ইউরোপের ১৫০ দিন : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার

26 Feb 2025, 01:16 PM ভ্রমন শেয়ার:
ইউরোপের ১৫০ দিন : সৈয়দা তাসলিমা আক্তার


[পূর্ব প্রকাশিতের পর]


পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে চটজলদি নাশতা সেরে তৈরি হয়ে মেট্রোর উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। আমার কাছাকাছি স্টেশন থেকে এয়ারপোর্ট প্রায় মিনিট তিরিশের জার্নি। এছাড়া হোটেল থেকে স্টেশনে যাওয়া, টিকেট কাটা মেট্রোতে ওঠা, এরপর যাত্রাÑ সব মিলিয়ে ঘণ্টা দেড়েক সময় হাতে নিয়ে বের হলাম। কাউন্টারে গিয়ে ধন্দে পড়ে গেলাম একই যাত্রায় দু’ধরনের টিকেট, একটা এয়ারপোর্ট টিকেট আরেকটা স্টেশনের নাম দিয়ে টিকেট, অর্থাৎ যে-স্টেশনে নামবো সেখানকার টিকেট। দামেরও ভিন্নতা আছে, এয়ারপোর্ট পাস টিকেটের দাম বেশি। আমি কী মনে করে যে-টিকেটটির দাম কম সেটিই কিনে নিলাম, এটা যে কত বড়ো ভুল ছিল তা চলতি পথেই টের পেলাম আর তার খেসারতও দিলাম, সময় এবং অর্থ দুটো দিয়েই। কীভাবে ? আমি যে টিকেটটি কিনেছি তা দিয়ে নির্দিষ্ট স্টেশনে পৌঁছে সেখান থেকে পাস আউট করা যাবে কিন্তু এয়ারপোর্টে ঢোকা যাবে না। সুতরাং আমাকে এয়ারপোর্টে ঢুকতে হলে অবশ্যই এয়ারপোর্ট পাস টিকেটটি সংগ্রহ করতে হবে। উপায়ান্তর না-থাকায় এয়ারপোর্টের দুটি স্টেশন আগে নেমে পুনরায় এয়ারপোর্ট টিকেট কেটে আবার মেট্রো ধরতে হলো। আর এসব কর্মকা-ে এয়ারপোর্ট পৌঁছুতে আমার মিনিট বিশেক সময় বেশি লেগে গেল আর বাড়তি টিকেটের টাকাও গচ্চা গেল। তবে, এখন মূল চিন্তা ফ্লাইট মিস হবে না তো, আসলেই হতো যদি আর দুই মিনিট দেরি হতো।

সে এক শ^াসরুদ্ধ পরিস্থিতি, আমি এয়ারপোর্টে পৌঁছে কোনো স্ক্রিনে ফ্লাইট ডিটেল দেখতে পাচ্ছিলাম না, হেল্প ডেস্কে জিজ্ঞেস করে জানলাম নেটওয়ার্ক ত্রুটি। আমার ফ্লাইট নাম্বার দিয়ে তার কাছে গেট নাম্বার জানতে চাইলে সেও তার অসহায়ত্বের কথা জানালো, আমার মোবাইলেও কোনো আপডেট পাচ্ছিলাম না। এদিকে সময় ফুরিয়ে আসছে। গেট না জেনে এত বিশাল এয়ারপোর্টে ফ্লাইট খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এখন দেখা গেল শুধু গেট না এখানে আবার দুটি জোন আছে জোন ‘এ’ ও ‘বি’। অবশেষে গেট নাম্বার উদ্ধার করে আমি ভুল জোনে অর্থাৎ জোন ‘বি’-তে বেশ খানিকটা গিয়ে আবার ফিরে এলাম। এরপর শুধু দৌড়, জীবনে কোনো দিন দৌড় প্রতিযোগিতায় কোয়ালিফাই করতে না পারলেও দৌড়ে ফ্লাইটটা ঠিকই ধরতে পারলাম এবং এই ফ্লাইটে শেষ যাত্রী আমিই ছিলাম। গেট বন্ধ হওয়ার ঠিক মাঝপথে আমি পৌঁছালাম। অবশ্য এর মধ্যেই মনে মনে ভেবে নিচ্ছিলাম ফ্লাইট মিস হলে কী হবে, কী করবো। একে তো লম্বা ছুটি, তার ওপর ক্রিসমাস, এই সময়ে যেকোনো পথের টিকেট ম্যানেজ করা সত্যিই কঠিন হতো। যাক, শেষ পর্যন্ত প্লেনে চড়ে দম নিতে পারলাম, এরপর ঘণ্টা দুয়েকের আকাশযাত্রা শেষে লিসবন এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম।

এ যাবৎকাল ইউরোপের যে-কয়েকটি দেশে গিয়েছি প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এয়াপোর্টের লাগোয়া মেট্রো স্টেশন পেয়েছি, সেটা বেশ সুবিধাজনক, কিন্তু এখানে এসে মেট্রোর খোঁজ করে জানলাম, বাসে করে মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত যেতে হবে। একটু দ্বিধায় ছিলাম বাস-মেট্রো একটু ঝামেলা হয়ে গেল কি না, বাস থেকে কোথায় নামবো, ঠিক বাসটি নির্বাচন করে নির্দিষ্ট স্টপে নামতে পারবো তো ! কারণ, বাস স্টপে বেশ কিছু বাস ছিল, ভাষাগত সমস্যার কারণে স্টপে সঠিক কোনো নির্দেশ পাচ্ছিলম না। এসব চিন্তা করে ট্যাক্সি নেবো সিদ্ধান্ত নিলাম। ট্যাক্সির বিষয়ে জানতে ইনফরমেশন ডেস্কে গেলে তারা জানালো বাস সরাসরি মেট্রো স্টেশনে নামাবে শুধু শুধু ট্যাক্সি ভাড়া গোনার কোনো দরকার নেই, আমি যেন নিশ্চিন্ত মনে বাসে উঠে পড়ি, তাদের আমার গন্তব্যে ঠিকানা দিয়ে বাস নাম্বারটি জেনে নিলাম। এটা মূলত স্যাটল সার্ভিস। বাসে এয়ারপোর্ট থেকে মেট্রো স্টেশন যেতে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ মিনিট। এরপর মেট্রোতে শহরের কেন্দ্রে পৌঁছুতে সময় লাগে প্রায় ২০ মিনিট, অর্থাৎ শহর থেকে এয়াপোর্টে যেতে বা এয়ারপোর্ট থেকে শহরে যেতে সব মিলিয়ে সময় লাগে প্রায় আধঘন্টা। আমি যখন শহরে পৌঁছি তখন দুপুর, মেট্রো স্টেশন থেকে বের হয়ে ঠিকানা নিশ্চিত হওয়ার জন্য আশেপাশে খোঁজ করতে একটি দোকানের সন্ধান পেয়ে যাই, যার আদল আমাদের দেশের মুদি দোকানের মতো। সেখানে গিয়ে কাউকে না-পেয়ে একটু উচ্চস্বরে কেউ আছেন কি না জানতে চাইলে ভেতর থেকে একজন ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন, তাকে আমার গেস্ট হাউজের ঠিকানাটি কোন দিকে জানতে চাইলে তার প্রথম কথা ছিল ‘আপনি কি বাংলাদেশি’? এরপর তো সবকিছু আরও সহজ হয়ে গেল, ভদ্রলোক আমাকে সহজ করে দিক বুঝিয়ে দিলেন। সেখান থেকে আমার গন্তব্য ছিল পায়ে হেঁটে মাত্র মিনিট পাঁচেকের পথ।

গেস্ট হাউজে পৌঁছে নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখলাম সেটা তালাবদ্ধ অবস্থায় আছে, ফ্ল্যাট ওনারকে ফোন করলে সে জানালো দরজার সামনে যে র‌্যাগ/পাপোস বিছানো আছে তার নিচে চাবি রাখা আছে। এটা খুব মজার, এয়ার বিএনবি থেকে হোমস্টে বা হলিডে হোমস ভাড়া করলে এ ধরনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা যায়। যেমন প্রাগে যখন এমন একটা হলিডে হোমস নিয়ে ছিলাম তখন সেখানে পাসওয়ার্ড দেওয়া তালা ছিল ; আমরা পৌঁছানোর পর সে তা এসএমএস করে। ফ্ল্যাটে ঢুকে মনটা ভালো হয়ে গেল, এটা একটা স্টুডিও এপার্টমেন্ট, টপ ফ্লোরে হওয়ায় পুরো ডাইনিং স্পেসে স্কাই লাইটের ব্যবস্থা আছে। একপাশে বেডরুম অন্যপাশে ওয়াশরুম এর মাঝে ডাইনিং কাম কিচেন। পরিপাটি করে সাজানো প্রতিটা রুম। সকাল থেকে জার্নির যে-ধকল তা থেকে মুক্তি পেতে গোসল সেরে নিলাম। গত দু’দিন খাওয়া-দাওয়া খুব একটা যুৎসই হয় নাই, মনে হচ্ছিল এক কেজি চালের ভাত খেয়ে নিতে পারবো। কিন্তু প্রশ্ন হলো ভাত পাওয়া যাবে তো ! এই সংশয় নিয়েই পথে নামলাম ভাতের খোঁজে। প্রথমেই সেই বাংলাদেশি ভাইয়ের দোকানে গেলাম ভাতের হোটেলের সন্ধান জানতে। সেখানে গিয়ে আমি সরাসরি জানতে চাইলাম, ভাত কোথায় পাওয়া যাবে, আমার প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক হেসে দিলেন। বললেন, বিদেশে এলে অধিকাংশ বাংলাদেশিদের এই এক সমস্যা, একবেলা ভাত খেতে না পারলে অস্থির হয়ে পড়ে। তবে, আমার ক্ষেত্রে এটা কিন্তু এক/দু বেলার বিষয় ছিল না গত দুইদিন আমি ভাত খাইনি। কীসব খাবার যে খেলাম, স্বাদ-গ›ধ কিছুই পাইনি, শুধু ক্ষুধা নিবারণের জন্য খাওয়া। ভদ্রলোক আমার আকুতি বুঝলেন। তিনি একদম ম্যাপ এঁকে আমাকে লোকেশন বুঝিয়ে দিলেন তারপরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমাকে কিছুটা পথ এগিয়ে দিলেন। পথ মোটামুটি সহজ থাকায় খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। নির্ধারিত লোকেশনে পৌঁছে আমি তো রীতিমতো চমৎকৃত, মনে হলো যেন ঢাকার নীলখেত মোড়ে চলে আসছি। আবহ অনেকটা সে-রকমই, জায়গাটির নাম মুরিয়াÑ হোটেল রেস্তোরাঁ, মুদিখানা, সেলুন, ফটোকপি, মোবাইল শপ ; কী নেই এখানে। আর তার প্রায় সবই বাংলাদেশিদের। দেখে-শুনে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম, মেনু দেখে অর্ডার করলাম গোরুর গোস্ত, ভাত ও ডাল। মনে হলো যেন অমৃত খেলাম। এজন্যই বলে ভেতো বাঙালির ভাত ছাড়া গতি নেই। এর মধ্যে বন্ধু দোলোয়ারের ফোন, তারাও লিসবনে এসে পৌঁছেছে, পরে জানলাম আমরা একই ফ্লাইটের যাত্রী ছিলাম, যদিও এয়ারপোর্ট বা প্লেনে দেখা হয়নি। যাহোক, দেলোয়ারও লাঞ্চ করবে বলে বের হয়েছে আমি তাকে লোকেশন পাঠালাম চলে আসার জন্য।

লাঞ্চ শেষ হতে হতে দেখা গেল বেলা পড়ে যাচ্ছে, আজ ক্রিসমাস তাই সন্ধে হতে ধরলেও শহর কিন্তু আলো ঝলমলে। লিসবন শহরটি পর্তুগালের অন্যতম বৃহত্তম শহর যা তাগুস নামের একটি নদী দ্বারা বিভিক্ত ছিল। আমি পর্তুগালের যে-অংশটি ভ্রমণ করেছি সেটার অবস্থান ছিল তাগুস নদীর দক্ষিণে একই দিকে আটলান্টিকেরও অবস্থান। আপাত দৃষ্টিতে শহররের এ অংশটির বিস্তৃতি খুব বেশি না। আমার দু’দিনের লিসবন সফরের প্রায় পুরোটা সময় আমি পায়ে হেঁটে শহর দেখেছি। লিসবনের সাথে রোমের একটা মিল আছে, এখানে প্রচুর বাংলাদেশি ও বাংলাভাষী রয়েছে। রেস্টুরেন্ট, সুভ্যেনির শপ এমনকি টমটমওয়ালা প্রায় সবাই বাংলাদেশি। ও আচ্ছা, লিসবনে টমটম একটি জনপ্রিয় সৌখিন বাহন, বিশেষ করে ইউরোপীয় পর্যটকদের কাছে এটি বেশ সমাদৃত। আমরা শহরের যে-অংশ থেকে নগর প্রদক্ষিণ শুরু করলাম সেটার আদল অনেকটা আমাদের পুরোনো ঢাকার মতো। অলিগলি উচুঁ-নিচু পায়ে চলার পথ, অনেক বাড়ির ঝুলবারান্দার খানিকটা পথের উপর ঝুলে আছে। রাস্তার ওপরেই ঘরের দরজা, কোনো লন বা উঠোনের বালাই নেই। বাড়িগুলোতে আলো-বাতাসের যথেষ্ট অভাব, এটা বাইরে থেকেই টের পাওয়া যায়। তবে, সবকিছুই পরিপাটি আর পরিচ্ছন্ন। চলতে চলতে ক্লান্তি এলেও অস্বস্তি হয় না। হ [চলবে]