হেলাল হাফিজ নিভৃতচারী সন্ত কবি এক -ইকবাল খোরশেদ

26 Sep 2023, 03:59 PM প্রবন্ধ শেয়ার:
হেলাল হাফিজ  নিভৃতচারী সন্ত কবি এক  -ইকবাল খোরশেদ

আমরা কবিতার প্রেমে পড়েছিলাম, না কি কবিতার লাবণ্য আমাদের ওপর ঠিকরে পড়েছিল তা আজ আর প্রত্যয় করে বলতে পারবো না। আপনারা হয়ত ভাবছেন, বুদ্ধদেব বসুর ‘আমরা তিনজন’ গল্পে যেমন তিন বন্ধু এক কন্যার প্রেমে পড়েছিল, সেরকমই কিছু। না সেরকম ভাবার কোনো অবকাশ নেই। এই ‘কবিতা’ রক্ত-মাংসের কোনো তন্বী তরুণী নয়। এ ছন্দ-অনুপ্রাস-চিত্র-চিত্রকল্প-সমৃদ্ধ পঙ্ক্তিমালা। বিশ্বের তাবৎ শিল্পকলার সবচেয়ে উচ্চমার্গীয় শিল্প। স্কুলের পাঠ্য বাংলা বইয়ের ‘পদ্যাংশ’-এর কবিতাবলি পাঠ করতে করতেই আমাদের কাব্যদেবীর প্রতি আকৃষ্ট হওয়া। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাশাপাশি আরও আধুনিক কবি শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হক-এর কবিতা আমাদের আকৃষ্ট করেছিল কৈশোর ও কৈশোত্তোরকালেই।

গত শতকের আটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমরা যখন বিবিদ্যালয়ের নবীন ছাত্র তখন স্বৈরাচারবিরোধী অন্দোলন দানা বাঁধছে। সেসময় কবিতার তেজদীপ্ত দু’টি পঙ্ক্তি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে- “এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।” এই পঙ্ক্তি দুটি আমাদের স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী নব্বইয়ের গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল বহুলাংশে। বলাবাহুল্য, প্রেরণাদায়ী এই চরণ দুটি যে-কবিতার অংশ সেই ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ শিরোনামের পুরো কবিতাটি পাঠ করে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি, আবেগের ধারাজলে অবগাহন করে স্নাত হয়েছি :

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

মিছিলের সব হাত

কণ্ঠ

পা এক নয় ।


সেখানে সংসারী থাকে, সংসার বিরাগী থাকে,

কেউ আসে রাজপথে সাজাতে সংসার ।

কেউ আসে জ্বালিয়ে বা জ্বালাতে সংসার

শাশ্বত শান্তির যারা তারাও যুদ্ধে আসে

অবশ্য আসতে হয় মাঝে মধ্যে

অস্তিত্বের প্রগাঢ় আহ্বানে,

কেউ আবার যুদ্ধবাজ হয়ে যায় মোহরের প্রিয় প্রলোভনে।


কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনি হতে হয়

যদি কেউ ভালোবেসে খুনি হতে চান

তাই হয়ে যান

উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।


এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।

হীরকখন্ডের মতো জ¦লজ¦লে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’-এর শ্রষ্টা কবি হেলাল হাফিজকে চিনেছি আরও অনেক পরে। ‘নিভৃতচারী’ শব্দটি যেন হেলাল হাফিজের জন্যই অভিধানে ঠাঁই করে নিয়েছে। ভেতরে বাইরে আশ্চর্য সুন্দর, সুপুরুষ হেলাল হাফিজের নমনীয়, বিনয়ী ব্যক্তিত্ব যেকোনো মানুষকেই আকৃষ্ট করে অনায়াসে। 

দুই  

হেলাল হাফিজ ঘর থেকে বর হন না। একেবারেই না- অকৃতদার হেলাল হাফিজ জীবিকার প্রয়োজনে সাংবাদিকতা করেছেন। পত্রিকার অফিস, প্রেসক্লাব আর নিজের ঘর- এর বাইরে কোথাও তাঁর চলাচল নেই। বছর দশেক আগে [সম্ভবত ৫ জুন ২০১৩] অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারীর নেতৃত্বাধীন ‘চারুকণ্ঠ’ [আবৃত্তি সংগঠন] তাদের ধারাবাহিক অনুষ্ঠান ‘বিম্ন রোদের ছায়া’র একটি পর্ব হেলাল হাফিজের কবিতার আবৃত্তি দিয়ে সাজিয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানে আমার কবির কবিতা পাঠ ও ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে কবিতা সম্পর্কে দু-এক কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। এই প্রথম ব্যক্তি হেলাল হাফিজের সাথে আমার পরিচয় ও সামান্য ভাব বিনিময়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এর আগে হেলাল হাফিজ কোনো কবিতার আসরে গিয়েছিলেন কি না, আমার জানা নেই। এর পরে বোধহয় আর দু-একটি অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। ব্যস্ তারপর আবার পুরোপুরি গৃহচারী।


তিন

শোনা গেল, কবি হেলাল হাফিজ গুরুতর অসুস্থ। আমরা ‘কাব্যাক্রান্ত বন্ধু’রা ঠিক করলাম কবিকে দেখতে যাবো। কিন্তু কোথায় তিনি এখন থাকেন তা আমাদের জানা নেই। ‘চারুকণ্ঠ’-এর প্রশান্ত অধিকারীকে জানালাম, আমরা কয়েকজন বন্ধু কবি হেলাল হাফিজের সাথে দেখা করতে চাই। প্রশান্ত অধিকারী কবির সাথে যোগাযোগ করলে কবি প্রথমে না বলে দিলেন। পরে কী মনে করে যেন সময় দিলেন ২৫ আগস্ট, শুক্রবার, সকাল দশটায় তাঁর সাথে দেখা করা যাবে। 

নির্দিষ্ট দিনে আমরা পাঁচ বন্ধু [জাকির হোসাইন, মুশফিকুর রহমান চৌধুরী, জি এম মহিউদ্দিন শাহেদ, শিমুল খোন্দকার এবং আমি ; বলাবাহুল্য প্রশান্ত অধিকারী তো আছেনই] গিয়ে হাজির হলাম কবির হোস্টেলে। প্রথম দর্শনে কবিকে বেশ অসুস্থ বলেই মনে হলো। তারপর পরিচয় পর্ব শেষে কথা বলতে বলতে একপর্যায়ে কবি বেশ চনমনে হয়ে উঠলেন। ডায়াবেটিস তাঁর দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তিকে দুর্বল করে দিলেও তাঁর মন, মনন ও স্মৃতিতে একটুও আঁচড় কাটতে পারেনি। আলাপচারিতার একপর্যায়ে হেলাল হাফিজ আমাদের আখ্যায়িত করলেন ‘কাব্যাক্রান্ত দুষ্টু ছেলের দল’ বলে। আখ্যাটি আমাদেরও বেশ মনঃপূত হলো। জানা গেল ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি কবি রচনা করেছিলেন ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কবিতাটি রচিত হওয়ার সাথে সাথে কবিতার প্রথম চরণ দুটি [“এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।”] উৎকীর্ণ হয়ে গেলে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত স্থাপনার দেয়ালে দেয়ালে। ধারণা করতে পারি, এই চরণ দুটি উনসত্তরের গণ-আন্দোলনকে উসকে দিয়েছিল।

সেদিন কথাপ্রসঙ্গে কবি জানিয়েছিলেন, ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে তিনি যখন ক্যাম্পাসে হেঁটে যেতেন তখন তরুণীরা বলাবলি করত, ‘ওই দ্যাখ, যৌবনের কবি যায়।’


চার

কবি হেলাল হাফিজ স্বল্পপ্রজ বিরলপ্রজ এক জনপ্রিয় কবি। গুণ বিচারেও তাঁর কবিতা শ্রেষ্ঠত্বের শীর্ষবিন্দু স্পর্শী। হেলাল হাফিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জ¦লে আগুন জ¦লে’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে। উল্লেখ্য গ্রন্থটির ৩৩টিরও বেশি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ২৬ বছর পর তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’ প্রকাশিত হয় ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’ প্রকাশিত হয় ২০১৯-এ। ব্যস্, এই পর্যন্তই। প্রেম-বিরহ আর দ্রোহ হলাল হাফিজের কবিতার প্রধান উপজীব্য। হেলাল হাফিজ বোধের সঙ্গ-অনুষঙ্গ বিবেচনায় নিয়ে কবিতার আলো-আঁধারীর জগৎ নির্মাণ করেন। এই বোধ কবির মনে শিল্পসৌন্দর্যের জন্ম দেয়। জীবন ও জগতের নানা ভাব ও অনুভাব শিল্পিত রূপান্তরের মাধ্যমে নির্জনতাকে আভাসিত করে। বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাস যথাযথ শৈল্পিক বিন্যাসে কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে। যার ফলে তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে বাস্তব জীবনের সংকেতময় অভিব্যক্তি। ব্যক্তিক মনোভূমির যাবতীয় হতাশা, নৈরাশ্য ও শঙ্কার অনুভূতির প্রবল উপস্থিতি কবিতায় নিরাশার মধ্যে মোহময় এক আশা জাগানিয়া অনুভবের জন্ম দেয়। তাই যে-কবির কলম থেকে রচিত হয় : “মারণাস্ত্র মনে রেখো ভালোবাসা তোমার আমার।/নয় মাস বন্ধু বলে জেনেছি তোমাকে, কেবল তোমাকে।/বিরোধী নিধন শেষে কতদিন অকারণে/তাঁবুর ভেতরে ঢুকে দেখেছি তোমাকে বারবার কতবার।” সেই কবির কণ্ঠেই আবার উচ্চারিত হয়েছে : “ভালোবেসেই নাম দিয়েছি তনা/মন না দিলে/ছোবল দিও তুলে বিষের ফণা।” আমরা আগে জেনেছি, ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’তেই তিনি লিখেছেন : “কোনো কোনো প্রেম আছে প্রেমিককে খুনি হতে হয়/যদি কেউ ভালোবেসে খুনি হতে চান/তাই হয়ে যান/উৎকৃষ্ট সময় কিন্তু আজ বয়ে যায়।”

নিঃসঙ্গতা, নির্জনতা হেলাল হাফিজের প্রিয় সঙ্গী। তিনি বলেন, “হোটেল জীবন আমি এনজয় করি। একাকিত্বের এই বেদনা আমি উপভোগ করি।” যে-কবি নির্জনতা, নিঃসঙ্গতা উপভোগ করেন তাঁকে ঘরের বাহির করে সাধ্য কার ! তাঁকে দুঃখ দেয় সেই সামর্থ্যই-বা কার ? তবুও তাঁর কলম দিয়ে নির্ঝরণীর মতো বেরিয়ে আসে : “কষ্ট নেবে কষ্ট/হরেক রকম কষ্ট আছে/... লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট/... একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে/কষ্ট নেবে কষ্ট...”।

নির্জনতা আর একাকিত্বকে সাথি করে চার দেয়ালে বন্দি থেকেও হেলাল হাফিজ সমাজদেহের ক্ষত অবলোকন করেন, উপলদ্ধি করেন এবং তার দ্বারা আলোড়িত হন। তাই তিনি প্রগাঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করতে পারেন : “নিউট্রন বোমা বোঝো/মানুষ বোঝ না।”


পাঁচ

হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৭ অক্টোবর নেত্রকোণায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম খোরশেদ আলী তালুকদার। আর মায়ের নাম কোকিলা বেগম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ লিখে রাতারাতি খ্যাতির শিখরে আরোহন করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের পঁচিশে মার্চ ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর রাতে ঘটনাচক্রে বেঁচে যান হেলাল হাফিজ। রাতে ইকবাল হলে [বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল] থাকার কথা ছিল তাঁর। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে তাঁদের অনুরোধে ফজলুল হক হলে থেকে যান। ইকবাল হলে ফিরে গেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের শিকার হতেন। ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়ার পর ইকবাল হলে গিয়ে দেখেন চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, লাশ আর লাশ। হল থেকে বেরুতেই কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে দেখা। হেলাল হাফিজকে জীবিত পেয়ে উচ্ছ্বসিত আবেগে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন নির্মলেন্দু গুণ। ক্র্যাকডাউনে হেলাল হাফিজের কী অবস্থা হয়েছে তা জানার জন্য নির্মলেন্দু গুণ আজিমপুর থেকে ছুটে এসেছিলেন ইকবাল হলে। পরে দুই কবি নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দেন।

ছয়

নোবেল বিজয়ী আইরিশ কবি উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ (song offerings) পাঠ করে রবীন্দ্রনাথকে ‘সন্ত’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সেদিন ত্রিশ মিনিটের সাক্ষাতে সৌম্যকান্তি হেলাল হাফিজের মধ্যেও আমি এক ‘সন্ত’-কে দেখেছিলাম।