নাফাখুম ভ্রমণ আমার জীবনের এক চমৎকার অর্জন বলেই হয়ত এত বছরেও আমি এ বিষয়টি নিয়ে লিখিনি। কিছু বিষয় বা সম্পদ থাকে যা অনেক কাক্সিক্ষত, যা অনেক যতেœ আগলে রাখতে হয়, নাফাখুম ভ্রমণ আমার তেমনি এক স্মৃতিসম্পদ। এর আগে পরে দেশে-বিদেশে অনেক জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে কিন্তু আমার কাছে নাফাখুমের মতো দুর্গম বা কাক্সিক্ষত কোনো কিছুই ছিল না। আক্ষরিক অর্থে আমি দুইবারের প্রচেষ্টায় নাফাখুম যেতে সক্ষম হয়েছিলাম। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বান্দরবানের চেনা চৌহদ্দি ছেড়ে পথের বিভিন্ন বাধা পেরিয়ে পৌঁছাই থানচি। থানচি বান্দরবানের একটি উপজেলা, বান্দরবান শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৮২ কিলোমিটার। সেবার আমাদের ভ্রমণপরিকল্পনায় বান্দরবানের বগা লেক ও নাফাখুম এই দুটি জায়গা ছিল। বগালেক ভ্রমণ নিয়ে আগেই বলেছি, সে এক বিশাল অ্যাডভেঞ্চার ; তবে অ্যাডভেঞ্চারের বোধ করি আরও বাকি ছিল। সকাল ৯টা নাগাদ অস্থাবর যাবতীয় সম্পদ গুছগাছ করে বগা লেকের আমাদের অস্থায়ী আস্তানা ছেড়ে রওনা দিলাম। রুমা থেকে বগা লেক যাওয়ার জন্য রুমা বাজার থেকে আমরা যে গাড়িটি ভাড়া করেছিলাম, সেটাই আমাদের বগা লেক থেকে বান্দরবানের ওয়াই জংশনে পৌঁছে দিল। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল স্থানীয় ড্রাইভার পিচ্চি মিলন আর তার পাজেরো, মিলনের ভাষায় এ তার আদুরে পংখীরাজ। মিলন একই সাথে আমাদের গাইডও। তার পরামর্শে চিম্বুকে বিরতি ও মধ্যাহ্ন আহার সেরে নিলাম। এরপর টানা পথচলা। গাড়িতে রবীন্দ্রসংগীত বাজছে, পথের দু’ধারে মনোরম পাহাড়ি প্রকৃতি। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। গোল বাঁধল ঠিক নীলগিরির কাছে এসে। বিকট এক শব্দ করে থেমে গেল পাজেরো। তারপর আধঘণ্টা, আমাদের করিতকর্মা ড্রাইভারের সকল জারিজুরি মিথ্যে করে দিয়ে পংখীরাজ আর নড়বেন না বলে তার মৌন সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন।
এবার শুরু আসল অ্যাডভেঞ্চার। পাক্কা দেড়ঘণ্টা শরণার্থী হয়ে পথে বসে থাকা। যদি কোনো লিফট মেলে। কপাল মন্দ, কেউ আমাদের লিফট দিতে রাজি নয়। থানচি থেকে দু’-একটি বাস বান্দরবানের পথে যাচ্ছে, ভাবছি ফিরে যাব কি না। এদিকে সন্ধে হয়ে আসছে। এই দুইঘণ্টায় বান্দরবান থেকে একটি বাস থানচির পথে গেলেও মিলনের উপর আগাধ ভরসার কারণে সেই বাসে ওঠার কোনো চেষ্টাই আমরা করিনি। সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, শহরে ফিরে যাব। তখনই বাসের হর্ন, শহর থেকে থানচির পথে চলেছে। হাত দেখাতেই থেমে গেল। আবারও নতুন উদ্যোমে যাত্রা শুরু, নীলগিরি থেকে থানচি। পথে যাত্রাবিরতি বলি বাজার, বলি বাজার নাম শুনেই ভয় ভয় লাগে, যদিও বাস্তবে দেখতে খুবই সাধারণ একটি পাহাড়ি বাজার। বলিপাড়া থানচি উপজেলার একটি ইউনিয়ন, মূলত এখান থেকে থানচি উপজেলার সীমানা শুরু আর এই ইউনিয়নের হিন্দু অধ্যুষিত একটি বাজার এলাকা বলি বাজার। বান্দরবানের সদর উপজেলা পার হয়ে থানচি অভিমুখে এই বাজরে যে বিজিবির ক্যাম্প রয়েছে, সেখানে সবার নামধাম পরিচয় লিখিয়ে নিয়ে পরবর্তীপথচলার বাধ্যবাধকতা থেকে সেখানে খানিক যাত্রাবিরতি। প্রত্যন্ত উপজেলা শুনলে যেমন দুর্গম বলে মনে হয়, থানচির পথ কিন্তু মোটেও সেরকম নয়। বরং পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথটি বেশ মসৃণই বলতে হয়। তার উপর শেষ বিকেলের আলোয় পাহাড়িকন্যার রূপ যেন আরও মোহময়। আর এই অপরূপ সুন্দরকে দু’চোখ ভরে দেখতে দেখতে আমরা একসময় পৌঁছে গেলাম থানচি। তারপর রাতে থাকার ব্যবস্থা করে সারাদিন পর একটু বিশ্রাম। এরপর গোছল- ব্যস, ধুয়ে গেল সারাদিনের ক্লান্তি। তারপর বেরিয়ে পড়া খাবারের সন্ধানে, সকালের নাসতার পর আমাদের আর কিছু খাওয়া হয়নি। এরই মধ্যে অবশ্য আমরা একজন গাইড জোগাড় করে নিয়েছি, নাম শহজাহান, যাকে ইতোমধ্যে আমরা স¤্রাট বলে ডাকতে শুরু করেছি। রাতে কোথায় খাব তা ঠিক করার দায়িত্ব স¤্রাট নিয়ে নিয়েছে, আমরা শুধু তাকে অনুসরণ করছি। থানচি বাজারে বেশ কয়েকটি ছোটো ছোটো খাওয়ার দোকান আছে, দেখেশুনে তার একটিতে ঢুকে গেলাম, মেন্যু খুব সাধারণ- ডিম, ডাল আর আলু ভর্তা দিয়ে সাদা ভাত। তবে, এই সাধারণ মেন্যুই তখন আমৃত। খাওয়ার পর্ব শেষ হলে থানচি বাজারটা একচক্কর দিয়ে আমরা রেস্ট হাউজে ফিরে আসি। সকাল সকাল বের হতে হবে তাই একটু তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টায় সবাই বিছানায় চলে গেলাম।
খুব ভোরে তল্পিতল্পা সাথে করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম, সাধারণত এত ভোরে কোনো দোকান খোলে না, তাই আমাদের গাইড রাতেই একটি হোটেলে কথা বলে রেখেছিল, ভোরবেলা যেন নাসতার ব্যবস্থা করে রাখে। সেইমতো সব ঠিকঠাকই ছিল। আমরা নাসতা করে সরাসরি ঘাটে চলে গেলাম, যেখানে ইতোমধ্যে আগে থেকে ঠিক করে রাখা নৌকা হাজির। এখানেও একটি বিজিবি ক্যাম্প আছে, এখানে আমাদের পুনরায় বৃত্তান্ত দাখিল করতে হলো। অবশ্য, এখন এই দায়িত্ব আমাদের গার্ডই পালন করল। আধঘণ্টা সময় লাগল আনুষ্ঠানিকতা সেরে নিতে, এরপর শুরু হলো আমাদের অ্যাডভেঞ্চার- নাফাখুম। আমাদের আজকের যাত্রা নদীপথে। সাঙ্গু বা শঙ্খ যে-নামেই ডাকা হোক-না-কেন, কোনোটাই তার জন্য বেমানান নয়। প্রকৃতি যেন কুয়াশার চাদরে মোড়ানো। আমরা কুয়াশার চাদর একটু একটু করে সরিয়ে পথ চলতে শুরু করছি। ভোরের নরম আলোয় চলতি পথে নাকে লাগছে কচিপাতার মিষ্টি সুবাস, সেইসাথে পাহাড়ের নিজস্ব ছন্দ তো আছেই। বর্ষা শুরুর আগে নদীতে কোথাও কোথাও জল হাটু অব্দিও হবে না। কিছু দূর পরপর নৌকা থেকে নেমে হাঁটতে হচ্ছে। তাতে কিন্তু নৌভ্রমণের আনন্দ একটুও ম্লান হচ্ছে না। আস্তে আস্তে বেলা বাড়ছে, দৃশ্যপটও বদলে যাচ্ছে, আর আমরা উপভোগ করছি প্রকৃতির ভিন্ন ভিন্ন অপরূপ রূপ। কুয়াশার আবরণ চিরে ঝলমলে রোদ জানান দিচ্ছে সুয্যিমামা আমাদের সঙ্গী হয়েছে। নদীর দু’ধারে রং ছিটাচ্ছে নাম না-জানা বুনো ফুল, সাথে সঙ্গ দিচ্ছে পাহাড়ি কিশোরীর দিন যাপনের চঞ্চলতা। আমরা এগুচ্ছি, আর ছবি-বইয়ের এক একটি পাতা উল্টাচ্ছি। সত্যি যেন আমরা মর্ত্যরে বাইরে কোনো স্বপ্নের দেশে যাত্রা করেছি।
বেলা সাড়ে নয়টা নাগাদ আমরা তিন্দু বাজারে পৌঁছাই। সেখানে ছোটো একটা খুপরি চায়ের দোকানে আমাদের যাত্রাবিরতি। নাফাখুম যেতে হলে আমাদের প্রথমে রেমাক্রি যেতে হবে, সেখান থেকে পায়ে হেঁটে নাফাখুম। তিন্দু থেকে রেমাক্রি যেতে সময় লাগতে পারে ৪০ মিনিট থেকে একঘণ্টা, এটা নির্ভর করে ¯্রােতের উপর। কিন্তু তিন্দু পর্যন্ত এসে আমরা কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলাম, এর কারণ আবহাওয়া। আবহাওয়া হঠাৎই খারাপ হতে শুরু করল, জোর সম্ভাবনা ভারি বর্ষণের। আর ভারি বর্ষণে বাকি পথ অতিক্রম করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে, বড়ো পাথর বলে যে-জায়গাটা আছে, তারপর থেকে পুরো পথেই অজ¯্র পাথর আর এই পাথুরে এলকায় বিভিন্ন জায়গায় ভারি বষর্ণে জলের ঘূর্ণি সৃষ্টি হয়, যা কখানো কখনো মরণফাঁদ তৈরি করে। কোনোভাবে যদি নৌকা ঘূর্ণিতে পড়ে, তবে নির্ঘাত মৃত্যু। কারণ, এই পাথুরে ঘূর্ণিতে সাঁতার কাটা অসম্ভব আর যদি বেকায়দায় একটা পাথরে মাথা তবে আর রক্ষা নেই। সুতরাং এই বাস্তবতায় আমাদের ভ্রমণ পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হলো। ঠিক হলো আমরা বড়ো পাথর বা ‘রাজা পাথর’ পর্যন্তই যাব।
তো সেই মতোই আমরা ‘রাজা পাথরে’ নোঙর ফেললাম। জায়গাটার নাম কেন বড়ো পাথর তা এতক্ষণে বুঝতে পারলাম। বড়ো পাথুরে এলাকাটি বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে আছে। বিশাল বিশাল পাথর বিচিত্র আকৃতি নিয়ে যেন এখানে সেখানে আড্ডা দিচ্ছে। আমরা নৌকা থেকে নেমে এক পাথর থেকে আরেক পাথরে যাচ্ছি আর অবাক হচ্ছি। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় পাথরের দেশে কাটিয়ে একটি পাহাড়ি কুটিরে নাসতা করে নাফাখুম ভ্রমণ এবারের মতো মূলতবি রেখে ফিরতি পথ ধরলাম। একই পথ তবু যেন এক নয়। সময়টা ভিন্ন, তাই পথের দৃশ্যপটও ভিন্ন। সূর্য মাথার উপর, তাপ কিছুটা অসহনীয়। কিন্তু শঙ্খ নদীর জল তখনও শীতল। মন খুব চাইছে নদীর শীতলতার ভাগ নিতে, কিন্তু উপায় নেই, ফিরতে হবে। তাই মনে মনে নিজেকেই কথা দিলাম আবার আসব...
[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]