ডলির কদর -মাহমুদা আখতার

17 Apr 2024, 01:53 PM গল্প শেয়ার:
ডলির কদর -মাহমুদা আখতার

আজ প্রায় দশ বছর ধরে আমি ছিলাম অন্ধকার কুঠুরিতে নিক্ষিপ্ত, সঙ্গে আমার আরো চাচাতো-মামাতো-খালাতো-ফুপাতো ভাইবোনসহ। কেউ ভালোবেসে উদ্ধার করেনি। কেউ আদর করে বুকে টেনে নেয়নি। কীভাবে আমি এই বাড়িতে এলাম, সেটা বলি আগে। আজ থেকে ১৩ বছর আগে আমার মতনই প্রায় দেখতে এক মেয়ে জন্মেছিল ওই বাড়িতে। আমার মালকিন, যিনি আমাকে কিনে এনেছেন, তিনি সেই মেয়েটির জন্য সঙ্গী হিসেবে প্রথমে খুব শখ করে ডবল দামে কিনে এনেছিলেন আমার বড়ো বোনকে। ‘ডল’র মতোই দেখতে সেই মেয়েটি, নাম যার ‘প্রত্যয়ী’ ; ওর তিন বছরের জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন আমার সেই বোনকে প্রত্যয়ীর খেলায় সঙ্গ দিতে। কিন্তু ঠিক জানা নেই, কেন প্রত্যয়ীর ওকে পছন্দ হয়নি ! মালকিন ভেবেছিলেন, প্রত্যয়ীর সবসময়ের সঙ্গী হবে ‘ডলি’, মানে আমার বড়ো বোন। অথচ এক মাস না যেতেই প্রত্যয়ী ওর রেশমি চুল ছিঁড়ে, হাত-পা ভেঙে পঙ্গু করে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় ‘ডলি’কে। মালকিন মনে বড়ো ব্যথা পান। তবু ভাবেন, অবুঝ শিশু ; বুঝতে পারেনি বোধহয়। তাছাড়া ডলির শরীরও তো সিনথেটিক তুলার তৈরি, নরম। এদিকে হাত-পা শক্ত রাবারের শরীরের সঙ্গে আঠা দিয়ে জুড়ে দেওয়া ; যতেœর সঙ্গে ব্যবহার না করলে এমনিতেই ছুটে যাওয়ার কথা। প্রত্যয়ী তো মাত্রই তিন পেরুলো, বয়স আরেকটু বাড়লে ‘ডলি’কে খুঁজবো তখন নিশ্চয়ই ‘ডলি’র মূল্য বুঝবে।

মালকিনের নিজের শৈশব সবসময়ই তার চোখে ভাসে। তখনকার দিনে প্রতিদিনের সঙ্গী হতো ‘ডলি’রা। তবে গত শতকের সাতের দশকের ‘ডলি’রা ছিল নেহাত সাদাসিধে। ঘরেরই কেউ সেলাই করার পর বেঁচে যাওয়া টুকরা কাপড়ে সুতা পেঁচিয়ে ‘লিলিপুট ডলি’ বানিয়ে দিত আর তা নিয়েই যে কী আদিখ্যেতা, কী উল্লাস ! একটু ঘ্যানঘ্যান করলেই বড়ো বোনেরা সেই লিলিপুট ডলির শাড়ি-ব্লাউজও বানিয়ে দিত শুধু কাঁচি ব্যবহার করে। তারপর ? তারপর আর কী- পাড়া বেড়ানো, জনে জনে দেখানো, প্রতিবেশীদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি, রীতিমতো আয়োজন করে বিয়ে দেওয়া ... আহ্, কী দিন যে গেছে সেসব সময়ে ! প্রতিদিনই অন্তত দু’বেলা, সকালে স্কুল থেকে ফিরে আর বিকালে ঘুম থেকে উঠে কত কথা যে হতো ‘ডলি’ পরিবারের সঙ্গে- আহা ! বড়ো বোন বা মা’র কাছে আবদার জুড়ে ডলির ছানা-পোনাও বানিয়ে নেওয়া যেত। 

তখনকার ‘ডলি’রা বড়ো যত্নে ওদের জন্য গড়া মিষ্টান্ন বা জুতার বাক্সে সাজানো ঘরে কেবল শুয়ে থাকতে পারত। আর এখনকার ‘ডলি’রা আসে উড়ে কোন সে সুদূর তেপান্তর থেকে। ওরা কথা বলে, গান গায়, ঘুরে-ঘুরে নাচে, হাসে, কাঁদে, চোখের পলক ফেলে, বসে-দাঁড়ায় আর শুয়ে থাকতে পারে তো বটেই ; তবুও ওদের কদর গেছে কমে। আজকালকার ‘ডলি’রা কেবল শো-পিস; তাও ঘরে ঘরে নয়।

শৈশবে মালকিন খুব আশা করতেন, একদিন নিশ্চয়ই বিদেশ থেকে কেউ তাকে এমন এক ‘ডলি’ এনে দেবে যে কখনো পুরনো হবে না, ছিঁড়ে যাবে না, নিজে বড়ো হয়ে গেলেও আদরে তাকে সবসময়ই পাশে রাখবেন। তার সে আশা নিরাশার গহ্বরে তলিয়ে গেছে। তবে, একবার একটা কা- ঘটেছিল। কী হয়েছিল, বলি তাহলে-

মালকিন ছিলেন ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। প্রতিবছরই প্রথম হয়ে পরের ক্লাসে যেতেন। গ্রাম-সুবাদের এক চাচা, যিনি ছিলেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়ন, মাঝে-মধ্যেই আসতেন বাসায়। তিনি খুব খুশি হয়ে মুখ ফসকেই বোধহয় একবার বলে ফেলেছিলেন, ‘এর পরের বছরও প্রথম হলে আমি তোমাকে পুরস্কার দেবো।’ ‘কী পুরস্কার ?’ ‘তুমি যা চাও, তাই।’ মনে মনে তো মালকিনের অনেক বছর গেলেও নষ্ট হবে না এমন একটা শক্ত-পোক্ত পুতুলের শখ। তৃতীয় শ্রেণিও যখন প্রথম হয়েই টপকালেন, তখন চাচা আসতেই আহ্লাদীপনা শুরু হলো- চলেন চাচা। ফার্স্ট হয়েছি। পুতুল কিনে দেন। চ- লে-ন ...

‘আমি তো আজ তৈরি হয়ে আসিনি ...’

‘এই যে, শার্ট-প্যান্ট পরে এসেছেন ! আর কীভাবে তৈরি হবেন ?’

‘আজ তো তোমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছি। সঙ্গে বাড়তি টাকা-পয়সা আনিনি। আরেকদিন যখন আসব, তোমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে কিনে দেবো।’

‘সত্যি তো ?’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ,সত্যি।’

খুব দীর্ঘ সময় অবশ্য অপেক্ষা করতে হয় না। পরের মাসের বেতন পেয়েই চাচা চলে আসেন মালকিনদের বাসায়। তারপর সাড়ে নয় বছরের মালকিনকে শঙ্কর থেকে বাসে চড়িয়ে নিয়ে যান গুলিস্তান। যাওয়ার আগে পোশাক পাল্টে চুল বেঁধে দেওয়ার সময় বোনেরা নিচুস্বরে বারবার সাবধান করে দেন- শোনো, চাচা খুবই সামান্য বেতন পান মাস গেলে। এই টাকায় তাকে ঢাকায় থাকতে হয় আবার গ্রামেও টাকা পাঠাতে হয়। বেশি দামের পুতুল কিনবে না। তোমাকে খুশি করতে গিয়ে চাচা যেন ফতুর হয়ে না যান। আর মা তো রেগেই আগুন- বরিশাল থাকতে পেটে ধরছিলাম তো, তাই এইটার স্বভাব এমন হইছে [বাবার বদলীর চাকরির সুবাদে বাংলাদেশের অনেক জেলায়ই মাকে থাকতে হয়েছে কিনা] আমার পেট থেইকা এমন লোভী আর ছোচা একটা মাইয়া বাইর হইলো কেমনে ; আশ্চর্য ! রক্ত-সম্পর্কের কেউ না, তার কাছে করে আবদার ! তাজ্জবের কথা ! ছিঃ ! ছি-ছি-ছি ! লজ্জায় মইরা যাই। বেহায়া বেশরম ! আবার কেমন নাইচ্চা-নাইচ্চা যাইতেছে, দেখছ কা-টা ! আমার আপন ছোটো চাচা বিদেশ থেকা শাড়ি আইনা সবার আগে আমারে দেখাইতেন সবগুলান শাড়ি। ছোটো চাচা আমারে কী আদর যে করতেন ! বলতেন, ‘হেনু আম্মাজান, আগে আপনে পছন্দ কইরা নেন। তারপর অন্যদের দিব।’ কোনোদিন একটা শাড়িও হাতে ছুঁইয়া দেখি নাই। বলতাম, ‘চাচাজান, আপনে হাতে তুইলা যেইটা দিবেন, সেইটাই আমি পছন্দ কইরা নিব। আপনার পছন্দই আমার পছন্দ।’ আর এই মাইয়ার কোনো আক্কেল জ্ঞান আছে ? খামাখা কতগুলান টাকা যাইব রশিদের ! ভাগ্যিস, মালকিনের বাবা সেই সময় বাড়িতে ছিলেন না। থাকলে বলতেন- একটা চটকানা দিয়া বাসায় বসাইয়া রাখমু। ঠ্যাং বেশি লম্বা হইছে ; না ?

মা’র কথা শুনতে পেয়ে চাচা হাসেন। হাসতে হাসতেই ছোট্টো মালকিনের হাত ধরে রওয়ানা হন। জীবনে প্রথম বাসে চড়ে গ-ির বাইরে কোথাও যাওয়া হচ্ছে, এই আনন্দে মা’র বকা-ঝকার ঝালও কর্পূরের মতেই উড়ে গিয়ে মধুর ঝংকার হয়ে বাজে কানে। গুলিস্তানে গিয়ে অনেক দোকান ঘুরে অনেক দরদাম করে অবশেষে দশ টাকায় একটা প্লাস্টিকের পুতুল পছন্দ করে কিনতে পারে ওরা। ইস্ ! চাচার অনেকগুলো টাকা গেল ! চাচার চেয়ে ভাতিজিই পদে পদে সচেতন। তাই চাচা যখন বলেন-

: আর কিছু কিনবা না ?

: না। কী কিনব আর ?

: ক্যান, লজেন্স খাইবা না ?

: পুতুল কিনতে গিয়ে তো আপনার অনেক টাকা খরচ হয়ে গেল ! থাক্।

: কী কও ! এতদূর আসছ, হোটেলে বইসা কিছু খাইবা?

: নাহ্, বাসায় চলেন।

: খাওয়ার কিছু দেই কিন্যা ?

: না- লাগবে না। বাসায় গিয়ে খাব।

: তা তো খাবই। চকলেট-চুইঙ্গাম-চানাচুর-বিস্কুট- কেক ; কিছু একটা নাও।

: আচ্ছা, তাহলে একপ্যাকেট চুয়িংগাম কিনে দিতে পারেন। বাসায় গিয়ে সবাই মিলে ভাগ করে খাব।

: ঠিক আছে। চলো দেখি।

বুকের মাঝে পুতুলটাকে আঁকড়ে ধরে ছোট্টো ছোট্টো পা ফেলে চাচাসহ মালকিন দোকানে দোকানে ঘোরে। বড্ড বেশি দাম চাচ্ছে একপ্যাকেট চুয়িংগামের ; সর্বনিম্ন রেট দুই টাকা। কী বলে !?

: থাক্ চাচা, লাগবে না। বাসায় যাই।

: চুইঙ্গাম নিবা না ?

: পুতুল কিনতে আসছি। পুতুল তো কেনা হয়েছে। আর কিছু কেনার তো কথা ছিল না !

: আরে হইছে, অত হিসাব তোমার করন লাগতো না। এক প্যাকেট নিয়া নেও। সবাই মিল্যা খাইও।

বাসায় ফিরে বোনদের কাছে কত যে না-ফুরানো গল্পের ঝুড়ি উজাড় হয়, আহা ! তবে চাচার টাকা অযথা বেশি খরচ করে ফেলার খচখচানিটা থেকেই যায় আনন্দমাখা বিষাদের মতো বড়োবেলা পর্যন্ত। আর তাই তো, বড়ো হয়ে রোজগার করতে শুরু করেই রশিদ চাচাকে মনে করে গ্রামে টাকা পাঠান মালকিন চাচা-চাচির ঈদ উপহার কেনার অসিলায়।

ছবির মতোই এসব ঘটনা এখনও চোখের পর্দায় ভাসে। কী স্পষ্ট আর জ্বলজ্বলে ! একটুও ম্লান হয় নাই। তারপর বড়ো হয়ে একসময় মালকিনের বয়স বুড়ো হওয়ার দিকে এগুতে থাকলেও চলতি পথে ডিপার্টমেন্টাল শপে কোনো শিশু চেহারার, শিশুর পোশাক পরা স্বাস্থ্যবান ‘ডল’ বা ‘ডলি’ দেখলেই থমকে দাঁড়ান মালকিন। নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে শৈশবে চলে যান অজান্তে। অথচ বারবি-ডল ওঁকে মোটেই টানে না বরং দেখলে কেন জানা নেই বিরক্ত লাগে। হাতে ধরে দেখতেও ইচ্ছে হয় না। প্রত্যয়ীকে বারবি-ডলও কেউ কেউ দিয়েছে বটে তবে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ও কোনো ধরনের পুতুল নিয়েই খেলতে বসে না। মালকিন যখন বছর দশেক আগে ৭০০ টাকা দিয়ে আমাকে কিনে এনে, নিজের ঘরে একটু আড়ালের আশ্রয় নিয়ে লুকিয়ে রাখেন ; সেসময় প্রত্যয়ী কোনো একফাঁকে আমাকে দেখতে পেয়েই ‘এটা আমার !’; বলেই এক হ্যাঁচকা টানে আমাকে দখলে নিয়ে নিজেদের ঘরের আলমারির কোণায় ছুঁড়ে ফেলে। মালকিন আরো ভাবলেন, এতদিনে তাহলে সত্যি সত্যিই পুতুলের প্রতি টান জন্মেছে ! তাই কোনো কথা না বলে মনে মনে খুশি হয়ে অপেক্ষায় রইলেন ওর পুতুল খেলা দেখার জন্য। ব্যস, ওই পর্যন্তই। প্রত্যয়ী ‘পুতুল খেলা’র নামও নেয় না ! নেবে কী করে ? একে তো ওদের শৈশব শুরু হয়েছে স্মার্টফোনের যুগে, তার ওপর মুরুব্বিদের অবিরাম নিষেধাজ্ঞা বর্ষণ- এটা করো না ওটা ধরো না-; গুনাহ্ হবে। ঘরে পুতুল থাকলে নামাজ হবে না- এসব শুনতে শুনতে বড়ো হচ্ছে না ওরা! প্রবাসী স্বজনরাও শখ থাকলেও তাই কখনোই প্রত্যয়ীর জন্য কোনো পুতুল বয়ে আনে না বা পাঠায় না। প্রত্যয়ীর বাবা গোঁড়া ধার্মিক। নিকট আত্মীয়দের বেশিরভাগই একই মতাদর্শে জীবন পরিচালনা করছে। মালকিন সেখানে বড়োই বেমানান।

আমি সেই যে অন্ধকূপে ঢুকে আলো দেখতে উন্মুখ হয়ে রইলাম ... হায়, আমার কান্না কেউ শুনল না ! এক কোণে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে অচল হতে থাকলাম। মাঝে মধ্যে মালকিন বাসায় কোনো শিশু বেড়াতে এলে মনে করিয়ে দেন- প্রত্যয়ী তোমার পুতুলগুলো তো বের করতে পারো ...। স্মার্টযুগের শিশু ওরা। ওদের খেলনাও স্মার্টফোন কি কার্ড [পোকেমন, স্ন্যাপ, অনু আরো কত কী], এর বাইরে বড়োজোর ‘মনোপলি’। ওরা কোনোমতে কোনো একটা বাসায় ঢুকে সালাম বিনিময় করেই সোফায় বা বিছানায় অর্ধশোয়া হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দেয় পলকহীন মুঠোফোনের পর্দায় তাকিয়ে থেকে। সঙ্গত কারণেই ওদের ক্ষুধাবোধ গেছে কমে। হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে হয়, এমন কোথাও যেতে ওদের ভালোই লাগে না ! কেউ ডাকলে শুনতেও পায় না ! কানে ইয়ারফোন লাগানো থাকে বলে। ইয়ার ফোন কানে আটকে স্মার্ট ফোনের পর্দায় চলমান চিত্র দেখতে বা গেম খেলতে নিদারুণ অভ্যস্ত হয়ে গেছে ওরা, যেন বা এর বাইরে আর কানো জগৎ বা জীবন নেই ! কী আর করা ! মালকিনদেরই বরং এখন ওদের ওই জীবনটাকে মেনে নিয়ে, ওদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে জীবনযাপন করতে হয়। যুগের হাওয়া বদল বোধহয় একেই বলে।

এবছরের শুরুতেই হঠাৎ না-বলে-কয়ে মালকিনের ভাগ্নি সউদি আরব থেকে ১৫ বছরের প্রবাস জীবন কাটিয়ে সপরিবারে ফেরৎ এলেন দেশে। ওরা দেখা করতে এলে প্রত্যয়ীর মা মহানন্দে প্রস্তাব দিলেন ‘চড়–ইভাতি’র। একবাক্যে রাজি সকলেই। প্রতিবেশী আত্মীয়রাও যুক্ত হলেন। চাঁদা তুলে আয়োজন করা হলো ‘চড়–ইভাতি’র। বাসারই নিচতলার ফাঁকা জায়গায় পড়ে থাকা ইট দিয়ে চুলা বানিয়ে, কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রেঁধে-বেড়ে খাওয়া হলো ওখানেই চাটাই আর মাদুর বিছিয়ে। রান্না করলেন একজনই কিন্তু কিনতে-ছিলতে-কাটতে-বাছতে-কুটতে-কাটতে হাত লাগালো সবাই। খাওয়ার পর তাড়া থাকায় মালকিন চলে গেছেন স্কুলে। বাকি সবার আড্ডা দিতে দিতে খেতে খেতেই বিকাল গড়ালো। সেসময় পাশের বাসার এক চার বছরের শিশু জানালা দিয়ে হঠাৎ উঁকি দিয়ে বলল-

: তোমরা এখানে কী করো ?

: ‘চড়–ইভাতি’ খেলি।

: আমিও খেলব !

: চলে এসো তাহলে।

মেয়েটির দাদি দিয়ে গেলেন ওকে প্রত্যয়ীদের বাসায়। ততক্ষণে আসলে চড়–ইভাতির রান্না-খেলা আর সত্যিকারের খাওয়া-দাওয়া সবই শেষ। প্রত্যয়ীর মা তাই বললেন, ‘ওকে তিনতলায় নিয়ে যাও। আলমারি থেকে পুতুল বের করে খেলতে দাও।’

বছরের পর বছর বন্ধ কুঠুরির অন্ধকারে থাকতে থাকতে আমরা ভাইবোনেরা কেউই আর অক্ষত নেই। ছোটো-মাঝারি-বড়ো কাউকেই তাই সেই মেয়েটির পছন্দ হলো না। ‘আমি ভাঙা পুতুল দিয়ে খেলি না’- শোনামাত্রই আমার মন ভেঙে গেল। মেয়েটি আমাকে অবহেলাভরে উপুড় করে ফেলে রেখে ‘লুকোচুরি’ খেলায় মনোযোগী হলো। এ কান্নার জল আমি কীভাবে লুকাই ? এত অপমান সইব আর কতদিন ?

রাতে বাসায় ফিরে মালকিন তো হতবাক ! চল্লিশোর্ধ্ব বোরখাধারী সউদি আরব ফেরৎ ভাগ্নি খাবার ঘরের টেবিলের পাশের চেয়ারে বসে আছে আমাকে পরম আদরে কোলে নিয়ে আর আমি পলকহীন চোখে তাকিয়ে দেখছি সবার আনন্দ। আমার রেশমি কোঁকড়া চুলও টানাটানিতে মাথা থেকে আলগা হয়ে গেছে। ভাগ্নি সে চুল চেপে বসিয়ে আমারই মাথায় থাকা গোলাপি ক্যাপ দিয়ে আটকে রেখেছে। যদিও আমার এক চোখের বড়ো বড়ো উল্টানো পাপড়ি গেছে খসে, হাত-পা গেছে ছুটে তবুও আমি কোলে কোলে ফিরছি। কাদের কোলে চড়ছি ? প্রত্যয়ীর মা-বোন-ফুপু-ভাবিদের কোলে। আমি উন্মুখ হয়ে আমাকে নিয়ে বলা সবার গল্প শুনছি আর অবাক হয়ে ভাবছি- এত বছরের তৃষ্ণা- ওঁরা আটকে রাখল কী করে ?! কেনই বা রাখল ? 

ছবি : লেখক