ফেরা হলো না আর -আশরাফ হোসেন

23 Oct 2023, 12:58 PM শ্রদ্ধাঞ্জলি শেয়ার:
ফেরা হলো না আর  -আশরাফ হোসেন

দুপুর কিংবা সকাল, সন্ধ্যা অথবা রাত বাংলার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যখন যে, যেভাবে আমন্ত্রণ বা নিমন্ত্রণ করেছে, শুধু নগর নয়, গ্রাম থেকে গ্রামে, জেলা উপজেলায় এবং বহু প্রত্যন্ত অঞ্চলসহ দেশের বাইরে জার্মান ওয়াশিংটন, নিউ ইয়র্ক, কানাডাসহ নানান দেশে ছুটে গিয়েছেন, কবিতার কথা, বাংলার কথা, বাঙালির কথা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা, স্বাধীনতার কথা বলার জন্য।

তার মনোমুগ্ধকর কণ্ঠে একটা শব্দ শোনার জন্য মানুষ উন্মুখ হয়ে থাকতো।

জীবনের কথা বলার জন্য মানুষকে মানুষ বানানোর জন্য নিজের গল্প করেনি কখনো। বরং মানুষকে দেশের কথা বলেছেন দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য আর ইতিহাসের কথা বলেছেন। অন্যায়, অসত্য, অবিচার প্রসঙ্গে মৃত্যুর কিছুদিন আগেও অনেক বক্তব্যে সোচ্চার হয়ে সচেতন করেছেন আমাদের, নিজের বেদনাকে ভেতরে ঢেকে শত যন্ত্রণাকে চেপে চোখে শুধু আগুন জ¦লেছে। তবুও চিরায়িত সহজাত মুচকি হাসির রেখায় সহজ সাবলীল ভাষায় বলে গেছেন মানুষের কথা, সম্প্রীতির কথা, মানবতা ও শান্তির কথা।

সর্বদা হাতখানা উপুড় করে রেখেছেন অন্যের হাতের ওপর, অন্যের মাথার ওপর। তাঁর আশ্রয়ে তাঁর প্রশ্রয়ে পুষ্ট অনুজ সৃষ্টিশীল প্রায় সকলেই আমরা। মনের ভুলেও কখনো হাত পেতে দেন নি, এই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আর কখনো কারো কাছে পাবো না আমরা। কোনো এক প্রসঙ্গে আমার সাথে ফোনে আলাপ চলাকালে আবৃত্তি শিল্পী ইকবাল খোরশেদও বলছিলেন আমাকে, ‘আসাদ ভাইয়ের মতো এমন নিঃস্বার্থভাবে অন্য কেউ ভালোবাসেনি’ সত্যি তাই, এত নিঃস্বার্থ আর নিরহংকার, এত বিনয়ী আর একজন অত বড়ো মাপরে কবি-কে পাবো কি না জানি না। এত বড়ো মন ও এত বড়ো মাপের কোনো মানুষকে এ রকমের সরল, সহজ করে জীবন যাপন করতে আমি দেখিনি।

লম্বায় পাঁচফুট পাঁচ কি ছয় ইঞ্চ হবেন, সিনা টানটান, মাথায় বাবরি, ঢেউ দোলানো চুল আবার কখনো ছোটো ছোটো চুল, এক সময় একমুঠো দাড়ি আর ভরাট গোঁফে ঢাকা ওষ্ঠ, জাফরানি পানে অধর হয়েছে টসটসে লাল। তীব্র ক্ষোভ আর প্রতিবাদ সব, সব গিলে হজম করে নেন সকল দুঃখ বেদনা যন্ত্রণার মতো বড়ো বড়ো হিমালয় পাহাড়। চওড়া মুখের অবয়বে সর্বদা এক চিলতে হাসি থেকে যায় অধর কোণে। মোটা চশমায় নয়ন কোণে বয়ে গেছে প্রকৃতি থেকে নেয়া শান্তির রঙে রাঙানো যত পত্রিকায় মোড়ানো আনন্দের খবর। রং ও রেখায় উচ্ছ্বসিত হয়েছেন নব উদ্দীপনায়। নতুন আশায় বুক বেঁধেছেন। লিখে গেছেন একের পর এক কবিতার পা-ুলিপি। যেমন, তবক দেয়া পান, কিছু ফুল আমি নিভিয়ে দিয়েছি, নদীও বিবস্ত্র হয়, দুঃখিরা গল্প করে, তুমি কোন অলকার ফুল। এমন আরো অনেক পা-ুুলিপির জন্মদাতা শিল্পী, কবি, লেখক, উপস্থাপক এবং একজন একনিষ্ঠ সংগঠক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।

তিনি আমাদের সবার প্রিয় কবি আসাদ চৌধুরী। আসাদ চৌধুরী বাংলাদেশের কবিতায় এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেন, যেখানে তিনি প্রেম সৌন্দর্য ও সুফিবাদী চেতনার সংমিশ্রণ ঘটান। তিনি সুফিইজমের ভাবধারা নিজ জীবনে নিজেকে অনুসন্ধান করেছেন গোপনে নিভৃতে। যার ফলস্বরূপ কবির কবিতায় সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ হয়েছে নান্দনিক রূপে। এমনকি কবির বইয়ের নামের মধ্যেও গভীর জীবনবোধ পাওয়া যায়। কবিতার ভেতর থেকে ভেতরে যে, রসবোধ ছন্দে লিলায়িত করেছে তা বোদ্ধা সমঝদারগণের মনোজগতে মহাজাগতিক চিন্তার খোরাক হয়ে থাকবে বলে মনে করি।

আমরা সকলে একা, ভীষণ একা

গ্রাম নগর, নগরের অলি গলি ঘুরে দেশ থেকে বিদেশ আত্মীয় স্বজন বন্ধু পরিচিত কত কত মানুষ, কত মুখ। আমরা হেঁটে চলি, পথের পর পথ পেরোই। একে অপরের জন্য ভাবি, দুঃখ পাই, দুঃখ নিই, সুখ ও আনন্দে মেতে থাকি। সুখ-সুখের খুঁজে মেতে উঠি, ভোগের নেশায় মাতাল হই, সব কিছুতে স্বার্থ খুঁজি, শুধু জানি না অথবা ভুলে থাকি, আমি আমরা বড়ো একা যাই করি না কেন সবই শূন্য। যখন এসেছিলাম হাত শূন্য আর দেহ নগ্ন। যাবার সময় শুধু সাজিয়ে সাদা কাপড়ে এই তো জীবন। জীবন ধারণের জন্য আমরা একক জন একক কাজ করিÑ কেউ চাকরি, কেউ ব্যবসা, কেউ আঁকিয়ে, কেউ গড়ে, কেউবা আবার লেখে। এমনই একজন সংগঠকের কথা বলছি যিনি আত্মীয় স্বজন পরিবার নয়, বেশিরভাগ সময় ভক্ত অনুরাগীদের নিয়ে সংসার গড়ে ছিলেন। নিজ পরিবারের চেয়ে বেশি সময় কাটাতেন এই সম্পর্কের মানুষদের সাথে। একবার আলাপে বসলে কখন দুপুর, কখন রাত গড়িয়ে সময় কেটেছে তার হিসাব রাখেননি। কথা-প্রিয় এই মানুষটিকে চারণ কবি আসাদ চৌধুরী বললেও ভুল হবে না। আসাদ চৌধুরীর রচনায় লোকজীবন, সাধারণজীবন, ইতিহাস, ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধসহ নানা প্রেক্ষাপট চিত্রিত হয়েছে। আমাদের দেখিয়েছেন দেশেকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়। দেশের প্রতি প্রতিজন মানুষের কর্তব্য ও দায়বোধ কতটুকু ।

মানুষের প্রতি মানুষের মানবতা, মনুষ্যত্ব ভালোবাসা, আত্মত্যাগ ও সততায় তিনি যে মহান জীবন যাপন করেছেন তা সুস্পষ্ট দেখতে পাই তার জীবনচর্চায়। তরুণ কবি ও সৃষ্টিশাল মানুষদের প্রতি তার যে সৌহার্দ্য ছিল তা সবার চেয়ে ভিন্ন। মানুষকে মনে রাখার ক্ষমতা ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী, ইতিহাসের চরিত্রগুলোও মনে রাখতেন দারুণভাবে। আরো মনে রাখতেন সমাজ ও দেশের নানা খুটিনাটি, শুধু ভুলে যেতেন মানুষের দেওয়া বঞ্চনা, বেদনা, দুঃখ, যন্ত্রণা অথবা প্রতারণার কথা।

কানাডা থাকাকালীন অবস্থায়ও আমার সাথে কথা হতো প্রায়শয়ই। সে কথার মধ্যে কয়েকটি কথা খুব জোরালো থাকত তা হচ্ছে আমি এখন আর লিখতে পারছি না। এ আকাশ, এ বাতাস, আ মা র মনে হয় না। গাছগুলো দেখলে বেশ অচেনা মনে হয়। খুব বেশিক্ষণ বই নিয়ে বসতে পারি না। আমি বলতাম, একটু বই পড়েন কারো সাথে কথা বলেন যেটা খানিকটা ভালো লাগে অল্প সময় হলেও করেন, ভালো লাগতে পারে। বেশিরভাগ সময়ই দেশের মানুষ নিয়ে কথা বলতেন। ঠিক যেমন চেয়েছিলাম তা যেন হচ্ছে না। চেষ্টা করেও হচ্ছে না। আসাদ চৌধুরীর কথার মধ্যে একটা ক্ষোভ, একটা আক্ষেপ, একটা অভিমান ছুঁয়েছিল। কিন্তু হতাশ হননি কখনো। ধৈর্যের কথা বলেছেন, বিশ্বাসের কথা বলেছেন, শান্তির কথা বলেছেন।

হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কয়েকদিন আগে ফোনে কিছু কথা বলার পরেই বলছিলেন। হে আশরাফ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছিলেন, আরো দু’শত বছর লেগে যাবে হয়ত। সবকিছু মিলিয়ে কেমন একটি চাপা অভিমান ছিল। কিন্তু মুখোবয়বে এক মিষ্টি হাসি ফুটে থাকতো চাঁদনি রাতের শাপলা ফুলের মতো।

আমাদের যুদ্ধ পরবর্তী দেশ যেভাবে গড়ে ওঠার কথা ছিল, সে ভাবে যেন হয়ে উঠছে না। মানুষের মানবতা, মনুষ্যত্¦ একটি সাধারণ বোধ কেমন যেন অন্য পথে হাঁটছে। এভাবে অনর্গল বলে যেতেন, ইতিহাসের বায়ান্ন, উনসত্তর, সত্তর ও একাত্তর-এর কথা। এছাড়াও যখন কোনো ইতিহাসের কথা উঠত তিনি এভাবেই বলে যেতেন। কথা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে লেখা অনেক কিছু তুলে ধরতেন আমাদের কাছে।

কানাডায় যাওয়ার পর থেকে তিনি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছেন এমনই মনে হতো তাঁর কথায়। সর্বদাই তিনি মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বর্তমান সমাজব্যবস্থা নিয়ে মানুষের কথা ভাবতেন। কিন্তু পরিবারের টানে যখন কানাডায় যেতেই হলো, তখন ভুলে থাকতে পারলেন না দেশকে! আবার দেশে থাকলে সন্তানকে ভুলে থাকতে পারতেন না। এ মনের গভীরে এক মানসের দুই খেলা। কবি কাকে নেবেন! তাই তিনি ভেবে গিয়েছিলেন যতদিন পৃথিবীতে আছেন দেশে ছয় মাস-সন্তানের কাছে ছয় মাস। কিন্তু নিয়তি বড়ো নির্মম, কদিন যেতে না যেতেই কঠিন অসুখ ধরা দিল তেমন কেউ না জানলেও কোনো কারণে আমি জেনেছিলাম। তখন দেখে কেউ বলতে পারত না তার এমন অসুখ শরীরের নাড়ি নক্ষত্র বিষিয়ে তুলছে দিন যত যাচ্ছে একের পর এক অরগান নষ্ট করে তুলছে। এতকিছু জেনেও মুক্তিযোদ্ধা বীরের মতো হাসেছেন। সহজাত স্বভাবে মুচকি মধুর হাসিতে, গল্পে ¯œাত করেছে আমাদের তনু মন প্রাণ, কী অদ্ভুত তার জীবনী শক্তি।

আমার দেখা এমন মানুষদের মধ্যে তিনি প্রথম, যিনি সুখের পিছনে দৌড় দেননি, তিনি হেঁটেছেন মনের আনন্দে, সে যতটা পথই হোক। তাই তার জীবন শান্তিময় হয়ে উঠেছে। আমরা সুখের প্রতিযোগিতায় দৌড়ে জেতার চেষ্টা করছি যখন, তখন তিনি নিজ সংসার ফেলে সমাজ সংসারে, রাষ্ট্র তথা দেশের বৃহত্তর মানুষের সংসারে আনন্দ দিতে বেরিয়েছেন খোলা হাতে, কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ আর ব্যাগের ভেতর জাফরান দিয়ে সাজানো পান। অন্তরের গহিনে গল্প, ইতিহাস, প্রবন্ধ আর কবিতা। তার কবিতার কী ঝলক চৈত্রের খরা থেকে ফাল্গুনের সুঘ্রাণই তার কবিতায় এক অনির্বচনীয় সুর ও ছন্দের রঙিন চিত্র এঁকেছেন বারবার। যা আমাদের প্রাণের প্রাণকে আন্দোলিত করেছে নবনব উচ্ছ্বাসে। সে উচ্ছ্বাসে প্রেম ছিল, তীব্র প্রতিবাদ ছিল, ছিল দুঃখ আনন্দের নির্যাস। আসাদ চৌধুরীর শব্দে ছিল এক মোহময় প্রেম ও আনন্দ। দুঃখে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তার সামনে বসলে সব ভুলে যেতে হতো। জোর করে নয়। তাঁর মন্ত্রমুগ্ধ কথায় মুগ্ধ হয়ে ভুল করেই ভুলে যেতে হতো। কারণ, তাঁর শব্দে একধরনের সুরের মূর্ছনা বয়ে যেত, যা ¯œায়ুতন্ত্রে এক ইন্দ্রজাল তৈরি হতো। যে দিন থেকে তার সামনে আলাপ আলাপনে মুখোমুখি হলাম, তিনি আমাকে চিনলেন, আমি তাকে চিনলাম, গভীর থেকে গভীরে কথা হলো। সে গভীরের সুর এনে আবার কোনো হালকা ফাল্গুনের বাতাসে রং মিলিয়ে দিল। আর আমি সেই রং নিয়ে মুখ অবয়বে বীণার তারে আরেকটি সুরের ঝংকার এঁকে দিলাম। তিনি বললেন আশরাফ অসাধারণ হয়েছে, আমি বললাম আপনার ভালো লাগার ছন্দ বয়ে যাক এ কর্মে। তিনি আরও বললেন, ‘আমি কাউকে কখনো দেখি নাই রবীন্দ্রনাথকে এভাবে ধারণ করে তার কবিতা ও সুরকে চিত্রে এভাবে চলমান করে তুলতে। একমাত্র আপনাকে দেখলাম শুধু, আবেগের বশবর্তী হয়ে নয় বরং অনুভূতির অনুভবে বিচক্ষণতার সাথে। বলতেই হয়, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও সুর আপনার ছবিতে একাকার।’

এমন করে আর কেউ বলবেন না, যেমন করে আসাদ চৌধুরী বলেছিলেন। তিনি কানাডা যাওয়ার দুই দিন আগে আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম, চলে আসার সময় বলছিলেন, এবার এসে দোতলায় উঠবো, তিন তলায় উঠতে কষ্ট হয়। গতবারও বলেছিলাম আপনাকে, আপনি দোতলায় ওঠেন। যাক, এবার ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমার কথা শেষ হতে না হতেই বললেন, আবার আসা হবে কি না জানি না। বড়ো বেদনার কথা, সত্যিই তার আর ঘরে ফেরা হলো না। রয়ে গেল শুধু স্মৃতি, হয়ত বড়ো অভিমানে নিভৃতে চলে গেলেন।

৬ অক্টোবর ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ রোজ শুক্রবার ওপারে পাড়ি জমালেন কবি আসাদ চৌধুরী। তাঁর কলম আর মুখ থেকে আর বের হবে না অমল ধবল শব্দরাজি... 

লেখক : চিত্রশিল্পী

কবির প্রতিকৃতি : আশরাফ হোসেন 

ছবি : জাকির হোসেন