রবীন্দ্রনাথ এই নাটকের মাধ্যমে মুক্তির আকাক্সক্ষাকে জাগিয়ে তুলতে এ নাটক লেখেন। আর তাই সংলাপের সঙ্গে সঙ্গে এই নাটকে রয়েছে সংগীতের প্রাধান্য যেন সুরে সুরে মানুষের মর্মে এসে লাগে মুক্তির বাণী।
তিনদিনের নাট্যোৎসবে শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের সম্মিলনে মিলনায়তন ছিল উৎসবমুখর। অনুষ্ঠানের প্রথম দিনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শাহজাদপুর রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. শাহ আজম। নাটক দেখে আপ্লুত জনাব আজম তার বক্তব্যে বলেনÑ আজ আমি নির্দ্বিধায় এই কথা বলতে পারি যে, এই শিক্ষার্থীদের হাতে আগামীর বাংলাদেশ নিরাপদ। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিনে প্রধান অতিথি অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা শিক্ষার্থীদের এই প্রযোজনার ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘এরা রবীন্দ্রনাথের গানের বদলে আধুনিক গান ও এসময়ের গানের ব্যবহার করে যেভাবে ফিউশন করেছে তা সত্যি অপূর্ব। নাটকের মুহূর্তের সঙ্গে দারুণভাবে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তো প্রথা ভাঙার পক্ষেই কথা বলেছেন। গানের দলে শিক্ষার্থীরা কী সুন্দর গেয়েছে ! সব মিলিয়ে প্রফেশনাল একটা থিয়েটার পারফর্মেন্স দেখার অভিজ্ঞতা হলো।’ তৃতীয় দিনে শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান, নাট্যব্যক্তিত্ব লাকী ইনাম নাটক দেখে বলেন, ‘আমি মুগ্ধ, বিমোহিত। শিশু-কিশোরদের চমৎকার একটি প্রযোজনা দেখলাম আজ। আমি মঞ্চের মানুষ, থিয়েটারের মানুষ। যারা মঞ্চে সাহস করে ওঠে, সংলাপ বলে, সত্যের জয়গান গায়, সুন্দরের জয়গান গায়, আমি তাদের দলে। ‘তাসের দেশ’ একটি কঠিন নাটক, আমি প্রায়ই এই নাটকটি পড়ি, এটা আমার অনেক প্রিয় একটি নাটক। এই কঠিন নাটককে যিনি ছোটো করে, শিশুদের উপযোগী করে মঞ্চে উপস্থাপন করেছেন তা সত্যি অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথ সংলাপগুলোতে বলেন, পুরাতনকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। নতুনের জয়গান গাইতে হবে। সুন্দর সুন্দর নীতি, মানুষের জন্য কল্যাণকর নীতিগুলো আনতে হবে। স্কলাসটিকার প্রিন্সিপালকে ধন্যবাদ,Ñ শুধু পড়ো পড়ো পড়ো নয়, সেইসঙ্গে নাটক করোÑ এই দীক্ষা তিনি শিক্ষার্থীদের দিয়েছেন এই জন্যে।’
শিশু একাডেমির মহাপরিচালক আনজীর লিটন কস্টিউম, সংগীত, নৃত্য এবং অভিনয়শিল্পীদের প্রশংসা করে উৎসাহিত করেন এবং বলেনÑ “আমরা মনে করি ‘তাসের দেশে’ রবীন্দ্রনাথ যে কথা বলেন, তেমনি আমাদের সুন্দর ইচ্ছেরও যেন জয় হয়।”
স্কলাসটিকা মিরপুর শাখার প্রিন্সিপাল নুরুন নাহার মজুমদার শিশু একাডেমিকে ধন্যবাদ জানান তাদের মিলনায়তনে স্কলাসটিকার শিক্ষার্থীদের অভিনয় করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।
লেখা : ধীমতি শুচিস্মিতা
তাসের দেশ
নির্দেশনা : সানী ঘোষ রবি
সংগীত পরিচালনা : শুভ কর্মকার
নৃত্যপরিচালনা : শাম্মী ইয়াসমিন ঝিনুক ও তানজিলা মেঘলা
পোশাক পরিকল্পনা : তানজিলা মেঘলা
মঞ্চ ও দ্রব্য সামগ্রী : জাকিয়া খান, রোখসানা সুলতানা এবং শিক্ষার্থীবৃন্দ
অভিনয় : বর্ণিল মূর্ছনা, অনন্যা অদ্রী যারা, নুসাইবা নাশিতা রহমান, তাজিন তাজোয়ার, মাহাদী হাসান মুহিত, স্বাগতা ভৌমিক রায়, নুহা নাজনীন, তাওহীদ সরকার, আদ্রিয়ান প্রাঞ্জল, আব্দুল্লাহ আল রাফি প্রমুখ
নৃত্য : দিয়ান্থা সরকার, জায়রা রহমান, মালিহা হাসান, মুবাশ্বেরা, তাজমিন, নাহরিন প্রমুখ
সংগীত : রাইসা নানজিবা, আদৃতা, তানুসিয়া, লাবিবা, সামারা, রাইকা, রাঈসা, রিদম, রিফা, জাহিন, আহানাফ প্রমুখ