স্বর্গের পারিজাত মর্ত্যে শিউলি হয়ে ফোটে

29 Sep 2025, 03:23 PM প্রকৃতি শেয়ার:
স্বর্গের পারিজাত মর্ত্যে শিউলি হয়ে ফোটে

আমি সমস্ত দিন কেবল টুপ্টাপ্ করিয়া ফুল ফেলিতেছি ; আমার তো আর কোনো কাজ নাই। আমার প্রাণ যখন পরিপূর্ণ হইয়া উঠে, আমার সাদা সাদা হাসিগুলি মধুর অশ্রুজলের মতো আমি বর্ষণ করিতে থাকি।

আমার চারি দিকে কী শোভা! কী আলো! আমার শাখায় শাখায় পাতায় পাতায় সূর্যের কিরণ নাচিতেছে। বীণার তারের উপর মধুর সংগীত যেমন আপনার আনন্দে র্থর্থ করিয়া কাঁপিয়া উঠে, স্বর্গ হইতে নামিয়া আসে, এবং কাঁপিতে কাঁপিতে স্বর্গেই চলিয়া যায় ; আমার পাতায় পাতায় প্রভাতের আলো তেমনি করিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে, চমক খাইয়া আকাশে ঠিক্রিয়া পড়িতেছে, সেই আলোকের চম্পক-অঙ্গুলি স্পর্শে আমার প্রাণের ভিতরেও ঝিন্ঝিন্ করিয়া বাজিয়া উঠিতেছে, কাঁদিয়া উঠিতেছে- আমি আপনাকে আর রাখিতে পারিতেছি না- বিহ্বল হইয়া আমার ফুলগুলি ঝরিয়া পড়িতেছে। -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর [শিউলিফুলের গাছ] 

বাংলার প্রকৃতিতে এখন রাজত্ব করছে স্নিগ্ধ শরৎ। শরৎ শিউলি ফোটার কাল। ভোরের বাতাসে ভেসে আসে তার মোহনীয় সুবাস। গ্রামে-মফস্বলে বাগানবিলাসীদের ঘরের কোণে যত্নে বেড়ে ওঠে শিউলিচারা। তারপর পরিণত বয়সে সে উজাড় করে দেয় তার সৌন্দর্য ও সুরভি। নগর-মহানগরেও শিউলির দেখা মেলে। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কালীমন্দিরসংলগ্ন জায়গায়, শিশু একাডেমি প্রাঙ্গণে, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে, বলধা গার্ডেনে আর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে শিউলিগাছের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। আদর-যত্নে গ্রামের মতো শহরের বাড়ির আশেপাশে কিংবা একচিলতে উঠানের কোণেও কেউ কেউ শিউলিগাছ রোপণ করেন। ছাদবাগানের এই যুগে অনেকে ছাদের টবে যত্নে লালন করেন শিউলি।

নরম ও ধূসর বাকলবিশিষ্ট শিউলিগাছ ১০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। শিউলি খুবই ক্ষণস্থায়ী ফুল। এই ফুলকে শেফালি নামেও ডাকা হয়। এর আরও কয়েকটি প্রচলিত নাম আছে- পারিজাত, শেফালিকা, কোরাল জেসমিন, রাগাপুষ্পি, খারাপাত্রাকা, পারিজাতা। শিউলি ফুলের কলিরা ফুটে ওঠে সন্ধ্যায়, ঝরে পড়ে ভোরে। শিউলির সাদা পাপড়িগুলো পরস্পরের সঙ্গে জোড়া লাগানো থাকে, পাপড়িগুলো ধরে রাখে কমলা রঙের বৃন্ত। সূর্য ডোবার পর থেকে শিউলির পাপড়িগুলো ফুটতে থাকে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে মিষ্টি সুবাস। ভোরে গাছতলা ভরে ওঠে সাদা-কমলা মেশানো ফুলের স্নিগ্ধ সমারোহে, তার উপর জমে থাকে শিশিরবিন্দু। এই দৃশ্য কত যে মনোরম, তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। শিউলির ফল চ্যাপ্টা ও বাদামি হৃৎপিন্ডাকৃতির হয়। 

শিউলি ভারতীয় উপমহাদেশের নিজস্ব উদ্ভিদ। আদিনিবাস মধ্য ও উত্তর ভারতে। বৈজ্ঞানিক নাম Nyctanthes arbortristis। দক্ষিণ এশিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব থাইল্যান্ড থেকে পশ্চিমে বাংলাদেশ, ভারত, উত্তরে নেপাল ও পূর্বে পাকিস্তান পর্যন্ত এলাকাজুড়ে শরৎকালে শিউলি ফুলের বিস্তার। বাংলাসাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছে শিউলি। যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকেরাও মুগ্ধ হয়েছেন শিউলির রূপে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতা ও গানে শিউলির রূপমাধুর্যের বিবরণ বর্তমান। শুধু তা-ই নয়, খ্রিষ্টপূর্ব ৫৬ অব্দে জন্ম নেওয়া কবি কালিদাসের কাব্যেও শিউলির কথা আছে। চিত্রশিল্পীরাও ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছেন শিউলির সৌন্দর্য। 

শুভ্র কাশসহ শরতে বিভিন্ন ফুলের সমারোহ থাকলেও শিউলি নিয়ে বাঙালির আবেগ যেন একটু বেশি। বিশেষত, শরতের শুভ্রতা, স্নিগ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতীক শিউলি ফুল। শিউলির সাথে সূর্যের আড়ি, তাই সূর্যাস্তের পরে সে ফোটে আবার সূর্যোদয়ের আগেই ঝরে পড়ে। এর পেছনে আছে এক পৌরাণিক গল্প। কিংবদন্তিমতে শ্রীকৃষ্ণের দুই পত্নী- সত্যভামা ও রুক্সিনী, তাদের উভয়ের মনে ভীষণ দ্বন্দ্ব, কৃষ্ণ কাকে বেশি ভালোবাসেন। সত্যভামাকে, না রুক্সিনীকে ? এর কোনো জবাব নেই কৃষ্ণের কাছে। শেষে একদিন তারা আবদার করে যে, কৃষ্ণ যদি স্বর্গ থেকে পারিজাত ফুল এনে দিতে পারেন, তাহলেই বোঝা যাবে কৃষ্ণের পত্নীপ্রেম কতটা প্রগাঢ়। কৃষ্ণ স্বর্গ থেকে পারিজাত বৃক্ষ চুরি করে আনেন। সত্যভামা সকালে ঘুম ভেঙে দেখেন তার প্রাসাদে একটি অপূর্ব পারিজাত বৃক্ষ এবং সেই ফুলের গুচ্ছ বিছিয়ে রয়েছে রুক্সিনীর প্রাসাদকোণে। এ দিকে স্বর্গের ফুল পারিজাত চুরি করায় দেবরাজ ইন্দ্র ভীষণ কোপিত হন। তিনি আভিশাপ দেন, ‘পারিজাত ফুটেই ঝরে যাবে। ফুল থেকে কখনো ফল হবে না।’ তা না হোক, মর্ত্যবাসী তো কেবল শিউলি-শেফালিকা-পারিজাত যে নামেই ডাকা হোক-না-কেন, তার ফুলই ভালোবাসে। ফলে কী কাজ ! শিউলি শরতের শ্রেষ্ঠ ফুল। 

লেখা : শ্যামল কায়া