গান মানে শুধু বিনোদন নয়, বরং একধরনের সাধনা : রাবেয়া আক্তার

29 Sep 2025, 03:11 PM সারেগারে শেয়ার:
গান মানে শুধু বিনোদন নয়, বরং একধরনের সাধনা : রাবেয়া আক্তার

বাংলা গানের ভুবনে রবীন্দ্রসংগীত এক সমৃদ্ধ ধারা। রবীন্দ্রসংগীতের জগতেই নিজের অবস্থান তৈরি করেছেন শিল্পী রাবেয়া আক্তার। গান তার ধ্যানজ্ঞান, জীবনচর্চা ও আত্মিক সাধনা। রবীন্দ্রনাথের গানে তিনি খুঁজে পেয়েছেন জীবনের আসল মন্ত্র। তিনি বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের রবীন্দ্রসংগীতে বিশেষ গ্রেডের শিল্পী হিসেবে নিয়মিত সংগীত পরিবেশন করেন। দেশ ও দেশের বাইরে অনেক মঞ্চেও নিয়মিত গান পরিবেশন করেন তিনি। আনন্দভুবনের সারেগারে আয়োজনে রাবেয়া আক্তারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন শহিদুল ইসলাম এমেল...


আনন্দভুবন : কেমন আছেন।

রাবেয়া আক্তার : আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।

আনন্দভুবন : আপনি তো রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে বসবাস করেন। রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে আপনার মেলবন্ধনটা কতদিনের ?

রাবেয়া আক্তার : রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে মেলবন্ধনের আগে বলতে হবে, সংগীতের সঙ্গে আমার মেলবন্ধন কীভাবে হলো সেই কথা। খুব ছেলেবেলা থেকেই গান আমার জীবনের সঙ্গী। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই আমি গান গাইতাম, যদিও তখন আনুষ্ঠানিকভাবে শেখা হয়নি। আমাদের গাজীপুরের গ্রামের বাড়িতে একটি ব্যাটারি চালিত রেডিও ছিল। তখন বাংলাদেশ বেতারে খুব সুন্দর সুন্দর বাংলা গান বাজত। রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিনসহ বিখ্যাত শিল্পীদের গান বাজত। সেগুলো শুনে শুনেই গান শিখতে শুরু করি। তখন তো বোঝার বয়স হয়নি। গানগুলো শুনে শুনে আমি গেয়ে ফেলতাম। এরপর স্কুলে যাওয়ার বয়স হলো। আমার বড়ো ভাইবোনদের সাথেই স্কুলে যেতাম। তখন এখনকার মতো ভর্তির বিষয় ছিল না। বয়স হলে স্কুলে চলে যেতাম। আমাদের গ্রামে তখন বিদ্যুতের সরবরাহ ছিল না। বাড়িতে এলো ব্যাটারিচালিত একটি সাদাকালো টেলিভিশন। তখন টেলিভিশনে ছোটোদের গান শেখার আসরটা আমি নিয়মিত দেখতাম। ওখান থেকেও আমি শিখেছি। সেই সময় থেকেই আমার একটু একটু করে রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি ভালো লাগা বাড়তে থাকে। তখন সবধরনের গানই গাইতাম। পরে রবীন্দ্রনাথের গান শিখি এবং এটাকেই বেছে নিই চর্চার জন্য।

আনন্দভুবন : কেন বেছে নেন ?

রাবেয়া আক্তার : স্কুলে জাতীয়সংগীত, শপথবাক্য আর নামতা পড়ানো হলো। স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি যারা এসএসসি পরীক্ষা দেবে তাদের বিদায় অনুষ্ঠান। ক্লাসে কে কে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবেন তাদের হাত তুলতে বললেন শিক্ষকেরা। আমি না বুঝেই হাত তুলেছিলাম। পরে শিক্ষকেরা আলাদা করে আমার গান শুনলেন। প্রতিযোগিতার দিন প্রথম মঞ্চে গাইলাম ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’। গেয়ে মঞ্চ থেকে সুন্দরভাবে নামলাম। পরিবার, শিক্ষক এমনকি এলাকার মানুষও অভিভূত হয়েছিল। সেখান থেকেই আমার গানের যাত্রা শুরু।

সে সময়ে বড়োভাই ঢাকা থেকে বৃহস্পতিবার বাড়ি আসতেন। বাড়ির উঠানে সবাই বসে আমাকে গান গাইতে বলতেন। এমন কী নানা নানির বাড়িতে বেড়াতে গেলে ওরাও গান শুনতে চাইত। আমার যে গানের স্টক ছিল, সেগুলো থেকেই গাইতাম।

আনন্দভুবন : গান শেখার আনুষ্ঠানিক সূচনা কবে ?

রাবেয়া আক্তার : উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার পর ঢাকায় এসে ভর্তি হই বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সেখানে রবীন্দ্রসংগীতে চার বছরের সার্টিফিকেট কোর্স করি। আসলে পরিবারের উৎসাহই আমাকে রবীন্দ্রসংগীতে গভীরভাবে টেনেছিল। ছেলেবেলায় রেডিও, পরে টেলিভিশনÑ সবকিছুতেই রবীন্দ্রনাথের গান আমার কাছে আলাদা আকর্ষণ তৈরি করেছিল।

আনন্দভুবন : রবীন্দ্রসংগীতকে বেছে নিলেন কেন ?

রাবেয়া আক্তার : সেই অল্প বয়স থাকতেই বড়োভাই গীতবিতান কিনে দিয়েছিলেন। তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার বাণী আমার জীবনে আলাদা মাত্রা যোগ করে। প্রকৃতি, ঈশ্বর আর মানুষের সম্পর্ক রবীন্দ্রনাথ যে-ভাষায় বর্ণনা করেছেন, তা আমার কাছে খুব আপন মনে হয়েছে। গানের মাধ্যমে যেমন, তেমনি তার সাহিত্য পড়েও রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করেছি নতুন নতুন রূপে।

আনন্দভুবন : রবীন্দ্রনাথের গানের যে বিভিন্ন পর্যায়Ñ পূজা-প্রকৃতি-প্রেম, এর মধ্যে কোনটা আপনাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে ?

রাবেয়া আক্তার : বিশেষ কোনো পর্যায়ের কথা আলাদা করে বলা ঠিক হবে না। যেহেতু আমি রবীন্দ্রনাথের পুরোপুরি ভক্ত। যতটুকু আমি নিতে পেরেছি, সেটা বলতে গেলে খুব সামান্যই হবে। তবে, গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, প্রকৃতিপর্যায় আর পূজাপর্যায় এই দুটো বিষয়ের মধ্যে প্রচ- মিল আছে। কারণ প্রকৃতি ঈশ্বর, ঈশ্বরের মাঝেই সব। তাই আমার কাছে মনে হয় প্রকৃতি ও পূজাপর্যায়ের মধ্যে একধরনের গভীর যোগ আছে। প্রকৃতি মানেই তো ঈশ্বর, আর সেই ঈশ্বরকেই রবীন্দ্রনাথ সর্বত্র খুঁজে পেয়েছেন।

আনন্দভুবন : রবীন্দ্রসাহিত্যও কি আপনাকে টেনেছে ?

রাবেয়া আক্তার : অবশ্যই। গান ছাড়াও তার উপন্যাস ও প্রবন্ধ আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছে। শুধু গান নয়, আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, সে-সময় কিন্তু গ্রামে বই পাওয়া যেত না। গ্রামে কোনো লাইব্রেরি ছিল না। কারো কাছে বই থাকলে ওটা আমরা নিয়ে এসে পড়তাম। আমার আবার স্কুল ছাড়া কোথাও যাওয়ার সাহস হতো না। আমি একদিন লক্ষ্য করলাম বাবার কাছে রবীন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাস। বাবার সাথে আমাদের খুব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। বাবাকে বললাম, বাবা, আমি এই বইটা পড়বো। বাবারও তখন পড়া শেষ হয়নি। বাবা বললেন, ‘আচ্ছা পড়ো।’ মুহূর্তের মধ্যেই পড়ে শেষ করে ফেললাম। আমি কি বুঝেছি কিছুই জানি না। আমি পড়েছি ক্লাস ফাইভে থাকতে। এটা আবার আমি ক্লাস টেনে গিয়ে পড়েছি। কিন্তু ওখান থেকে তো আমি কিছু পেয়েছি। বাংলা ভাষার শব্দ, প্রকৃতির বর্ণনা- এগুলো তো ওখান থেকেই পেয়েছি। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসসমগ্র আমি বহুবার পড়েছি, বিভিন্ন বয়সে। রবীন্দ্রনাথ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র এঁদের বই পড়েছি। রবীন্দ্রসাহিত্যই কিন্তু আমাকে রবীন্দ্রনাথের গানের আরো গভীরতায় নিয়ে গেছে। একসময় শান্তিনিকেতনে পড়ার ইচ্ছা ছিল, তবে পরিবারের অনুমতি না-থাকায় যেতে পারিনি। তবুও রবীন্দ্রসংগীতের বই সংগ্রহের নেশা এখনো আছে।

আনন্দভুবন : রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে দিয়ে আপনি কি বর্ষাকে খুঁজেছেন ?

উত্তর : হ্যাঁ, খুঁজেছি। আর এটা নিছক কোনো কল্পনা নয়, বরং একেবারেই সত্যি। বর্ষা আমার খুব প্রিয় ঋতু। রবীন্দ্রনাথের গানের মতোই বর্ষা আমার কাছে শুধু প্রকৃতির রূপ নয়, বরং অনুভূতিরও উৎস।

আনন্দভুবন : কিন্তু গ্রামের মানুষ তো বর্ষায় অনেক কষ্ট পায়।

রাবেয়া আক্তার : হ্যাঁ, কষ্ট পায়, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু কষ্টের পাশাপাশি বর্ষার আরেকটা সৌন্দর্য আছে, যা আমাকে খুব টানে। বিশেষ করে বৃষ্টির শব্দÑ এই শব্দটা আমার মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগায়। আসলে এটাকে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না, শুধু অনুভব করা যায়। বর্ষার যে আবেশ, তার সাথে রবীন্দ্রনাথের গান আর প্রকৃতির সেই অদ্ভুত মেলবন্ধনÑ আমাকে বারবার মুগ্ধ করে।

আনন্দভুবন : ব্যক্তিজীবনে এখন কী নিয়ে ব্যস্ত ?

রাবেয়া আক্তার : আমি একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে প্রশাসনিক পদে কর্মরত। আগে দীর্ঘদিন বাংলা পড়িয়েছি। পাশাপাশি গান নিয়মিত করি আর শিক্ষার্থীদের গান শেখাই।

আনন্দভুবন : অবসর সময় কীভাবে কাটান ?

রাবেয়া আক্তার : বই পড়তে খুব ভালো লাগে। আবার সময় পেলে প্রকৃতির কাছে যাই। প্রকৃতির ছবি তুলতে ভালোবাসি, সেটাই আমার শখ।

আনন্দভুবন : ভবিষ্যতের পরিকল্পনা কী ?

রাবেয়া আক্তার : ভবিষ্যতে পূর্ণসময় গান শেখানোর কাজে যুক্ত হতে চাই। পাশাপাশি বাংলা ভাষা শেখানোও আমার খুব প্রিয় কাজ। আমি বিশ্বাস করিÑ গান, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের মতো মহানদের গান মানুষকে অপরাধপ্রবণতা থেকে দূরে রাখে এবং অন্তরকে নির্মল করে।

আনন্দভুবন : পরিশেষে কী বলতে চান ?

রাবেয়া আক্তার : আমার কাছে গান মানে শুধু বিনোদন নয়, বরং একধরনের সাধনাÑ যেখানে মিশে আছে প্রকৃতি, প্রেম ও ঈশ্বরচেতনার অনন্ত অনুসন্ধান।