রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা ঋতুপর্ণা চাকমা বাংলাদেশের নারী ফুটবলের এক অসাধারণ প্রতিভা। পাহাড়ের কোলে বেড়ে ওঠা ঋতুপর্ণা চাকমা ছেলেবেলা থেকেই ফুটবলকে মন থেকে ভালোবেসেছেন। তার এই ভালোবাসাই তাকে নিয়ে এসেছে ফুটবল মাঠে, যেখানে তিনি একজন আত্মবিশ্বাসী ফুটবল যোদ্ধা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।
ফুটবলার হয়ে ওঠা
ঋতুপর্ণা চাকমার ফুটবলার হয়ে ওঠার যাত্রা ছিল বেশ রোমাঞ্চকর। ছেলেবেলায় ফুটবল খেলার প্রতি আগ্রহ দেখে এক স্থানীয় কোচ তাকে বিকেএসপি-তে [বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান] ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। তবে আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে তার পক্ষে সেখানে ভর্তি হওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন তিনি কখনোই ছাড়েননি। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ঋতুপর্ণার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ ফুটবলে অভিষেকের মাধ্যমে। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। খুব দ্রুতই তিনি বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৯ এবং সবশেষ জাতীয় দলের প্রথম সারির নিয়মিত সদস্য হয়ে ওঠেন। রক্ষণভাগের খেলোয়াড় হিসেবে তার পারফর্মেন্স দুর্দান্ত। তার শান্ত, স্থির এবং নিখুঁত ডিফেন্ডিং যেকোনো প্রতিপক্ষের আক্রমণ রুখে দিতে সক্ষম। তিনি শুধু একজন দক্ষ ডিফেন্ডারই নন, মাঠের একজন যোগ্য নেতাও। তার নেতৃত্বগুণ এবং মাঠে তার উপস্থিতি দলের অন্য খেলোয়াড়দের জন্য সবসময় অনুপ্রেরণার উৎস।
বর্তমান অর্জন
ঋতুপর্ণা চাকমার ফুটবলনৈপুণ্য এবং কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অনেক অর্জন যোগ করেছেন। তার নেতৃত্বগুণ এবং অনবদ্য পারফর্মেন্সের কারণে তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্টের শিরোপা জয়ে অবদান রেখেছেন।
২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৫ দলের হয়ে সাফে চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। এর পরের বছরই তিনি অনূর্ধ্ব-১৮ দলের হয়েও সাফে শিরোপা জেতেন। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে, ঢাকার বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে তিনি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জোড়া গোল করেন। তিনি ২০২২-এ সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী দলের অংশ ছিলেন। তবে, তার সবচেয়ে বড়ো সাফল্য হলো ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে নারী সাফে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন হওয়া। দীর্ঘ অপেক্ষার পর এই ঐতিহাসিক জয়ে দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ঋতুপর্ণা তার ভূমিকা পালন করেন। এই সাফল্য তাকে এবং পুরো দলকে দেশের মানুষের কাছে অবিস্মরণীয় করে তুলেছে।
ফুটবলকে ঋতুপর্ণা শুধুমাত্র একটি খেলা হিসেবে দেখেন না, এটি তার জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি ফুটবলকে ধ্যানজ্ঞান হিসেবে নিয়েছেন। তার কঠোর পরিশ্রম, শৃঙ্খলা এবং খেলার প্রতি অসীম ভালোবাসা তাকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। ঋতুপর্ণা প্রমাণ করেছেন যে, লক্ষ্য স্থির থাকলে এবং তা অর্জনের জন্য দৃঢ় সংকল্প থাকলে কোনো বাধাই অসাধ্য নয়।
মাঠের বাইরে ঋতুপর্ণা একজন সহজ-সরল এবং বিনয়ী মানুষ। তার জীবন হাজারো তরুণীর কাছে এক প্রেরণার উৎস। বিশেষত, পাহাড়ি এলাকার মেয়েদের জন্য তিনি একটি বড়ো দৃষ্টান্ত। তিনি দেখিয়েছেন সঠিকভাবে সুযোগ এবং সমর্থন পেলে যেকোনো প্রান্তের একটি মেয়েও দেশের জন্য গৌরব বয়ে আনতে পারে। ঋতুপর্ণা চাকমা শুধু একজন ফুটবলার নন, তিনি বাংলাদেশের নারী সমাজের অগ্রযাত্রার এক উজ্জ্বল প্রতীক। তার মতো খেলোয়াড়েরা দেশের নারী ফুটবলকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন এবং আরও অনেক নতুন প্রতিভাকে অনুপ্রাণিত করছেন।
লেখা : শহিদুল ইসলাম এমেল