অদ্ভুত সুন্দর কিছু সমুদ্র সৈকত

24 Apr 2022, 12:46 PM অন্যান্য শেয়ার:
অদ্ভুত সুন্দর কিছু সমুদ্র সৈকত

সমুদ্র মানেই স্বচ্ছ নীল জলরাশির বালু তীরে আছড়ে পড়া। দূর দিগন্তে নীল সমুদ্রে সূর্যের উঠে পড়া, ঘুমিয়ে যাওয়া দেখা। সাগর তীরে ঝাউ অথবা পাম গাছের হঠাৎ দেখা পাওয়া। শামুক অথবা শৈবাল খুঁজে বেড়ানো। আমাদের সমুদ্র তীরের অভিজ্ঞতা বলতে তো এরকমই। কিন্তু পৃথিবীতে অনেক বিচিত্র সমুদ্র সৈকত রয়েছে, যা অদ্ভুত বিচিত্র ও সুন্দর সে-সব সমুদ্র সৈকত নিয়ে আমাদের এবারের বিশেষ আয়োজন...


মালদ্বীপের গ্লোয়িং বিচমালদ্বীপের ভাধু দ্বীপের সমুদ্র সৈকতটি দেখলে মনে হবে রাশি রাশি উজ্জ্বল হীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এই সৈকতটি মূলত বায়োলুমিনেসেন্ট বিচ। বায়োলুমিনেসেন্ট হচ্ছে কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণীর আলোক নিঃসরণের ক্ষমতা। সে-সব সৈকতে প্ল্যাংকটন-জাতীয় উদ্ভিদ থেকে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে আলোক নিঃসারিত হয় তাদেরকে বায়োলুমিনেসেন্ট বিচ বলে।

সমুদ্র তীরে অবস্থিত হাজার ফাইটোপ্ল্যাংকটন উদ্ভিদ ঢেউয়ের আঘাতে আলোক নিঃসরণ করে। ফলে রাতের বেলা এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। মনে হয় সমুদ্রের বুকে হাজার হাজার নক্ষত্র নেমে এসেছে।ক্যালিফোর্নিয়ার কাচ সৈকতসমুদ্র সৈকতে কাচের টুকরো থাকবে এটা কেউই চাইবে না।

কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের ফোর্ট ব্র্যাগে এরকম অন্তত তিনটি সৈকত রয়েছে যেগুলো রংবেরঙের মসৃণ কাচের টুকরো দিয়ে আবৃত। জানা যায় এই জায়গাগুলো মূলত একসময় শহরের বর্জ্য নিষ্কাশনের স্থান ছিল। অনেক বছর ধরে মানুষের ফেলে যাওয়া জৈব বর্জ্যগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে গেছে, ভারি লোহার টুকরোগুলো মরিচা পড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। শুধু কাচের টুকরোগুলো যুগ-যুগ ধরে তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের আঘাতে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে নুড়ি পাথরের মতো মসৃণ হয়ে গেছে। প্রকৃতি ঠিকই মানুষের অযত্নে ফেলে যাওয়া জিনিসকে তার ইচ্ছেমতো রূপ দিয়েছে। এই ব্যতিক্রমধর্মী কাচের সৈকতটি মূলত কর্তৃপক্ষ দ্বারা সংরক্ষিত। মানুষ এখানে বেড়াতে পারে কিন্তু কাচের টুকরোগুলো সরিয়ে নিতে পারে না।

সাইবেরিয়ায় সমুদ্র তীরবর্তী একটি কাচ তৈরির কারখানাও তাদের ত্রুটিপূর্ণ কাচগুলো সমুদ্রে নিক্ষেপ করার মাধ্যমে একটি সৈকত তৈরি করতে পেরেছে।নিউজিল্যান্ডের গরম পানির সৈকত
এই সমুদ্র সৈকতটি নিউজিল্যান্ডের মার্কারি উপসাগরের করোমান্ডেল উপদ্বীপে অবস্থিত। এই সৈকতে মানুষ যায় বালতি ও কোদাল নিয়ে। কারণ এই সৈকতের বালির নিচ দিয়ে উষ্ণ পানির ধারা প্রবাহিত হয়। দিনে দু’বার ভাটার আগে এবং পরে এখানে মাটি খুঁড়লে গরম পানি উঠে আসে। ভ্রমণকারীরা তাই মাটি খুঁড়ে কৃত্রিম জলাধার তৈরি করে, সেখানে বসে থাকে। পৃথিবীর বেশ কিছু স্থানে আগ্নেয়গিরির প্রভাবে সৃষ্টি হওয়া ভূ-গর্ভস্থ জলাধার রয়েছে। এই স্থানটিও সেরকম। ভূ-গর্ভে পানির উষ্ণতা অনেক বেশি হলেও সৈকতের মাটি খুঁড়ে সর্বোচ্চ ৬৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বিশিষ্ট পানি পাওয়া যায়। এটি পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় স্থান। বছরে প্রায় সাত লক্ষ পর্যটক এই সৈকতে ভ্রমণ করে।ব্রাজিলের মরুভূমির সৈকত
এটি আসলে মরুভূমি নয়।

এটি ব্রাজিলের উত্তর-পূর্বের মারনাহাও অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত ‘মারনহাওয়ের বিছানাচাদর’ খ্যাত ন্যাশনাল পার্ক। এটি আমাজন অববাহিকায় বিশাল এলাকাজুড়ে পলিমাটি থেকে সৃষ্টি হওয়া বালিয়াড়ি। প্রতিবছরের কয়েক মাস পর্যন্ত এখানে ৪৭ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়। এটি বালিয়াড়ির তলদেশে অবস্থিত অভেদ্য শিলার উপস্থিতির ফলে এই পানি অন্য কোথাও যেতে না পেরে বালিয়াড়ির উপত্যাকাতেই জমা হতে থাকে এবং স্বচ্ছ নীল রঙের উপহ্রদের সৃষ্টি করে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের দিকে যখন উপত্যকাগুলো পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে উপচে পড়ে তখন বালিয়াড়িকেই সৈকত মনে হয়। অদ্ভুত এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার জন্যও লাখ লাখ ভ্রমণপিপাসু মানুষ যায় এই জায়গায়।বাহারাম গোলাপি সৈকতবাহারাম দ্বীপপুঞ্জের হারবার দ্বীপটিকে সবাই গোলাপি সৈকত হিসেবেই চেনে। দ্বীপটির পূর্ব প্রান্তে প্রায় তিন মাইল জুড়ে গোলাপি রঙের বালি দেখা যায়। ফোরমিনিফেরা নামক একপ্রকার অতি ক্ষুদ্র এককোষী প্রাণী এই সৈকতে থাকার কারণে বালি গোলাপি দেখায়। কারণ, এই প্রজাতির খোলসের রং গোলাপি। ফোরাম নামে পরিচিত এই প্রাণীগুলো দেখতে অনেকটা স্ট্রবেরির মতো হয়। তীর থেকে দূরে বিপুল সংখ্যায় হয় এবং ঢেউয়ের সঙ্গে তীরে এসে বালির সঙ্গে সৈকতে এসে মেশে। বাহারাম এলিউথেরা দ্বীপেও এ ধরনের গোলাপি সৈকত রয়েছে।নিউজিল্যান্ডের ডিম্ব সৈকত
নিউজিল্যান্ডের কোকোহ সৈকতটিতে গেলে মনে হবে এ যেন ভিন্ন কোনো গ্রহ। কারণ, বিশাল বড়ো বড়ো ডিম্বাকৃতি পাথরগুলোকে ডাইনোসরের ডিম বললে ভুল হবে না। সৈকতটির অদ্ভুত এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই এটি পর্যটক এবং ফটোগ্রাফারদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।

এই পাথরগুলো মূলত একধরনের পাললিক শিলা যা প্রায় ৫.৬ কোটি বছর আগের সৃষ্টি। এগুলোর ব্যাস ১.৫ থেকে ২.৫ মিটার পর্যন্ত। দীর্ঘকাল এগুলো পর্বতের দেয়ালে বাঁধের আড়ালে ছিল। বর্তমানে ঢেউয়ের স্রোতের কারণে এগুলো সৈকতে এসে পড়েছে। ঢেউয়ের কারণে অনেক পাথরে ফাটল তৈরি হয়েছে। ফলে মনে হয় ডাইনোসরের ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবে বুঝি। এই সৈকতটি দারুণ আকর্ষণীয় পর্যটকদের কাছে।মেক্সিকোর লুকানো সৈকতম্যারিয়েটা হিডেন বিচটি মেক্সিকোর পুয়ের্তো ভ্যালার্তা উপকূল থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই পুরো সৈকতটি বিশাল একটি গুহার মধ্যে অবস্থিত, যার ছাদের আছে বিশাল এক গর্ত। এই দ্বীপে যেতে হলে এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে হয়। এরপর নৌকা রেখে সাঁতার কেটে সৈকতে প্রবেশ করতে হয়। কষ্ট করে এই সৈকতে প্রবেশ হলেই সব কষ্ট দূর। গুহার ভেতর এই সৈকতটি অন্য যেকোনো সৈকতের চেয়ে ভিন্ন। বাইরের সাথে একমাত্র যোগাযোগ স্থাপিত হয় ছাদের খোলা অংশ দিয়ে আসা সূর্যের আলোর মাধ্যমে। এই সৈকতটি মূলত আগে পুরোটাই আবৃত ছিল। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমার আঘাতে কিছু জায়গায় ছাদগুলো ভেঙে পড়ে। মেক্সিকো সরকার দীর্ঘদিন এ সব এলাকায় বোমা বর্ষণের অনুশীলন চালায়। কিন্তু ছয়ের দশকে তারা অনুশীলন বন্ধ করে দেয় এবং দ্বীপগুলোকে ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে মর্যাদা দেয়।স্পেনের গির্জা সৈকত
এই সৈকতটির নাম পবিত্র পানির সৈকত। প্রাচীন ভগ্ন গির্জার মতো দেখতে বিশেষ ধরনের পাথরের তৈরি প্রাকৃতিক খিলান এবং গুহার উপস্থিতির জন্য পর্যটকদের কাছে এটি ক্যাথেড্রাল সৈকত বা গির্জা সৈকত নামে পরিচিত। মূলত ভাটার সময়ই এই জায়গাগুলোতে যাওয়া যায়। জোয়ারের সময় পানিতে এর অধিকাংশই তলিয়ে যায় এবং সৈকতটি সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। এই সমুদ্রে সাঁতার কাটার চেয়ে উপরে দাঁড়িয়ে দৃশ্য বেশি উপভোগ্য।

লেখা : ফাতেমা ইয়াসমিন