অভিমান -দিল আফরোজ রিমা

17 Apr 2024, 02:06 PM গল্প শেয়ার:
অভিমান -দিল আফরোজ রিমা


বৃষ্টি থেমেছে। পরিচ্ছন্ন আকাশে টুকরো টুকরো সাদা মেঘেরা দলবেঁধে ভেসে চলেছে নিরুদ্দেশে। নারিকেলের পাতায় ঠান্ডা বাতাসেরা দোলা দিয়ে যায়। বৃষ্টির ফোঁটায় কামিনী গাছের ফুটন্ত ফুলের সাদা পাপড়িগুলো ঝরে পড়েছে। আঙিনাজুড়ে ছড়িয়ে আছে সেই সুগন্ধময় সাদা পাপড়ি। ইতোমধ্যে চৌধুরী সাহেব বারান্দায় চেয়ারটাতে এসে বসেছে সন্তর্পণে। ঠান্ডা বাতাস তার চোখে-মুখে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে চায় বারবার। চৌধুরী সাহেব অনুভব করেন এক নান্দনিক পরিবেশের মধুরতা। তবে তার এসব কিছুই আর ভালো লাগে না। বুকের ভেতরে দড়াম দড়াম আছড়ে পড়ে কষ্টের করাঘাত। বেদনারা হৃদয়ের অন্তঃপুরে কেঁদে মরে বারবার। সারাক্ষণ মনের মধ্যে একটি নাম লিখে যায়- বৃষ্টি। সব সময় বুকের ভেতরে উচ্চারিত হয়- বৃষ্টি আমার মা। আমার হৃদয়ের আঙিনা। আমার রক্তের ফল্গুধারা। বৃষ্টি শব্দটাই চৌধুরী সাহেবের ধ্যান জ্ঞান। যেন এই শব্দটার জন্যই তিনি বেঁচে আছেন।

চৌধুরী সাহেবের একমাত্র মেয়ে বৃষ্টি। সে বাবা মায়ের অমতে বিয়ে করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। বর্তমানে বাবা মায়ের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।

চৌধুরী সাহেব একজন সৎ কর্তব্যপরায়ণ কর্মঠ ও হৃদয়বান মানুষ। অনেক বিড়ম্বনা আর কষ্ট থেকে নিজের যোগ্যতায় তিনি আজ সমাজের বিশিষ্ট একজন। বৃষ্টি তার প্রথম স্ত্রী শুভ্রার মেয়ে। শুভ্রার সাথে বিয়ের পর চৌধুরী সাহেবের জীবন ভরে উঠেছিল নতুন স্বপ্ন তোরণে। প্রীতিঘন সেই সময়ে জন্ম হয়েছিল বৃষ্টির। ছোট্টো সুন্দর পুতুলের মতো মেয়েটাকে পেয়ে দু’জনের জীবন সুখ সমৃদ্ধিতে ভরে উঠেছিল। কিন্তু সে সুখ তার সহ্য হলো না।

এক বৈশাখি দিনে শুভ্রা তার মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। বিকালবেলা প্রচ- ঝড় ওঠে। তছনছ করে দেয় সবকিছু। তার সাথে চৌধুরী সাহেবের জীবনও। সেই ঝড়ে ভেঙে যায় বহু ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা, নষ্ট হয় রাস্তা-ঘাট, মারা যায় বহু মানুষ, ছিন্নভিন্ন হয় ক্ষেতের ফসল। সেই তা-বে শুভ্রাও মারা যায়। বেঁচে থাকে বৃষ্টি। চৌধুরী সাহেব তখন কর্মরত অন্য কোনো জেলায়। শুভ্রাকে শেষবারের মতো দেখতে পেলেন না তিনি। ছোট্টো বৃষ্টিকে চৌধুরী সাহেবের বড়ো বোন ফয়জুন্নেসা নিজের কাছে নিয়ে যান এবং তাকে আদর-যতেœ লালন-পালন করতে থাকেন।

শুভ্রার মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন চৌধুরী সাহেব। চরমভাবে তার স্বাস্থের অবনতি ঘটে। মানসিক ও শারীরিকভাবে তিনি ভীষণ পর্যুদস্ত হয়ে পড়েন।

একে একে দিন পার হতে থাকে। কেটে যায় একটি বছর। সবাই মিলে চৌধুরী সাহেবের জন্য দ্বিতীয় বিয়ের ব্যবস্থা করে। প্রথমে একটু দ্বিমত থাকলেও বিয়ের পর চৌধুরী সাহেব দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে ভালোই দিন কাটাচ্ছিলেন। এদিকে নতুন মায়ের কাছে সুখে-দুঃখে বড়ো হচ্ছে বৃষ্টি।

কিছু দিনের মধ্যেই বৃষ্টির পাশে এলো ছোট্টো ফুটফুটে ভাই। বৃষ্টি নিজের নামের সাথে মিলিয়ে নাম রাখলো মেঘ। ভাইকে পেয়ে সে খুব খুশি। ধীরে ধীরে বড়ো হয় মেঘ। হাঁটতে শেখে, কথা বলতে শেখে। বৃষ্টির আনন্দ আর ধরে না। সে তার ভাইকে খুব ভালোবাসে।

এক এক করে দিন চলে যায়। বড়ো হতে থাকে দু’ভাইবোন। হেসে খেলে একসাথে স্কুলে যায়। লেখাপড়া করে। দু’টিতে খুব ভাব। একসময় বৃষ্টি মাধ্যমিক শেষ করে কলেজে ভর্তি হয়। আর মেঘ নবম শ্রেণিতে। ছেলে-মেয়ের উত্তরণে আর দু’জনের আন্তরিকতা দেখে চৌধুরী সাহেব খুব খুশি হন। তার ব্যবসায়ও বেশ উন্নতি হচ্ছে। সংসার সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা। বৃষ্টি একে একে এইচ এসসি, অনার্স, মাস্টার্স কমপ্লিট করে। সে আপাতত একটি মাধ্যমিক স্কুলের চাকরিতে জয়েন করেছে। মেঘ অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে। ইতোমধ্যে চৌধুরী সাহেব তার টিনসেট বাসা ভেঙে ছয়তলা বিশিষ্ট একটি বড়ো ভবন তৈরি করেন। এখন একটাই সাধ এবং কর্তব্য, মেয়েকে পাত্রস্থ করা। মেয়ের বিয়ে নিয়ে তার হাজার স্বপ্ন। তিনি চেয়েছিলেন তার মেয়ে একজন স্বনামধন্য ডাক্তার হবে। সারাদেশে তার নাম ছড়িয়ে পড়বে। সে গরিব দুঃখীদের বন্ধু হয়ে বিনামূল্যে চিকিৎসা দেবে। কিন্তু ডাক্তারি পড়তে রাজি হয়নি বৃষ্টি। যা হোক, এবার তাকে বিয়ে দেওয়ার পালা।

চৌধুরী সাহেব ঘরে বসে একা একা ভাবেন, মেয়ের জন্য বিদেশ থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ডাক্তার দেখব ? নাকি ব্রিলিয়ান্ট ইঞ্জিনিয়ার দেখব ? বিজনেস ম্যাগনেট হলে কেমন হয়। কিংবা পুলিশ অফিসার ? একা একা বিড়বিড় করছিল চৌধুরী সাহেব। এমন সময় তার স্ত্রী নার্গিস চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে ঢোকেন। বলেন, একা একা কী বিড়বিড় করছ ? চৌধুরী সাহেব হেসে বলেন, এসো, নার্গিস বসো, কথা বলি। মেয়েতো বড়ো হলো, বিয়ে দিতে হবে না ? সেজন্য আগে পরামর্শ করা দরকার।

একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করল। আসলে বৃষ্টি তো খুব সুন্দর ও শিক্ষিতা। রান্না-বান্না, ঘর-গৃহস্থালির কাজে সে বেশ নিপুণা। স্কুলের শিক্ষিকা। তাকে সবাই পছন্দ করে। অনেক ভালো ঘর বর তার জন্য এসেছে। কিন্তু এক এক করে সব সম্মন্ধই সে কোনো-না-কোনো অজুহাত দেখিয়ে বানচাল করে দেয়। এমন করে কেটে যায় আরো কিছু সময়। এর মধ্যেই চৌধুরী সাহেব জানতে পারেন তার মেয়ে নিজে তার বিয়ের ব্যবস্থা করে রেখেছে। একথা শোনার পর তিনি ভীষণভাবে আহত হন এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার মেয়ে তাকে না জানিয়ে এভাবে নিজে নিজে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এমন তিনি কোনোদিনই ভাবতে পারেননি। খোঁজ নিয়ে দেখা যায় খুব সাধারণ ঘরের সাধারণ চাকরিজীবী এমন একটি ছেলেকে সে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চায়। তিনি এ বিয়ে পছন্দ করতে পারেননি তাই এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহও দেখাননি।

একদিন বৃষ্টি স্কুল থেকে বাড়ি ফেরেনি। ওর টেবিলের ওপর রেখে যাওয়া চিরকুট দেখে বোঝা যায় সে চলে গেছে তার নতুন জীবনের উদ্দেশে। ঘটনা জানার পর ডুকরে কেঁদে ওঠে ছোটোভাই মেঘ। চৌধুরী সাহেব ও তার স্ত্রী অশ্রুসিক্ত হন। চৌধুরী সাহেবের ভারাক্রান্ত হৃদয় যেন অভিমানে ফেটে পড়ে। তিনি দুঃখ করে বলেন, আজ তুই আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেলি। সুখে থাকিস মা, আমাকে ভুলে যাস। এ অধম বাবা আর তোর সুখী জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। আর কোনোদিন তোর খোঁজ করবে না।

বৃষ্টিও এক বুক অভিমান নিয়ে বাবাকে ছেড়ে একাই চলে যায়। তার ভাবনা, যাকে ভালোবেসেছে তাকে ছাড়া সে সুখী হতে পারবে না। বাবা কেন এ সহজ কথাটি বুঝতে পারলেন না। কেন তাকে এভাবে একা চলে যেতে হলো।

বাবা মেয়ের তীব্র অভিমান বজায় থাকল দিনের পর দিন।

সময়ের ব্যবধানে বৃষ্টির কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক ছেলে । আত্মীয়-স্বজন অনেকেই হাসপাতালে বৃষ্টির পাশে দাঁড়ায়, সাহস জোগায়। কিন্তু চৌধুরী সাহেব নীরব অভিমানে শুধু চোখের জলই ফেলে যান। অসুস্থ মেয়েটাকে দেখতে যান না। দেখতে যান না সদ্য পৃথিবীতে আসা নাতিকে। হয়ত তিনি মনে মনে ভেবেছিলেন, মা তুই আমার কাছে একটিবার আয়। তোকে না দেখে আমি আর থাকতে পারছি না। তুই একবার এলে আমার সব অভিমান দূর হয়ে যাবে। মাগো তোর কি একবারও বাবাকে দেখতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় না বাবা তোর জন্য কষ্ট পেয়ে কত রোগা হয়ে গেছে।

বৃষ্টিও হয়ত এমন ভেবেছে। সে ভেবেছে আমার অসুস্থতার কথা শুনেও বাবা একবার আমাকে দেখতে এলো না। কিন্তু কেউ কারো অভিমান থেকে বা জিদ থেকে একপাও সরে না।

কেটে যায় কয়েকটি বছর। বাবা মেয়ের সম্পর্ক ছিন্ন মালার মতো পড়ে থাকে। এদিকে কষ্ট চাপিয়ে রাখতে গিয়ে চৌধুরী সাহেব এক ভয়ঙ্কর অসুখ বাঁধিয়ে ফেলেন। কারো কাছে নিজের মনের বা শরীরের কোনো কষ্টের কথা ব্যক্ত করেন না তিনি।

তার বাড়ির সামনে একটুকরো জায়গায় নানারকম ফুলগাছে ভরা একটি বাগান আছে। চৌধুরী সাহেব মাঝেমধ্যে ওখানে পায়চারি করতেন। একদিন তার ছেলে মেঘ বাবাকে বাগানে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে ওঠে। সাথে সাথে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার জানান, পেসেন্টের অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না। কথাটি বৃষ্টির কানে পৌঁছে। বৃষ্টি সজল চোখে ছেলেকে নিয়ে বাবাকে দেখতে এলো। চৌধুরী সাহেব ঘুমের ঘোরে ছিলেন। একটি শব্দ একটি ডাক তার কানে ভেসে এলো। বাবা ...।

হৃদয়ের দুয়ারে কে যেন নতুন করে কড়া নেড়ে গেল। চোখ তুলে তাকাতেই তিনি মেয়ের মুখটি দেখলেন। আর অভিমানের শত সহস্র জলকণা গড়িয়ে পড়ে দু’চোখ বেয়ে। তিনি আবার কিছু না বলেই চোখ বন্ধ করেন। একটি ছোট্টো কোমল হাতের স্পর্শ পেলেন চৌধুরী সাহেব। ছোট্টো হাতটি তার চোখের জল মুছিয়ে দিল। বলল, “কেঁদো না নানু ভাইয়া !” তিনি চোখ তুলে তাকিয়েই দেখলেন, এক ফুটফুটে ছোট্টো ছেলে। চৌধুরী সাহেব পরম আবেগে সেই ছোট্টো হাতটি নিজের হাতের মুঠিতে পুরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আর শুধু একটি কথাই বললেন, “নানু ভাই, আমি বাঁচতে চাই”।

অলঙ্করণ : মনিরুজ্জামান পলাশ