শক্তি ও শান্তির প্রতীক দেবী দুর্গা -নিরঞ্জন অধিকারী

23 Oct 2023, 01:22 PM প্রবন্ধ শেয়ার:
শক্তি ও শান্তির প্রতীক দেবী দুর্গা  -নিরঞ্জন অধিকারী

শরতের সুনীল আকাশ। ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ার লুকোচুরি খেলা। সাদা কাশবনে বাউল বাতাস। রক্তিম বৃন্তে শ্বেত পবিত্র শেফালি। এই শরতে মর্ত্যে আসেন দেবী দুর্গা। দেবী দুর্গা আদ্যাশক্তি মহামায়া, দুর্গতিনাশিনী। এই আদ্যাশক্তি মহামায়া এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্ম অর্থাৎ ঈশ্বরের শক্তি। দেবী শক্তি, ব্রহ্ম শক্তিমান। এ জন্য আদ্যাশক্তি মহামায়াকে বলা হয় ব্রহ্মস্বরূপিণী। সুতরাং দেবী দুর্গার আরাধনা করলে ব্রহ্মেরই আরাধনা করা হয়। এখানে উল্লেখ্য, দেব-দেবীরা আলাদা আলাদা ঈশ্বর নন। ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। ঈশ্বরের কোনো গুণ বা শক্তির প্রতিভূ হলেন এক-একজন দেব বা দেবী। যেমন, দেবী দুর্গা ঈশ্বরের শক্তির প্রতিভূ। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হিন্দুধর্ম বহু ঈশ্বরবাদী নয়Ñ হিন্দু ধর্ম একেশ্বরবাদী।

জগৎ-প্রপঞ্চ আদ্যাশক্তি মহামায়ার মায়ায় নিবদ্ধ। আদ্যাশক্তি মহামায়ার মায়ার কারণেই আমরা মায়ায় আবদ্ধ হই। পিতা-মাতার সন্তানের প্রতি, সন্তানের পিতা-মাতার প্রতি, স্বামী-স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি, মানুষের মানুষের প্রতি যে মায়া, তা আদ্যাশক্তি মহামায়ার মায়ার কারণেই উদ্ভূত হয়। আবার আদ্যাশক্তি মহামায়া দয়াময়ী। যখনই ভক্ত বিপদে পড়েন, তখন তাঁকে ডাকেন। তিনি শক্তি দেন। ভক্ত ত্রাণ পায় বিপদ থেকে। দেবতাদের রাজপদ ‘ইন্দ্র’ নামে পরিচিত। দেবরাজের ইন্দ্রত্ব অর্থাৎ রাজপদ মাঝে মাঝে অসুরেরা ছিনিয়ে নেয়। ইন্দ্রত্ব লাভ করে অসুরেরা দেবতাদের স্বর্গ থেকে তাড়িয়ে দেয়। তখন দেবতারা শক্তির আরাধনা করেন। শক্তি সঞ্চয় করেন। দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি থেকে আবির্ভূত হন দেবী দুর্গা। দেবী দুর্গা প্রতিপক্ষ অসুরদের বিনাশ করেন। দেবতারা ফিরে পান তাঁদের স্বর্গরাজ্য। স্বর্গরাজ্য ফিরে পেয়ে দেবতারা সকৃতজ্ঞচিত্তে দেবীর স্তব করেন-

শরণাগতদীনার্ত পরিত্রাণপরায়ণে।

সর্বস্যার্তি হরে দেবি নারায়ণি নমোঃস্তুতে ॥

-হে শরণাগত, দীনার্ত পরিত্রাণপরায়ণা, সকলের আর্তি হরণকারিণী দেবী, হে নারায়ণী, তোমাকে নমস্কার করি।

দেবীকেন্দ্রিক পৌরাণিক উপাখ্যানগুলো থেকে দেবী দুর্গা সম্পর্কে আমরা বেশ কয়েকটি তথ্য লাভ করি। দেবতারা যখন অলস ও নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলেন, তাঁদের শক্তি কিছুটা হ্রাস পেয়েছিল, তখনই অসুরেরা স্বর্গরাজ্য অধিকার করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। তারপর দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি থেকে দেবী দুর্গার আবির্ভাব। এই যে সম্মিলিত শক্তি, এ কথাটা তাৎপর্যপূর্ণ। একক নয়, সম্মিলিত শক্তি। হতাশায় নিশ্চেষ্ট থাকা নয়, পূর্ণ উদ্যমে শক্তি সঞ্চয়ের প্রয়াস এবং মহাশক্তির উদ্বোধন। সেই মহাশক্তির দ্বারা অসুরকে আঘাত করা এবং বিজয় অর্জন। তাই তো শ্রীশ্রী চ-ীতে বলা হয়েছে-


যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥

- যে দেবী সর্বভূতে বিশ্বচরাচরের শক্তিরূপে বিরাজ করেন, সেই দেবীকে নমস্কার করি।

আবার দেবী দুর্গা শান্তিপ্রদায়িনী। অসুর নাশ করে তিনি দেবতাদের শান্তি দিয়েছিলেন। দুর্গতি থেকে তাঁরা মুক্ত হয়ে পেয়েছিলেন পরম শান্তি। সেখানে দেবী দুর্গা শান্তির প্রতীক।


শ্রীশ্রী চ-ীতে তাই বলা হয়েছে-

যা দেবী সর্বভূতেষু শান্তিরূপেণ সংস্থিতা।

নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥

-যে দেবী সর্বভূতে বিশ্বচরাচরের শক্তিরূপে বিরাজ করেন, সেই দেবীকে নমস্কার করি।


দেবী দুর্গা তাই শক্তি ও শান্তি দু-রূপেই প্রকাশিত। এ থেকে আমরা এ শিক্ষাই পাই, আমরা যখন কোনো সঙ্কটে নিপতিত হব, তখন হতাশায় গ্লানিতে নিশ্চেষ্ট-নিষ্ক্রিয় থাকব না। আমরা গ্রহণ করব সক্রিয় উদ্যোগ। আমরা আমাদের ভেতরের শক্তিকে জাগ্রত করব নিরন্তর সাধনায় অক্লান্ত প্রচেষ্টায়। তারপর প্রত্যেকের শক্তিকে সম্মিলিত করব, ঐক্যবদ্ধ হব, সংহত হব। সংহত হওয়ার পর ঐক্যবদ্ধ প্রচষ্টাকে নিয়োজিত করব সঙ্কটের মুকাবিলায়। অবশ্যই আমাদের বিজয় হবে এবং পরিণামে আমরা লাভ করব শান্তি।

যেমন, যখন আমরা প্রবল বন্যার আক্রমণে আক্রান্ত হয়ে বিপর্যস্ত হই, তখন আমরা ভয় পাই না। সকলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা বন্যার মোকাবিলা করি। দুর্গতদের ত্রাণ করার জন্য ‘ত্রাণের’ হাত বাড়িয়ে দিই। এর মধ্যে দিয়ে আমাদের মধ্যে দেবী দুর্গার শক্তির প্রকাশ ঘটে। বন্যার প্রকোপ কমে গেলেও বন্যার পরবর্তী দুরবস্থা থাকে। তখন পুনর্বাসনের পালা। এক্ষেত্রেও ঐক্যবদ্ধভাবে সম্মিলিত শক্তিতে আমরা কাজ করে যাই। পরিণামে আমরা পাই শান্তি, অসুর বিনাশের পর দেবতারা যেমন পেয়েছিলেন।

যেখানে অনৈক্য, বিভেদ, নিষ্ক্রিয়তা, সেখানেই সুরের-মঙ্গলের-কল্যাণের পরাজয়, তখনই ঘটে অসুরের আবির্ভাব। সম্মিলিত শক্তি ছাড়া সে অসুরের পরাজয় অসম্ভব। সুর আর অসুরে, ভাল আর মন্দের এই দ্বন্দ্ব ঘটছে সমাজে, দেশে এবং বিশ্বে। এমনকি ঘটছে নিজের মধ্যেও। নিজের ভেতরকার অসুরটিকে বিনাশ করতে হবে, নইলে সে অসুর অধিকার করে নেবে অন্তরের ‘শান্তির’ স্বর্গরাজ্য। অহংকার, লোভ প্রভৃতি এক-একটি অসুর। আর এগুলো মানবাত্মার শত্রু। এরা সমাজে সৃষ্টি করে অনাচার। এগুলোই মহিষাসুর, রক্তবীজ, চিক্ষুর এবং চামর নামক অসুর। এদেরই আমরা দেখি সন্ত্রাসীরূপে, অসামাজিক কর্মকা-ের দানব এরাই। ব্যক্তির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে এরা সমাজকে কলুষিত করে। তাই চাই সুরের ভেতরকার শক্তিতে মহাশক্তির উদ্বোধন। সেই শক্তির দ্বারা অন্তরের অসুরের বিনাশ ঘটে, বিজয়ী হয় ‘সুর’। তাতেই আসে শান্তি ও কল্যাণ। দুর্গাপূজার মধ্যে দিয়ে এ তাৎপর্যও প্রকাশিত। আমরা যেন একথা শারদীয় দুর্গাপূজার মধ্যে দিয়ে উপলব্ধি করি। সেভাবেই যেন নিজেদের প্রস্তুত করি। প্রার্থনা করি ; অন্তরমন্দিরে এসো হে শক্তিময়ী, অসুরকে বিনাশ করে তুমি আমাদের শান্তি দাও। চিনে নিই, জেনে নিই অসুরের ভয়াল স্বরূপ- জাগ্রত করি, উদ্বোধিত করি সুরের শক্তিময় শান্তি, শান্তিময় শক্তি।

লেখক : অনারারি অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়