অনির্বাণ প্রাণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান -ইকবাল খোরশেদ

22 Aug 2023, 01:34 PM নিবন্ধ শেয়ার:
অনির্বাণ প্রাণ  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান  -ইকবাল খোরশেদ

আমরা যখন বাংলাদেশ নিয়ে ভাবি, তখন মনের পর্দায় ভেসে ওঠে বাংলাদেশের সবুজ পতাকা, মাঝের লাল বৃত্তের ভেতরে এক মহান পুরুষের মুখচ্ছবিÑ তিনি আর কেউ নন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির স্বাধীন আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার স্থির লক্ষ্যে অবিচল থেকে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়েছেন, কোথাও কোনো দিন কোনো চাপের মুখে মাথা নত করেন নি, কোনোদিন কোনো অন্যায়ের সাথে আপস করেননি। বাঙালিকে স্বাধীন আবাসভূমির স্বপ্ন দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অহ্বান জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। মুক্তিসংগ্রামে বিজয়ী হয়েছেন তিনি। ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো’ কেবল অন্দোলনের স্লোগানই ছিল না, ছিল মানুষের প্রাণের আকুতি। জাগ্রত বাঙালিকে সাথে নিয়ে বাঙালির জন্য স্বাধীন আবাসভূমি এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তাই বঙ্গবন্ধুই বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক, বাঙালি জাতির পিতা।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মধুমতির শাখা বাইগার নদীকূলের প্রাকৃতিক শোভা ও সেই প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা মানুষের জীবন প্রণালি দেখে, তাদের সুখ-দুঃখের নিত্যসাথি হয়ে বেড়ে উঠেছেন বঙ্গবন্ধু। বাবা শেখ লুৎফর রহমান আর মা সায়েরা খাতুন আদর করে ডাকতেন ‘খোকা’। টুঙ্গিপাড়ার সেই খোকা বড়ো হয়ে প্রথমে হয়েছেন শেখ সাহেব, তারপর মুজিব ভাই, তারপর বঙ্গবন্ধু এবং তারও পর জাতির পিতা। দীর্ঘ তেইশ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করে তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর ডাকে ও আদর্শিক নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলার কৃষক-শ্রমিক-চাকুরে-ছাত্র, তরুণ-প্রৌঢ়-কিশোর নারী-পুরুষ স্বাধীন করেছে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর তৃতীয় বিশে^র যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কী ক্যারিশমা দেখিয়েছেন তা সচরাচর আলোচিত হয় না। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা বঙ্গবন্ধুর সাম্যবাদী চেতনা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তাঁর গৃহীত উদ্যোগ ও তা বাস্তবায়নে তাঁর অবদান বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা উপস্থাপন করার প্রয়াস পাবো।

শোষণের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িক ও অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই বঙ্গবন্ধু বুঝেছেন, এই রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাঙালি জাতিকে শাসন ও সব অর্থে শোষণ করার যাবতীয় কলাকৌশল। আর তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীন সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য নতুন করে আন্দোলন-সংগ্রামে ব্রতী হয়েছেন তিনি। পাকিস্তান সরকারের জাতিগত শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আর শোষকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে বঙ্গবন্ধু মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে প্রায় ১৩ বছর কারগারের কাটিয়েছেন। স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজের জীবনের বিনিময়ে বাঙালি জাতির জন্যই রচনা করেছেন ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। আজীবন ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে দারিদ্র্যপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে এমন এক অনন্য ভূমিকা রেখেছেন, যার তুলনা পৃৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যেসব জাতীয় আন্দোলন হয়েছে বিশেষত ৬-দফা, ১১-দফা এবং সবশেষে এক দফা, সেগুলোর সবই ছিল কোনো-না-কোনোভাবে জাতিগত শোষণের বিরুদ্ধে। আপাতদৃষ্টিতে স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালিত হলেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ধারাবাহিক এইসব আন্দোলন ছিল সব ধরনের শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির জাতীয় মুক্তি-আন্দোলন। সে-সময়ে পাকিস্তানের ২২টি ধনী পরিবারই ছিল পাকিস্তানের শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর প্রতিভূ। তাদের কোষাগারেই সমগ্র পাকিস্তানের শোষিতদের শোষণ করে পাওয়া অর্থ-সম্পদ গিয়ে জমা হতো। কেননা, পাকিস্তানের ব্যাংক-বীমা, বৃহৎ শিল্পের প্রায় সবটাই ছিল এই ২২ পরিবারের মালিকানাধীন। পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই পাকিস্তানে সৃষ্টি করা হয় চরম আঞ্চলিক ও জাতিগত বৈষম্য। আর এসবের বিরুদ্ধেই ছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবনের সংগ্রাম।

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৯ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে দেওয়া বক্তৃৃতায় বঙ্গবন্ধুর তেজদীপ্ত কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল, “দুনিয়ার যেখানেই মজলুম মানুষ সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে, আমরা নিশ্চয়ই তার পাশে গিয়ে দাঁড়াব।” মূলত, মননে-মগজে বঙ্গবন্ধু ছিলেন সারাদুনিয়ার শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের নেতা। দুনিয়ার যেখানেই মানুষের ওপর অত্যাচার ও নিপীড়ন হয়েছে, সেখানেই পৌঁছে গেছে বঙ্গবন্ধুর হুঙ্কার। তাদের তিনি সাহস জুগিয়েছেন, পাশে থাকার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সবসময়। শোষকের বিরুদ্ধে শোষিতের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে আলজেরিয়াতে অনুষ্ঠিত চতুর্থ জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছেন- “বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্তÑ শোষক এবং শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।” আলজেরিয়ার ওই সম্মেলনে সমাজতান্ত্রিক কিউবার মহান নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছেন, “আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় এই লোকটি হিমালয়সম।” এ শুধু বঙ্গবন্ধুর প্রশংসাই ছিল না ; এ ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শোষণবিরোধী দিকটির প্রতি উজ্জ্বল এক স্বীকৃতি। সম্মেলনে দু-দফা বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ৮ সেপ্টেম্বর স্বাগত ভাষণে সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন, ‘উপনিবেশবাদ, সা¤্রাজ্যবাদ, বর্ণবাদবিরোধী মজলুম জনগণের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন জানাতে জোটনিরপেক্ষ নীতি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”

বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক চেষ্টায় ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভ করে। এর কয়েকদিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বক্তৃৃতা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই ভাষণটি ছিল সমগ্র বিশ্বের অধিকারহারা শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার ভাষণ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার বলিষ্ঠ উচ্চারণ ও সাহসী পদক্ষেপ। জাতিসঙ্ঘের ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, “বিশ্বের বহু অংশে এখনো অবিচার ও নিপীড়ন চলিতেছে। অবৈধ দখলকৃত ভূখ- পুরোপুরি মুক্ত করার জন্য আমাদের আরব ভাইদের সংগ্রাম অব্যাহত রহিয়াছে এবং প্যালেস্টাইনি জনগণের বৈধ জাতীয় অধিকার এখনো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয় নাই। উপনিবেশ বিলোপ প্রক্রিয়ার যদিও অগ্রগতি হইয়াছে কিন্তু এই প্রক্রিয়া এখনো চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছায় নাই, বিশেষ করিয়া আফ্রিকার ক্ষেত্রে এই সত্যটি স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। এই অঞ্চলের জিম্বাবুয়ে এবং নামিবিয়ার জনগণ জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য দৃঢ়তার সঙ্গে লড়াই করিয়া যাইতেছে।”

বঙ্গবন্ধু বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। তাই তিনি নিজের জীবন বিপন্ন করে দীর্ঘ তেইশ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। তাঁর সারাজীবনের সাধনা ছিল মানুষের মুক্তি। সে মানুষ দুনিয়ার যে প্রান্তেরই হোন না কেন। বঙ্গবন্ধু সর্বদাই শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসার মর্যাদা তিনি রক্ত দিয়ে পরিশোধ করে গেছেন। আজ বিশ্বব্যাপী যেখানেই মুক্তির সংগ্রাম সেখানেই বঙ্গবন্ধু অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর নির্ভেজাল স্বদেশি চিন্তা-চেতনা থেকে বিশ^নেতারা এখন প্রতিনিয়ত শিখছেন।

বঙ্গবন্ধুর সাম্যবাদ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল একটি স্বাধীন দেশেরই স্বপ্ন দেখেননি। সেই দেশে একটি সাম্যের সমাজ বিনির্মাণেরও স্বপ্ন দেখেছেন এবং সেইমতো নানারকম পরিকল্পনা প্রণয়ন ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর বিভিন্ন ভাষণে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমতা বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা ও কর্মসূচি স্পষ্ট করেছিলেন। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে বলেছেন, “এদেশকে আমরা গড়ে তুলব। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে।” স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি। বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। পাকিস্তানিদের অর্থনৈতিক বৈষম্যমূলক কর্মকা- এবং বাইশ পরিবারের কুক্ষিগত সম্পদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করে বিজয়ী হওয়া বঙ্গবন্ধু জানতেন বৈষম্যের অবসান ঘটাতে না পারলে অর্থনৈতিক মুক্তি তথা সোনার বাংলা গড়া যাবে না।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হবে সাম্যের বাংলাদেশÑ এই ভাবনা থেকেই তিনি বাংলার সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন। দেশের মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য জাগিয়ে তুলেছেন। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাÑ এই মূল চারনীতিতে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গঠন করতে চেয়েছেন। মূল চারনীতির অন্যতম নীতি হলো সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র্রে মেহনতি মানুষের কল্যাণ এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব, তা বঙ্গবন্ধুর মনে তরুণ বয়সেই জায়গা করে নিয়েছে। সমাজতন্ত্র বলতে তিনি প্রধানত শোষণমুক্ত ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার কথা ভাবতেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে চীন ভ্রমণের পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সমতাভিত্তিক রাষ্ট্রের পার্থক্য তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন,“তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হল তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এ দেশ ও এ দেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউই নন।”

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ব্যক্তিমালিকাধীন ভূমির পরিমাণ ৩৭৫ বিঘা থেকে কমিয়ে ১০০ বিঘা করেছেন বঙ্গবন্ধু। এর ফলে উদ্বৃত্ত হওয়া খাসজমি ভূমিহীন কৃষকদের মাঝে বিতরণ করে বঙ্গবন্ধু সম্পদ-বৈষম্য হ্রাসে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সংবিধানের ১৩ [ক] [খ] [গ]-তে সম্পদের যথাক্রমে রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী ও ব্যক্তিগত মালিকানার বিধান রেখে সব শ্রেণির মানুষের সম্পদ অর্জনের অধিকার নিশ্চিত করেছেন। সাম্যের সমাজ গঠনের জন্য দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার নেওয়ার পরপরই তিনি ব্যাংক, বীমা, কাপড়ের কল, পাটকল চিনিকল জাতীয়করণ করার ব্যবস্থাগ্রহণ করেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, পুঁজিবাদী অর্থনীতি দর্শনগতভাবেই মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন : “আমি নিজে কমিউনিস্ট নই, তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি।”

সামাজিক শান্তি ও ধনবৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠাই আধুনিক রাষ্ট্রের বড়ো চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের যুগপৎ ভালো দিকগুলোকেই ব্যবহার করেছেন বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, সম্পদ-বৈষম্য হ্রাস এবং সামাজিক ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণে। এখানেই নিহিত রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা।


বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গঠনের স্বপ্ন

বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্ন দেখাতেন। স্বপ্ন দেখতেন একটি শোষণহীন, ক্ষুদা ও দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্র্রদায়িক স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধু লাল-সবুজের ক্যানভাসে একটি সৃজনশীল ও রুচিশীল বাংলাদেশের ছবি আঁকতে নিরন্তর চেষ্টা করেছেন। সেই ক্যানভাসের কোনো অংশেই হিং¯্রতা, শত্রুতা, খুন, নারীর প্রতি সহিংসতা, শ্লীলতাহানি, রাহাজানি থাকবে না। থাকবে না সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। জঙ্গিবাদের কোনো অস্তিত্ব দেশের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। নারী-পুরুষের মধ্যে কোনোরকমের লৈঙ্গিক বৈষম্য বিরাজ করবে না। ফুলের মতো শিশুরা বেড়ে উঠবে মুক্ত বাতাসে, সবুজ আঙিনায়। স্বপ্নের বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু তাঁর সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েছেন।

দেশ হানাদার মুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে উপহার দিয়েছেন একটি আদর্শ সংবিধান। ১৯৭২-এর এই সংবিধানের প্রধান চারটি মূলনীতি ছিল, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র। যা ছিল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার মূল ভিত্তি। এই মূল চারনীতির ওপর ভিত্তি করেই তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন মানুষের মুক্তি আর শোষণহীন সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার। একটি উন্নত ও স্বাবলম্বী জাতি গঠনে তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় ছিল।

বঙ্গবন্ধু সবসময়ই শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার স্বপ্ন দখেতেন। সারাক্ষণ নির্যাতিত-শোষিত-হতদরিদ্র্র-মেহনতি মানুষের মুক্তির কথা ভাবতেনÑ যা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর প্রতিটি কাজে, চিন্তায়, জীবনাচরণে ও রাজনৈতিক দর্শনে। বাংলার গরিব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন, সোনার বাংলা গড়বেন- এ-ই ছিল তাঁর জীবনের পরম ব্রত। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য- এই মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের মাধ্যমে বাংলার মানুষ উন্নত জীবন পাবে, দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে, বেকারত্ব দূর হবেÑ সেই ভাবনাই ছিল প্রতিনিয়ত তাঁর মনে।

স্বাধীন বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে বেরিয়ে দেশে ফিরে এসে যে ধ্বংসযজ্ঞের ওপর দাঁড়িয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের দায়িত্বভার নিয়েছিলেন তা পালন করা ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং। পাকিস্তানি সৈন্যরা এদেশের বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস ভবন এবং সড়ক ও রেলপথ ধ্বংস করে দিয়েছে। গুদামে খাদ্য নেই, মাঠে ফসল নেই, কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ শূন্য, সড়ক ও রেলপথ বিচ্ছিন্ন, নৌ ও সমুদ্রবন্দরগুলো বিধ্বস্তÍ, স্কুল-কলেজগুলো ছিল পরিত্যক্ত সেনাছাউনি। এক কোটি শরণার্থীসহ দুই কোটি বাস্তুহারা মানুষের অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করার কাজটি ছিল খুবই কঠিন।

বিপুল ধ্বংসযজ্ঞের ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু কালবিলম্ব না করে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জানুয়ারি সকাল থেকেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। সেদিনই মন্ত্রিসভার সঙ্গে দু’দফা বৈঠক করেন এবং বৈঠকে সংবিধান প্রণয়নসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রথমে সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। এর পাশাপশি বঙ্গবন্ধু সবার আগে গুরুত্ব দিয়েছেন জোটনিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের স্বীকৃতি আদায় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্যপদ লাভের বিষয়ে। এই প্রচেষ্টায় অত্যন্ত সফল হয়েছেন তিন। মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে বাংলাদেশ ১২১টি দেশের স্বীকৃতি এবং জাতিসঙ্ঘ-সহ ৩৬টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর কূটনৈতিক দক্ষতা ও দূরদর্শিতা এত অনন্যসাধারণ ছিল যে, বিজয়ের মাত্র তিন মাসের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের মিত্রবাহিনীর ভারতীয় সৈনিকেরা বাংলাদেশ ছেড়ে যান।

খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আমদানি করার জন্য এবং দেশের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় দ্রুত পৌছে দেওয়ার জন্য সমুদ্র ও নদীবন্দরগুলো সংস্কার করেন ; পাশাপাশি সড়কপথ, রেলপথ মেরামত করা ও বেসামরিক বিমান চলাচল শুরুর ওপর গুরুত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধে বিদ্যুৎব্যবস্থাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু ট্রান্সমিশন ও বিতরণ লাইন নির্মাণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে জোর দেন।

খাদ্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দেন। চাষাবাদের ক্ষেত্রে নতুন যান্ত্রিক-পদ্ধতি প্রবর্তনের লক্ষ্য স্থির করেন। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষকদের মাঝে সার, ওষুধপত্র ও উন্নতমানের বীজ বিতরণের ব্যবস্থা করেন। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে দেশ পুনর্গঠনে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন। তাঁর কূটনৈতিক নীতি ছিল ‘সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, কারো সাথে বৈরীতা নয়।’ ফলে বন্ধু-রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশকে, বঙ্গবন্ধুকে, সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার, শিল্পকারখানায় রাষ্ট্রীয় মালিকানা, সমবায় গঠন, কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তি, জনগণের মৌলিক চাহিদা : অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা-সহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা, কর্মের অধিকার, যুক্তিসংগত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা, নিরক্ষরতা দূর করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার, সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিতকরণ। ভারত থেকে ফিরে আসা এক কোটি ও দেশের ভেতরে বাস্তুহারা এক কোটি, এই দুই কোটি মানুষের পুনর্বাসন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দ্রুততম সময়ে।

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৯-এ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে শিল্প-সংস্কৃতি সমৃদ্ধ সৃজনশীল মানবিক বাংলাদেশ গঠন এবং বাঙালির হাজার বছরের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য ধরে রেখে আরো সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি গঠন করেন।

‘যে নদী হারায় স্রোত চলিতে না পারে সহস্্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে’। স্রোতহারা নদীর মতো এ জাতিও পথ হারিয়েছিল ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টে। আগস্টেই রচিত হয়েছিল বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত-কালো অধ্যায়। ঘাতকের বুলেট নির্মমভাবে থামিয়ে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর পথচলা। নিভিয়ে দিয়েছিল তাঁর জীবনপ্রদীপ। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে তারা থামাতে পারেনি। থামাতে পারেনি তাঁর স্বপ্নের পথচলা-কে। বঙ্গবন্ধু ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, দুর্নীতি ও শোষণমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, তাঁর সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেই পথেই এগিয়ে চলেছে...।