ইউরোপের ১৫০ দিন : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

28 Jan 2025, 02:46 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার


[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


মন্টজুইক অর্থ ইহুদি পর্বত বা পাহাড়, একটি অগভীর বিস্তৃত পাহাড়, এখানে মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় কবরস্থান রয়েছে। স্থানটি একইসাথে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক কৌশলগত অবস্থানের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। ভূ-মধ্যসাগরের তীরবর্তী এই অঞ্চল থেকেই মূলত বার্সিলোনা শহরের গোড়াপত্তন। বর্তমানে এটি একটি জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট; এই পুরো এলাকাটি ঘিরে রয়েছে বিস্তৃত বাগান, মন্টজুইক সিমেন্ট্রি, ম্যাজিক ফাউনটেইন, গ্রিক থিয়েটার এবং ন্যাশনাল মিউজিয়াম। আমি অবশ্য শুধু বাগান দেখেই মুগ্ধ, যদিও মিউজিয়ামের সামনে ম্যাজিক ফাউনটেনটির পাশ ঘেঁষে সিঁড়ির ধাপগুলো অতিক্রম করেছি। তবে, তা আমাকে খুব একটা আকর্ষিত করেনি। কারণও ছিল, ফাউনটেন-এর জলধারা তখন বন্ধ ছিল, তাই আমি এর মহত্ত্ব বুঝতেই পারিনি। সিঁড়ির ধাপগুলো অতিক্রম করে কিছুটা সময় সেখানে বিশ্রাম নিয়ে ভেবে নিলাম এরপর যতক্ষণ হাঁটতে ভালো লাগবে ততক্ষণ পর্যন্ত পায়ে হেঁটে শহরের একদিকটা দেখবো। যেই ভাবা সেই কাজ, শীতের বেলা মিষ্টি রোদের উষ্ণতায় হাঁটতে বেশ লাগছিল। ইউরোপের পথঘাটে চলতে চলতে নিজেদের দৈন্যের কথা খুব মনে পড়ে। শুধুমাত্র টাকা-পয়সা থাকলেই যে সুন্দরের সাথে বসবাস করা যায় তা কিন্তু নয় ; তার জন্য রুচিবোধ, দেশপ্রেম সর্বোপরি কঠোর শৃঙ্খলাবোধ থাকা জরুরি। এই যে পথে হাঁটছি কোথাও কোনো আবর্জনা নেই, নেই ময়লার দুর্গন্ধ। তাদের ফুটপাত যে খুব প্রশস্ত তা নয়, তবে তা হকার আর অবৈধ জঞ্জালমুক্ত।

শুধু যে বার্সিলোনায় এমন তা নয়, ইউরোপজুড়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে প্রশস্ত উন্মুক্ত স্থানে হকার বা স্ট্রিট শপের জন্য জায়গা নির্ধারিত আছে, যেখানে পথচারী বা পর্যটকেরা চলতি পথে নানান কিছু কেনাকাটা করতে পারে। মূলত দেশীয় বা ঐতিহ্যের সাথে সম্পর্কিত পণ্যের পসরা নিয়ে এই স্ট্রিট শপগুলো সাজানো থাকে। এমনি একটা স্ট্রিট শপের পসরা দেখে থমকে দাঁড়াতেই হলো। চমৎকার হাতে তৈরি গয়না এবং ব্রোচের বাহারি সমাবেশ, এত বর্নিল যে, কোনটা রেখে কোনটা কিনি, কিন্তু সব তো আর কেনা সম্ভব না, তাই বাছাই করতে সময় লাগলো। যা হোক, অবশেষে কেনা হলো, ইচ্ছে করছিল আরো কিছু কিনে নিই, কিন্তু উপায় নেই বিদেশ-বিভূঁইয়ে টাকা হিসেব করে খরচ করতে হয়।

সময় এখন সকালের পাট শেষ করে দুপুরের পথেÑ এর মধ্যে বন্ধু দেলোয়ারের ফোন, দুপুরে একসাথে লাঞ্চ করবো তাই আমি যেন শহরের সেন্ট্রাল পয়েন্টে চলে যাই। এখন গন্তব্যÑ কাছাকাছি কোনো বাস স্টপ, যেখান থেকে শহরের কেন্দ্রে যেতে পারবো। তবে বাসস্টপে এসে রোড প্ল্যান দেখে বুঝলাম শহরের কেন্দ্রে যেতে হলে আমাকে প্রথমে বাস তারপর মেট্রো ধরতে হবে। বাস থেকে মেট্রো স্টেশন খুব কাছে হওয়ায় খুঁজে পেতে কষ্ট হয়নি, তবে মেট্রো থেকে নেমে যেন গোলক ধাঁধায় পড়লাম। কোন পথে যাবো ? শেষমেশ সেই আমার পথ-প্রদর্শক গাইড ঠরংরঃ অ ঈরঃু-এর সাহায্য নিয়েই এগুতে হলো। আসলে এরপর আমি যে-জায়গাগুলো ভিজিট করবো বলে প্ল্যান করেছিলাম তার সবক’টিই শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত এবং এগুলোর অবস্থানও খুব কাছাকাছি। ইউরোপের প্রায় সকল দেশে একই মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করলেও বার্সিলোনায় এসে দেখা গেল নেটওয়ার্কের অবস্থা বেশ খারাপ। ইউরোপের মতো উন্নত বিশে^ এ ধরনের সমস্যা যে হতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আর নেটওয়ার্কের এই দুরবস্থার কারণে শহরে ফিরে বন্ধু দেলোয়ারের সাথে আর কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। এদিকে দুপুর ফুরিয়ে বেলা বিকেলে গড়াচ্ছে, পেট জানান দিচ্ছে সকাল থেকেই পেটে ভারি কিছু পড়েনি, যার সিগনাল মাথাতে চলে গেছে, সুতরাং এখন কিছু খেতেই হবে। এখন মিশন খাবারের দোকান খুঁজে বের করা। ইউরোপের কিছু কিছু শহরে প্রচুর তার্কিশ, মিশরীয় এমনকি বাঙালি খাবারের দোকান বা রেস্টুরেন্ট থাকলেও অধিকাংশ শহরেই হালাল খাবার খুঁজে পাওয়া বেশ কঠিন। বার্সিলোনার সেন্ট্রালের চতুর্দিকে ঘুরে কোনো বাঙালি খাবারের দোকান তো দূর তার্কিশ বা মিশরীয় দোকানও খুঁজে পেলাম না। তবে অনেক খুঁজে-পেতে একটি ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের সন্ধান পাওয়া গেল। এর আগে সুইজারল্যান্ডে ও প্রাগে ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁয় খাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল, খুব ভালো বা মন্দ কোনো বিশেষণেই সেই অভিজ্ঞতাকে ব্যাখ্যা করা যায় না ; চলে কোনোমতে। রেস্তোরাঁয় ঢুকে মেনু দেখে মন খারাপ হয়ে গেল, কোনোটাই পরিচিত না। কিন্তু খেতে তো হবেই, তাই ভেজিটেবল-জাতীয় কিছু অর্ডার করলাম সাথে গ্র্যাভি ভাত ; গ্র্যাভি তরকারি হয় জানি, ভাত যে হয় তা জানা ছিল না। যা হোক, শুধু ক্ষুধা নিবারণের জন্যই খাওয়া, সাথে কিছুটা সময় বিশ্রাম নেওয়া। কারণ, সকাল থেকে ঘোরাঘুরির মধ্যেই সময় কেটেছে। খেতে খেতে আবার দেলোয়ারের সাথে যোগাযোগের বৃথা চেষ্টা। এদিকে সূর্যমামা তখন বাড়ি যাবে বলে রং বদলাচ্ছে। ইউরোপের শীতকাল, সকাল থেকে দুপুর হতে দেরি বিকেলের নাগাল পাওয়া দায়, ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে যায়। রাত পোহালে ক্রিসমাস ইউরোপের সন্ধ্যা-রাত্রি এ সময় বেশ ঝলমলে আনন্দময়। আমি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হতেই দেখি শহর তার রাতের সজ্জায় তৈরি। চারদিকে আলোর ঝলকানি। পৃথিবীতে প্রায় সকল অনুভূতিই ছোঁয়াচে। দুঃখ যেমন ছুঁয়ে যায় একজন দেখে আরেক জনে আনন্দ তেমনি ছড়িয়ে পড়ে জনে জনে। বার্সিলোনায় শহরের এই সন্ধেতে আমি নিজের মনে আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছি, শহরের ঝলমলে আলোর ছটা সবার মতো আমাকেও আনন্দিত করেছে।

আগেই বলেছিলাম, আমার ভ্রমণ-পরিকল্পনায় যে-জায়গাগুলো ছিল সেগুলো শহরের কেন্দ্রেই অবস্থিত, তাই এখন আবার গাইডের দারস্থ হলাম, কী, মনে আছে তো আমার গাইডকে। আসলে এরপর আর ভ্রমণ হয়নি যা হয়েছে তা ছিল দর্শন। শহরের কেন্দ্রে কিছু প্রাচীন স্থাপনা ও ক্যাসেল। যার কোনোটা মিউজিয়াম, কোনোটাতে রয়েছে বিভিন্ন অ্যামিউজমেন্টের ব্যবস্থা আবার কোনোটা হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মিউজিয়াম বা অ্যামিউজমেন্টের ব্যবস্থা এমন ক্যাসেলগুলোতে যে-কেউ টিকেটের বিনিময়ে প্রবেশ করে স্থানীয় ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হতে পারে, সঞ্চয় করে নিতে পারে বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। তবে, টিকেট কিন্তু অনলাইনেই কাটতে হয়, যা আমার জানা ছিল না। তবে, মিউজিয়ম বা অ্যামিউজমেন্টে আমার যে খুব আগ্রহ আছে তা বলা যাবে না, তাই আদতে এ বিষয়ে আমার কোনো আক্ষেপ কাজ করেনি। যদিও ক্যাসেলগুলোর ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি কিন্তু এর বাহ্যিক সৌন্দর্য উপভোগে তো কোনো বাধা নাই। ক্রিসমাসের মাত্র ঘন্টাকয়েক বাকি। তাই, সবকিছুর মতো এই ক্যাসেলগুলোর সাজ-সজ্জাও চোখে পড়ার মতো, মুগ্ধ হতেই হয়।

শীতের ঝলমলে উৎসবমুখর সন্ধ্যা-রাত্রির একাংশ বার্সিলোনার অলি-গলির পথে কেটে গেল। রাত ৯টায় আমি হোটেলে ফিরে এলাম। সারাদিনের ঘোরঘুরির ক্লান্তি এখন টের পাচ্ছি। ভাবলাম, ফ্রেস হয়ে হালকা কিছু খেয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বো, পরদিন সকাল সাড়ে নটায় ফ্লাইট, পরের গন্তব্য লিসবন। গোসল সেরে ল্যাগেজটাও গুছিয়ে রাখলাম যেন সকালে তাড়াহুড়ো করতে না হয়, এরপর পার্সেল করে আনা খাবার খেয়ে যখন ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন দেলোয়ারের ফোন, সে হোটেল লবিতে অপেক্ষা করছে। সারাদিন মোবাইল নেটওয়ার্কের জাটিলতায় তার সাথে আর যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। দেলোয়ারের ফোন পেয়ে নিচে এলাম তখন রাত সাড়ে দশটা হবে। অবশ্য ইউরোপে রাত সাড়ে দশটা কোনো ব্যাপার না। তাই এই সুযোগে দেলোয়ার আর আমি বেরিয়ে পড়লাম রাতের বার্সিলোনা দেখবো বলে।

আমি বার্সিলোনার যে-হোটেলে উঠেছিলাম সেটা শহরের কেন্দ্র না হওয়ায় এদিকটা বেশ ছিমছাম, নীরব। যদিও রাত পোহালে ইউরোপীয়দের সবচেয়ে বড়ো ধর্মীয় উৎসব, কিন্তু এ এলাকায় সাধারণভাবে তা বোঝার উপায় নেই। শুধুমাত্র আবাসিক হোটেলগুলোর লবি এবং বেশ দূরে দূরে অবস্থিত ছোটো ছোটো শপিং সেন্টারগুলোর সামনে ডামি ক্রিসমাসট্রির আলোক সজ্জা জানান দিচ্ছে ক্রিসমাস বেল বেজে উঠলো বলে। এছাড়া পুরো এলাকাটি নিয়ন বাতির টিমটিমে আলোয় প্রায় ঘোলাটে। তবে, এর মধ্যে কুয়াশা আর নীরবতার একটি মায়াবী রেশ আছে। রাতের এ সময়টা ঠান্ডার প্রচ- প্রকোপ সত্ত্বেও হাঁটতে কিন্তু মন্দ লাগছিল না। প্রায় ঘন্টাদেড়েক গলি ছেড়ে রাজপথের এ-বাঁক সে-বাঁক ঘুরে মাঝে মাঝে কোথাও একটু থেমে রাতের শহরের অন্য এক রূপকে উপভোগ করার চমৎকার সুযোগের সম্পূর্ণ সদ¦্যবহার করে ফিরতি পথ ধরলাম, আমাকে হোটেল পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে দেলোয়ারও ফিরে গেল। হ [চলবে]