আড়াইশ’ বছর পুরনো বলিহার রাজবাড়ি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন : মোশাররফ হোসেন

29 Sep 2025, 03:09 PM অন্যান্য শেয়ার:
আড়াইশ’ বছর পুরনো বলিহার রাজবাড়ি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন : মোশাররফ হোসেন

বাংলাদেশের বরেন্দ্র অঞ্চলের নওগাঁ জেলার সদর উপজেলার বলিহার ইউনিয়নে ‘বলিহার রাজবাড়ি’টি অবস্থিত। বলিহারি জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা নৃসিংহ চক্রবর্তী মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে বলিহার এলাকায় জায়গির লাভ করেন। নৃসিংহ চক্রবর্তী ও তার বংশের পরবর্তীজমিদারগণ স্থানীয়দের নিকট রাজা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। একারণেই বলিহার জমিদারবাড়িটিও ‘রাজবাড়ি’ হিসেবে পরিচিতি পায়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতা দখলের পর লর্ড কর্নওয়ালিসের শাসনামলে ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে জমিদারি প্রথা শুরু হলে নৃসিংহ চক্রবর্তীর পরবর্তীবংশধর শ্রীযুক্ত রাজেন্দ্রনাথ রায়বাহাদুর জমিদারি লাভে সক্ষম হন। অনেকেই তাকে বলিহারের প্রথম রাজা বা জমিদার বলে থাকেন। বলিহারের জমিদারেরা মোঘল ও ব্রিটিশ শাসকদের আস্থা অর্জন করেছিলেন। নৃসিংহ চক্রবর্তী জায়গির লাভের পর শাসনকার্য পরিচালনা ও বসবাসের জন্য যেসব স্থাপনা নির্মাণ করেছিলেন সেসব স্থাপনা কালের আবর্তে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে গিয়েছে। বলিহার রাজবাড়ির দৃশ্যমান প্রাচীন স্থাপনাগুলো ইংরেজ শাসনামলে নির্মিত। বর্তমান ইমারতগুলো দুইশত থেকে আড়াইশত বছর প্রাচীন। 

বলিহার জমিদার সকলেই ধর্মপরায়ণ, শিক্ষিত ও প্রজাহিতৈষী ছিলেন। প্রজাকল্যাণে রাস্তাঘাট তৈরি, দিঘি খনন, মন্দির ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন। বলিহারের জমিদারদের মধ্যে শ্রীযুক্ত রাজেন্দ্রনাথ রায়বাহাদুর ধর্মপরায়ণ ও সুশাসক ছিলেন। তিনি ১৮২৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজবাড়ি আঙিনায় রাজেশ্বরী দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মন্দিরের মধ্যে রাজেশ্বরী দেবীর একটি পিতলের মূর্তি স্থাপন করেছিলেন। শ্রীযুক্ত রাজেন্দ্রনাথ রায় বাহাদুরের পর বলিহারের রাজা হন শ্রী কৃষ্ণন্দ্রনাথ রায় বাহাদুর। তিনি একজন লেখক ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে কৃষেন্দ্র গ্রন্থাবলির প্রথম ও দ্বিতীয় খ- নওগাঁ জেলা প্রশাসনে সংরক্ষিত রয়েছে। রাজা শ্রী কৃষ্ণন্দ্রনাথ রায় বাহাদুরের মৃত্যুর পর রাজা হন কুমার শ্রীযুক্ত শরদিন্দু রায়বাহাদুর। এরপর বলিহারের রাজা হন শ্রীযুক্ত বিমেলেন্দু রায়বাহাদুর। তিনি ছিলেন বলিহারের শেষ জমিদার। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে উপমহাদেশ ভাগের সময়ে রাজকর্মচারীদের


হাতে রাজবাড়ির দায়িত্ব দিয়ে তিনি ভারতের কলকাতায় চলে যান।

রাজবাড়ির আঙিনার পশ্চিম প্রান্তে প্রাসাদভবনটির অবস্থান। পূর্ব দিকে মুখ করা দোতলা প্রাসাদভবনটি তিন ফুট উঁচু প্লাটফর্মের উপর নির্মিত। নিচতলার পূর্ব পাশে ভবনে ঢোকার পর খোলা বারান্দা, অতিথিদের গোলাকৃত বসবার কক্ষ ও ভবনের ভেতরে ঢোকার জন্য করিডোর রয়েছে। নিচতলার সম্মুখভাগের খোলা বারান্দা, করিডোর ও অতিথিদের বসবার ঘরের মেঝেটি মোজাইক করা। নিচতলায় ভবনটির সামনে চারটি অষ্টভূজ গোলাকৃত পিলার রয়েছে। প্রাসাদভবনের ভেতরে চারদিকে কক্ষ ও কক্ষের সামনে টানা বারান্দা রয়েছে। ভবনের মাঝখানটায় খোলা জায়গা নিচতলার ভবনের উত্তর ও দক্ষিণে তিনটি করে আয়তকার কক্ষ রয়েছে। পশ্চিম দিকের নিচতলায় দু’টি কক্ষ রয়েছে। ভবনটিতে উপরে ওঠার জন্য একাধিক সিঁড়ি রয়েছে।

প্রাসাদভবনের দোতলার পূর্বদিকে আয়তকার প্রশস্ত বৈঠকখানা রয়েছে। বৈঠকখানার দুই পাশে ছোটো দু’টি কক্ষ এবং সংযুক্ত খোলা বারান্দা রয়েছে। বারান্দার সম্মুখভাগে চারটি গোলাকৃত জোড়া পিলার দোতলা থেকে ছাদে গিয়ে মিশেছে। প্রাসাদভবনের ভেতরে উত্তর ও দক্ষিণ পাশে তিনটি করে আয়তকার কক্ষ রয়েছে। দুই পাশের মাঝের কক্ষটি বেশ বড়ো। দক্ষিণ পাশের বড়ো কক্ষের সাথে ঝরখা বারান্দা [ভবনের দেয়াল থেকে বাইরের দিকে বর্ধিত বারান্দা] রয়েছে। এটি রাজার শয়নকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। রাজবাড়ির কক্ষগুলোর দরজা ও জানালায় ব্যবহৃত নকশাখচিত কাঠের পাল্লা ও খিলানের রঙিন কাচ বলিহারের জমিদারদের রুচি ও ঐশ্বর্যের পরিচয় বহন করে। দোতলার অপর পাশের বড়ো কক্ষটি ডাইনিং হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রাসাদভবনটির নিচতলায় ১৭টি এবং দোতলায় ১২টি কক্ষ ছিল। দোতলার টানা লম্বা বারান্দার চারদিকে ২৮টি গোলাকৃত লোহার পিলার [খাম] ও কাঠের তৈরি রেলিং রাজবাড়ির নিরাপত্তা ও সৌন্দর্য বজায় রাখত। লোহার পিলারগুলো অক্ষত থাকলেও কাঠের রেলিং এখন আর নেই। প্রাসাদভবনের সম্মুখের দিকে বসবাসের জন্য দুইপাশে ইট-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি গোলাকৃত আসন রয়েছে। আসন দু’টি বিশ শতকের শুরুর দিকে নির্মিত।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের পরিত্যক্ত বলিহারি রাজবাড়ির প্রাসাদভবনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দুই যুগ রাজবাড়ির প্রাসাদভবনটিতে বিদ্যালয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এছাড়াও পূজাম-পের গেইটসংলগ্ন ভবনটিতে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিন বছর বলিহার ডিগ্রি কলেজের কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।

বলিহার রাজবাড়ির প্রাসাদভবনের উত্তর পূর্ব দিকে শ্রী শ্রী রাজেশ্বরী দুর্গামন্দির। মন্দিরের পূর্ব দিকে বিশাল প্রবেশদ্বার রয়েছে। প্রবেশদ্বারের দুই পাশে দু’টি শিবমন্দির দাঁড়িয়ে আছে। শিবমন্দির দু’টির দেয়ালে দেবদেবী ও পদ্মফুলের নকশা করা। শিবমন্দিরের গম্বুজের চূড়ায় একসময়ে পিতলের তৈরি কলসি শোভা পেত। এখন পিতলের তৈরি কলশি দু’টি নেই।

রাজেশ্বরী দুর্গামন্দিরের চারদিকে একতলা ভবন এবং মাঝখানে খোলা জায়গা। একতলা ভবনে মোট ৯টি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে ৫টি কক্ষে দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে। রাজেশ্বরী দুর্গামন্দিরটিতে শুধু রাজপরিবার ও তাদের আত্মীয়স্বজন পূজা দিতে পারতেন।

রাজেশ্বরী দূর্গামন্দিরের উত্তর-পূর্ব দিকে রয়েছে কৃষ্ণকালিমন্দির। ১৩৬ বছর পূর্বে ১২৯৬ বঙ্গাব্দে [১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে] কৃষ্ণকালি মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ৪টি নকশাখচিত পিলার মন্দিরটির সামনের অংশকে নান্দনিক করে তুলেছে। রাজেশ্বরী দুর্গামন্দিরের পূর্ব দিকে এবং কৃষ্ণকালিমন্দিরের দক্ষিণ দিকে ছিল নাটমন্দির। পুরানো নাটমন্দিরটি এখন আর নেই। এখন সেখানে নতুন করে নাটমন্দির নির্মাণ করা হয়েছে। নাটমন্দিরের দক্ষিণ পাশে ছিল দোতলা ভবন ও কাঠের তৈরি হাজার দুয়ারী হাওয়াখানা। হাজার দুয়ারি হাওয়াখানা ও দোতলা ভবনটি কালের আবর্তে ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে, ভবনটির দোতলায় ওঠার প্রশস্ত সিঁড়ি ও দেয়ালের কিছু অংশ এখনো বর্তমান। এই দোতলা ভবনের দক্ষিণ পাশে ছিল আরো একটি দুর্গামন্দির। এই দুর্গামন্দিরটি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। দুর্গামন্দিরটিতে সর্বজনীন দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হতো।

হাজার দুয়ারি হাওয়াখানা ও দুর্গামন্দিরের পূর্ব পাশে ছিল গোপালমন্দির। মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ এখনো রয়েছে। ধ্বংসাবশেষ দেখে ধারণা করা যায়, হাজার দুয়ারি হাওয়াখানা ও গোপালমন্দিরটি দুই থেকে আড়াই শত বছর প্রাচীন।

বলিহার রাজবাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রয়েছে রানির দিঘি। দিঘির চারদিকে একসময়ে দেয়ালের বেষ্টনী ছিল। রানি ও রাজপরিবারের মেয়েরা এই দিঘিটি ব্যবহার করতেন। প্রায় দেড়শত বছর পূর্বে রানির দিঘিতে ইস্পাতের নির্মিত একটি সিঁড়ি স্থাপন করা হয়েছিল। ইস্পাতের এই নান্দনিক সিঁড়িটি এখনো ভালো অবস্থায় অক্ষত রয়েছে। রাজবাড়ির পশ্চিম দিকে ছিল বাগান। সেই বাগানে ফুল-ফলসহ নানা রকম গাছ শোভা পেত। এখনো হলুদ রঙের দুর্লভ প্রজাতির বাঁশঝাড়ের কিছু অংশ টিকে আছে। জনশ্রুতি রয়েছে, শেষ জমিদার শ্রীযুক্ত বিমলেন্দু রায়ের স্ত্রী লন্ডন থেকে এই হলুদ বাঁশের চারামূল এনে রোপণ করেছিলেন।

বলিহার রাজবাড়িতে তিনবার হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর হয়। প্রথমবার ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষ বিভক্তির সময়ে, দ্বিতীয়বার ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে এবং ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের আক্রমণে রাজবাড়িটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের আক্রমণে ব্যাপক ভাংচুর ও লুটপাট হয়। এই আক্রমণের সময়ে রাজবাড়ির রাজেশ্বরী দুর্গামন্দিরে রক্ষিত পিতলের দুর্গামূর্তি এবং শিবমন্দিরের চূড়ায় পিতলের কলশি দু’টি খোয়া যায়। তখন থেকেই ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ৪৬ বছর রাজেশ্বরী দুর্গামন্দিরে পূজা বন্ধ ছিল। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বলিহার রাজবাড়িতে আক্রমণ করে ২৬ জন লোককে হত্যা করেছিল।

প্রতœতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের অধীনে নাওগাঁ জেলার বলিহার রাজবাড়ি বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন হলেও প্রাসাদভবনটি উপযুক্ত যতেœর অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। প্রাসাদভবনসহ কয়েকটি ভবনের জানালা, দরজা, দেয়াল ও মেঝের ইট, ছাদের ভার বহনের কাঠ ও লোহা প্রতিনিয়ত চুরি হয়ে যাচ্ছে।

লেখক : গবেষক, লেখক ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান নির্মাতা