[পূর্ব প্রকাশিতের পর]
প্যারিসের রাস্তার জটিল জ্যাম ঠেলে নির্ধারিত সময়ে বিমানে ওঠা সম্ভব হলেও বার্সিলোনায় কিন্তু র্নিধারিত সময়ে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। প্যারিস থেকে বার্সিলোনা ক্ষেত্রবিশেষে বিমানযাত্রার সময় একঘণ্টা ৪৫ মিনিট থেকে সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টা। আমার ফ্লাইট টাইম ছিল সন্ধে সাতটায় ; সে হিসেবে পৌনে নয় বা নয়টার মধ্যে আমার বার্সিলোনা পৌঁছে যাওয়ার কথা। ইউরাপে প্রথম সলো ট্রিপ, রাতের ইউরোপ যদিও খুব একটা ভাবনা যোগানোর কথা নয়, কিন্তু যেহেতু একা যাচ্ছি হোটেল খুঁজে বের করা থেকে অচেনা পথঘাট ট্রান্সপোর্টের ধরন সব কিছুই কেমন যেন একটা অনিশ্চয়তা তৈরি করে, যা অবচেতন মনকে না চাইতেও খোঁচাতেই থাকে। এর মধ্যেই ঘোষণা এলো যান্ত্রিক ত্রুটির করণে প্লেন ছাড়তে কিছুটা বিলম্ব হবে। যাহ্ এটা আজকেই হতে হলো ! ইউরোপে আসা অবধি অনেক ক’টা দেশে বা শহরে যাওয়া হয়েছে সে হিসেবে বিমানযাত্রার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। তবে, ফ্লাইট বিপর্যয় এবারই প্রথম। ক্ষণিক বিরতিতে পাইলটের পক্ষ থেকে যাত্রীদের অসুবিধার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ঘোষণা আসছিল, সাথে এটাও বলা হচ্ছিল যে, অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা উড়তে সক্ষম হব। আসলে যন্ত্রের কলকব্জা যে কখন বিগড়ায় ? অনেক পূর্ব-নিরীক্ষণ ও সচেতনতার পরও হঠাৎ ঘটেই যেতে পারে, আর বিমানের মতো একটি যান পুরোপুরি বা সন্দেহাতীত না হয়ে তো ছাড়াও যায় না। তবে, ঘোষণার কিছুক্ষণ যে ঘণ্টা দুয়েকে দাঁড়াবে তা কে জানত। অবশেষে রাত নটায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো প্যারিস টু বার্সিলোনা।
বার্সিলোনায় পৌঁছাতে রাত প্রায় এগারোটা, প্লেন থেকে নেমেই প্রথমে কাজিনকে ফোন কল করলাম, একে তো একা ভ্রমণে বের হয়েছি তার ওপর প্লেন ডিলে, বেচারা প্রচ- টেনশনে আছে। এরপর হোটেলে যাওয়ার তোড়জোড়, ইউরোপের এই বিষয়টি বেশ জনবান্ধব, প্রায় প্রতিটি বিমানবন্দরের সাথেই রয়েছে মেট্রো স্টেশন। আমি আর দেরি না করে মেট্রোর টিকেট কাটতে টিকেট মেশিনের কাছে চলে গেলাম, কিন্তু টিকেট কাটতে গিয়ে বাঁধলো বিপত্তি, কোনোভাবেই টিকেট কাটা যাচ্ছে না, মেশিন কার্ড বা ইউরো কোনটাই নিচ্ছে না। বেশ একটা জটিল পরিস্থিতি নিজেকে কেমন বেকুব বেকুব লাগছে, আমার মতো অবস্থা বেশ কিছু চীনা বা কোরিয়ান পর্যটকের, তাদের মধ্যে একজন আবার আমার কাছে এই বিষয়ে সাহায্য চেয়ে বসল। যেখানে নিজের অবস্থা এমন জগা খিচুড়ি সেখানে আরেকজনকে কি হেল্প করব। অগত্যা সাহায্যের জন্য আবার বিমানবন্দরের গেটে আসলাম, সেখানে কাউন্টারে কয়েন বিক্রি করে যা মেট্রোর টিকেট কাটার জন্য ব্যবহার করা হয়, সেখান থেকে একটি কয়েন কিনে নিতে হলো যার বিনিময়ে টিকেট কাটা যাবে, যাক অবশেষে মেট্রোর টিকেট কেটে মেট্রোতে চড়ে বসতে পারলাম, মনে হলো যেন ঘাম দিয়ে জ¦র ছেড়ে গেল, কিন্তু এই শেষ না আবারও জ¦র ফিরে এলো যখন নির্ধারিত গন্তব্যে এসে পৌঁছুলাম।
নির্ধারিত স্টেশনে আমি একমাত্র যাত্রী যে মেট্রো থেকে নামলো। বিশাল স্টেশন, এ কোণে একটি কাচের চেম্বার কিন্তু ভেতরে কেউ নেই আর এদিকে আমি স্টেশন থেকে বের হওয়ার গেট খুঁজে পাচ্ছি না, কাউকে যে জিজ্ঞেস করে জেনে নেব তারও উপায় নেই। কারণ, এই পুরো স্টেশনে আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো প্রাণের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে না। এদিকে আমি তো রীতিমতো ঘামছি যদিও এখন ডিসেম্বরের শেষ। কিছুটা সময় কাচের চেম্বারের কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম যদি কেউ আসে, অপেক্ষার মুহূর্তও বেশ র্দীঘ হয়। জানি না কতক্ষণ পর একজন কোরিয়ান তরুণের দেখা মিলল, মনে হলো যেন ভূঁইফোড়ের মতো হঠাৎ তার উদয় হয়েছে। কোন দিক থেকে সে এলো তা খেয়াল করার মতো মানসিক স্থিরতা আমার ছিল না। তবে, এতক্ষণে যেন জানে পানি এলো। সেই তরুণের সহায়তায় আমি স্টেশনের এক্সিট খুঁজে পেলাম। বলে না, ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানে সন্ধ্যা হয়’। বার্সিলোনায় আমার ভ্রমণ সহজ করার জন্য ইরফান আমাকে বেশ কিছু বিষয়ে ধারণা দিয়েছিল, সতর্ক করেছিল একটি বিষয়ে, আর তা হচ্ছে আফ্রিকান বংশোদ্ভূতদের ব্যাপারে। তারা দৌড়ে গিয়ে পথ আটকিয়ে ছিনতাই করে না ঠিকই কিন্তু একলা পথচারীদের চলতি পথে ব্যাগ বা পার্স টান মেরে নিয়ে দৌড়ে পালায়। আর স্বাভাবিকভাবেই বিদেশ বিভূঁইয়ে ব্যাগ হারালো তো সবই হারালো। কেননা, মোবাইল, পাসপোর্ট, টাকা সবই ব্যাগে থাকে। মেট্রো স্টেশন থেকে বের হতে হতে রাত সাড়ে এগারোটা, আমি তখনো জানি না কতটুকু পথ হাঁটতে হবে, যদিও গুগল ম্যাপের নির্দেশ মোতাবেক তা খুব দূরে হওয়ার কথা নয়। আমি ম্যাপ অনুসরণ করে হাঁটতে শুরু করার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দেখি বিপরীত দিক থেকে একজন কালো মানব হেঁটে আসছে। সেই মূহূর্তে তাকে দেখে যমদূত দেখার অনুভূতি হলো। কারণ, পুরো পথে আমি আর সেই ভিনদেশি। আমার সাথে ট্রলি আছে চাইলেও আমি খুব জোরে ছুটেতে পারবো না, আর যতই জোরে ছুটি না কেন, তার সাথে পেরে ওঠা অসম্ভব। হঠাৎ রাস্তার অপর পারে তাকাতেই আমার হোটেলের নির্দেশিকা চোখে পড়লে আমি দ্রুত গতিতে কোনো সিগনাল না মেনেই রাস্তা পার হয়ে গেলাম। তারপর অনেকটা দৌড়েই যেন হোটেলে পৌঁছালাম। হোটেলের লবিতে বসে কিছুক্ষণ দম নিয়ে তারপর চেক ইনের ফর্মালিটিস মিটিয়ে রুমে ঢুকলাম।
সবকিছু মিটিয়ে যখন আমি হোটেলকক্ষে তখন ক্যালেন্ডারের পাতায় নতুন তারিখের সূচনা হয়ে গেছে। রুমটি বেশ বড়ো। তবে, সবচেয়ে সুন্দর এর ওয়াশরুমটি। যদিও সময় রাত বারোটা অতিক্রম করে গেছে তবু এত সুন্দর ওয়াশরুম দেখে গোসল করার লোভ সামলাতে পারলাম না। গোসল শেষে বেশ শান্তি শান্তি একটা অনুভূতি নিয়ে লবিতে থাকা ফুডকাউন্টার থেকে আনা জ্যুস আর ডোনাট দিয়ে রাতের খাবার শেষ করলাম। এরই মাঝে বন্ধু দেলওয়ারের ফোন, মূলত যার সাথে সময় মিলিয়ে আমরা বার্সিলোনা আর লিসবনের ভ্রমণ পরিকল্পনা করা, যদিও পরবর্তীসময়ে তার পরিকল্পনা বাতিল হয়েছিল বলে সে জানিয়েছিল। তবে, ফোন করে সে সত্যি আমাকে সারপ্রাইজই দিলো, তারা পুরো টিম তখন বার্সিলোনায়।
বেশ রাত করে ঘুমুতে গেলেও ঘুম কিন্তু সকাল সকালই ভেঙেছে, ফ্রেশ হয়ে রুমে থাকা কেটলি ও কফির সরঞ্জামের সদ্ব্যবহার করে নিজহাতে তৈরি কফি খেতে খেতে পরবর্তীপরিকল্পনা ঠিক করে নিলাম, এ ক্ষেত্রেও আমার বন্ধু হয়ে ছিল ঠরংরঃ অ ঈরঃু অ্যাপটি। আমার প্রথম গন্তব্য ভূ-মধ্যসাগরের উপকূল ঘেঁষে ফিনিশিয়ানদের স্মৃতিবহ পুরানো একটি প্রাসাদ। এটি মূলত কাতালেনিয়ার রাজধানী হিসেবেই সুপরিচিত। কাতালেনিয়া স্পেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বসবাসরত একটি স্বায়ত্বশাষিত সম্প্রদায়, যারা ভু-মধ্যসাগরের উপকূল ঘেঁষে নিজেদের বসতি স্থাপন করেছিল, তাদের নির্মিত বিশাল প্রাসাদটি এখন বার্সিলোনার অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র। অ্যাপের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রথমে মেট্রো স্টেশনে গেলাম, হয়ত আমার বোঝার ভুল ছিল ; আমি মেট্রোর টিকেট নিতে গেলাম কিন্তু মেট্রোর স্টেশন তালিকায় আমার কাক্সিক্ষত গন্তব্যের নাম না থাকায় বিপাকেই পড়া গেলাম। কিন্তু অ্যাপ তো মনে হয় আমাকে মেট্রো স্টেশনের দিকেই নির্দেশ করল। তারপর একজন যাত্রীর সাথে কথা বলে জানলাম আমাকে বাসে যেতে হবে। বাস স্টপটি মেট্রো স্টেশন লাগোয়া তাই এই ভুল। যাহোক, এরপর বাস স্টপে গিয়ে টিকেট কেটে উঠে বসলাম, যদিও এটি শহরের সাধারণ বাস কিন্তু বাসের অধিকাংশ যাত্রীই আমার মতো পর্যটক। বাসটি গিয়ে যেখানে থামলো জায়গাটির নাম এস্পানা স্কয়ার, আমাকে এখান থেকে বাস পরিবর্তন করতে হবে। আগেই বলেছিলাম, বাসের অধিকাংশ যাত্রীই পর্যটক, এখানে এসে বোঝা গেল এদের প্রায় সবার গন্তব্য কাতালেনিয়ার প্রাসাদ অর্থাৎ ভূ-মধ্যসাগরের উপকূল, যদিও তখন পর্যন্ত আমি এটা জানতাম না যে, প্রাসাদটি সাগরের তীরে। বাসের জন্য খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। আমরা বাসে করে শহরের অনেকটা ছাড়িয়ে এসেছি, ইউরোপে অন্যান্য শহরগুলো এই সময় কুয়াশার চাদরে মোড়া থাকলেও বার্সিলোনায় যেন এখন বসন্ত। চারদিকে ঝলমলে রোদ। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে কখন যেন সমুদ্রতীরবর্তী এই শহরের প্রান্তে এসে পৌঁছেছি টেরই পাইনি।
এখানে এসে পুরো বাসটিই ফাঁকা হয়ে গেল। কারণ, শহরের এই প্রান্তে এটাই শেষ গন্তব্য ; এরপর দিগন্ত বিস্তৃত অতল সাগর। প্রতি দুই ঘণ্টার ব্যবধানে বাস এসে এখান থেকে যাত্রীদের আবার শহরকেন্দ্রে ফিরিয়ে নেয়। প্রকৃতির সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে-না-যেতেই কঠিন-কঠোর বাস্তবে ফিরে এলাম। কারণ, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়...’। পুরো চত্বরের এককোণে ছোটোখাটো একটি ¯েœকস কাউন্টার, যার সামনে খোলা আকাশের নিচে কয়েকটি চেয়ার পাতা। এখানে খাবারের আইটেম খুবই সামান্য, খুঁজেপেতে একমাত্র ডোনাটই পেলাম খাওয়ার যোগ্য, সাথে একটা জ্যুস। খেতে খেতে চারদিকে একটু নজর বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। পর্যটকেরা এরই মধ্যে যে যার মতো করে ঘুরেফিরে দেখছে, কেউ কেউ ছবি তুলছে। আমিও দু’-একটা সেফলি তুলে নিয়েছি। সলো ট্রাভেলিংয়ের এই এক সমস্যা, সেলফি ছাড়া গতি নেই। ¯েœকস কর্নারের পাশেই মাটিতে চাদর পেতে বিভিন্ন পণ্যের পরসা সাজিয়ে বসেছে বিক্রেতারা, এখানে মূলত নাইজেরিয়ান আর পাকিস্তানি বিক্রেতাদেরই চোখে পড়ল। আমি একজন নাইজেরিয়ানের কাছ থেকে একটি সানগ্লাস কিনে নিলাম। কারণ, আমার সাথে সানগ্লাস ছিল না, আর সাগরতীরে এই বেলার ঝকঝকে সূর্যের আলোয় খালি চোখে তাকানো যাচ্ছিল না। [চলবে]